
ছবি: জনকণ্ঠ
ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার গাজনা ইউনিয়নের মথুরাপুর দেউল ষোড়শ শতাব্দীর একটি স্থাপনা। ঢাকা-খুলনা জাতীয় মহাসড়কের মধুখালী বাজার থেকে মধুখালী-বালিয়াকান্দি আঞ্চলিক সড়কে মধুখালী সদর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে গাজনা ইউনিয়নে সড়কের পশ্চিম দিকে অবস্থিত। এর বিপরীত দিক দিয়ে বয়ে গেছে চন্দনা নদী।
মথুরাপুরের এই ঐতিহাসিক দেউলটি একনজর দেখতে প্রতিনিয়ত দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে আসেন। তবে সেখানে নেই কোনো পর্যটক সুবিধা। এখানে এসে নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়।
০.৪০ একর জমির উপর কারুকাজ খচিত প্রায় ৮০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এ দেউলটির গায়ের টেরাকোটার দৃষ্টিনন্দন ও শৈল্পিক কাজ ও স্থাপত্যশৈলীর মুন্সিয়ানা বলে দেয় এটি মুঘল আমলের কীর্তি। দেউলটির সারা অবয়ব জুড়েই রয়েছে শিলাখণ্ডের ছাপচিত্র, মাটির ফলকে তৈরি অসংখ্য ছোট ছোট মূর্তি, যা দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে, মনোজগতে নাড়া দেয় এবং জানার কৌতূহলকে উস্কে দেয়।
কথিত আছে, সংগ্রাম সিং নামক বাংলার এক সেনাপতি এটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৬৩৬ সালে ভূষণার বিখ্যাত জমিদার সত্রাজিতের মৃত্যুর পর সংগ্রাম সিংকে এলাকার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তৎকালীন শাসকের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি বেশ ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। এলাকার রীতি অনুসারে তিনি কাপাস্তি গ্রামের এক বৈদ্য পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেন এবং মথুরাপুরে বসবাস শুরু করেন।
অন্য এক সূত্রমতে, সম্রাট আকবরের বিখ্যাত সেনাপতি মানসিং রাজা প্রতাপাধিত্যর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসেবে এই দেউল নির্মাণ করেছিলেন। সে অনুযায়ী মথুরাপুর দেউল একটি বিজয় স্তম্ভ।
ষোড়শ শতাব্দীর স্থাপনাগুলোর মধ্যে মথুরাপুর দেউল একমাত্র রেখা প্রকৃতির দেউল। দেউলটি কোনো বিশিষ্ট একটি ভবনের মতো স্থাপনা। এর একমাত্র দক্ষিণমুখী প্রবেশপথ রয়েছে। এটি তৎকালীন ভবনগুলোর মধ্যে একমাত্র বারো কোণবিশিষ্ট কাঠামো। স্থাপনাটির মূল গঠন উপাদান চুন-সুরকির মিশ্রণ। পুরো স্থাপনা জুড়ে টেরাকোটার জ্যামিতিক ও বাহারি চিত্রাঙ্কন রয়েছে।
রামায়ণ, কৃষ্ণলীলার মতো হিন্দু পৌরাণিক কাহিনির চিত্র, গায়ক, নৃত্যকলা, পবনপুত্র বীর হনুমান এবং যুদ্ধচিত্রও এই দেউলের গায়ে খচিত রয়েছে। প্রতিটি কোণের মাঝখানে কৃত্তিমুখা স্থাপন করা হয়েছে। তবে দেউলটির কোথাও কিছু লেখা পাওয়া যায়নি।
বাংলার ইতিহাসে এর নির্মাণশৈলী অনন্য বৈশিষ্ট্যবহন করে। এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি সুরক্ষিত সম্পদ। বহুদিন ধরে অবহেলার কারণে দেউলটি অযত্নে পড়ে ছিল। ২০১৪ সালে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোর্শেদ জামানের উদ্যোগে জেলা প্রশাসন দেউলটির সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হাতে নেয়। ২০১৪ সালের মার্চ মাসের শেষভাগে এই কাজ সম্পন্ন হয়। এর পর থেকে দেউলটির কোনো যত্ন নেওয়া হয়নি।
বর্তমানে এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সম্পদ।
শহীদ