ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মানবতার পাঠশালায় নিঃশব্দ আলো ছড়াচ্ছেন এক তরুণ!

রুমান হাসান তামিম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ১১:৩১, ১৪ জুন ২০২৫

মানবতার পাঠশালায় নিঃশব্দ আলো ছড়াচ্ছেন এক তরুণ!

সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় এসে রক্তদাতা, পথশিশুদের শিক্ষক, ও স্বেচ্ছাসেবী এক নিরব কর্মযোদ্ধার গল্প। ঢাকার ফুটপাথে, খোলা আকাশের নিচে কিংবা শহীদ মিনারের পাশ ঘেঁষে কিছু শিশু হাসছে, কেউ হয়তো অক্ষর চেনা শিখছে, কেউবা স্লেটে যোগ-বিয়োগের অঙ্ক কষছে। আর এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোর পেছনে রয়েছেন একজন তরুণ, যার নাম এ কে এম শাকিল। তিনি রাজধানীর সরকারি বাঙলা কলেজের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মানবিক কাজের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার ঘরে যুক্ত হয়েছে এক যুগান্তকারী অধ্যায়।

সাতক্ষীরা জেলার দরগাহপুর গ্রামের সন্তান শাকিল বর্তমানে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা ও সেবামূলক নানা কার্যক্রম। তার গড়ে তোলা উদ্যোগগুলোতে সহস্রাধিক পথশিশু, রক্তপ্রয়োজনে থাকা মানুষ ও অসহায় পরিবার উপকৃত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সমাজকর্মীরা।


মানবিকতার বীজবপন—রক্তদানের মধ্য দিয়ে শুরু:
২০১৮ সালের এক দিন। শাকিল তখন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। সে দিনই এক বয়স্ক নারী কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, রক্ত না পেলে তার মুমূর্ষু মা বাঁচবে না। শাকিল কোনো কিছু না ভেবেই তার সাহায্যে এগিয়ে যান। যদিও সময়মতো পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেননি, কিন্তু ওই দিনটাই ছিল মানবিকতার পথে তার প্রথম দৃঢ় পদক্ষেপ। এই অভিজ্ঞতা তাকে বদলে দেয়। তখন থেকেই রক্তদানের একটি সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা মাথায় ঘুরছিল। বাবার সহযোগিতায় একটি স্মার্টফোন কেনার পর তিনি “বাঙলা কলেজ ব্লাড ব্যাংক” প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে পরিণত হয় “৭ কলেজ ব্লাড অর্গানাইজেশন”–এ। বর্তমানে এই সংগঠন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রক্তদানের সচেতনতা সৃষ্টি, রক্ত গ্রুপ নির্ণয়, মুমূর্ষু রোগীর পাশে দাঁড়ানোর মতো কাজ করে যাচ্ছে।

পথশিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব:
২০২০ সালের করোনা মহামারির সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক শিশুকে রক্তদানের পর বিশ্রাম নিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসেছিলেন শাকিল। হঠাৎ কিছু শিশু তার কাছে খাবার চায়। তাদের অনাহারে কষ্ট দেখে শাকিল নিজ উদ্যোগে শাহবাগের এক খাবার হোটেলে নিয়ে পেটভরে খাওয়ান। সেই খাবার খেয়ে শিশুরা আনন্দে তাকে জড়িয়ে ধরে। শাকিল জানান, সেই মুহূর্ত তাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।

ভাবনায় আসে—এই শিশুদের ভবিষ্যৎ কী? ফুল বিক্রি, পানি বিক্রি বা ছোটখাটো কাজ করতেও ন্যূনতম শিক্ষা দরকার। তিনি ভাবেন, “এদের যদি একটু পড়ানো যায়!”—এভাবেই শুরু হয় খোলা আকাশের নিচে ‘আলোর পাঠশালা’। দিনে চাকরি, রাতে বা অবসরে পথশিশুদের পড়ানোই তার নেশায় পরিণত হয়।

বর্তমানে তিনি “মজার ইশকুল”, “জুম বাংলাদেশ স্কুল” ও “প্রত্যয় শিশু কেন্দ্র”-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে দুই শতাধিক সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে পাঠদান করছেন। শিশুদের কাছে তিনি এখন শাকিল স্যার নামেই পরিচিত


স্বপ্ন দেখেন, শুধু নিজের জন্য নয়—সব শিশুর জন্য:
ব্যক্তিজীবনে শাকিল কখনো উচ্চবেতনের চাকরি কিংবা বাহবাপূর্ণ জীবনের পেছনে ছোটেননি। প্রতিমাসে নিজের বেতনের গড়ে ১৫–২০ শতাংশ মানবিক কাজে ব্যয় করেন। কখনও পথশিশুর খাবার, কখনও ওষুধ কিনে দেন কোনো গরিব রোগীর জন্য, আবার কখনও জামা কিনে দেন শীতার্তদের জন্য। তিনি বলেন, “অন্যরা যখন সিজিপিএর পেছনে ছুটছে, আমি তখন পথশিশুদের ভালোবাসা কুড়িয়ে বেড়াচ্ছি।”

২০২৪ সালের আগস্টে পুলিশের কর্মবিরতির সময় ঢাকা শহরের রাস্তায় ৮ দিন টানা ট্রাফিক সামলেছেন তিনি। ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাড়া ফেলে। এছাড়া তিনি মরণোত্তর চক্ষুদাতা হিসেবেও নিজেকে নিবন্ধন করেছেন (সন্ধানী, কার্ড নম্বর: SIEBON-7374)। শুধু তাই নয়, করোনা মহামারির সময় নিজ এলাকায় আক্রান্তদের সেবায়ও সক্রিয় ছিলেন।

শাকিল জানান, তার বাবাই তার অনুপ্রেরণা। ছোটবেলা থেকেই দেখতেন বাবা সামর্থ্য অনুযায়ী গরিব-দুঃখীদের পাশে দাঁড়ান। অভাবের মধ্যেও বাবা মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। বাবার পথ ধরেই নিজের মানবিক স্বপ্ন বুনেছেন তিনি। পথশিশুদের কাছে তিনি বন্ধু, শিক্ষক এবং মাঝে মাঝে বড় ভাইয়ের মতো অভিভাবক। সমাজে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা এসব শিশুদের জীবন বদলে দিতে চান শাকিল। তার স্বপ্ন—এই শিশুরাই একদিন মানবসম্পদে পরিণত হবে।

“৭ কলেজ ব্লাড অর্গানাইজেশন”-এর পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তার নেতৃত্বে বিভিন্ন জেলায় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প, বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সহায়তা, গরম পোশাক বিতরণসহ নানা কর্মসূচি চালু রয়েছে। ফেসবুকে সক্রিয় বার্তার মাধ্যমে তরুণদের আহ্বান জানিয়ে থাকেন রক্তদান ও স্বেচ্ছাসেবায় অংশ নিতে।

শাকিল কারও কাছ থেকে প্রশংসা চান না। তিনি চান—তরুণরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সমাজের পাশে দাঁড়াক। “এই কাজগুলোর জন্য কোনো পুরস্কার বা স্বীকৃতি নয়, মানুষের ভালোবাসাই যথেষ্ট,”—বলছিলেন শাকিল।

একটি মোমবাতি যেমন নিজের অস্তিত্ব বিলিয়ে আলো দেয়, তেমনি শাকিলের মতো তরুণরা সমাজে মানবিকতা ছড়িয়ে দেন নীরবে। সমাজ বদলায় তখনই, যখন কেউ একজন উদ্যোগ নেয়… নিঃশব্দে, নিরন্তর।

আঁখি

×