
আমার শৈশবের প্রথম শব্দটা কী ছিল জানি না। তবে চোখ মেলে পৃথিবীটা যখন প্রথম দেখেছি, পাশে ছিলেন যে মানুষটি—তিনি আমার বাবা। আমার জীবনের প্রথম ছায়া, প্রথম ছাতা, প্রথম অনুপ্রেরণা, প্রথম সাহস—বাবা।
বাবা মানে আমার প্রথম বন্ধু:
যার কাঁধে চড়ে দেখেছি গ্রামের মেঠোপথ, গাছের ছায়া, পাখির ডাক। যিনি দুপুরের গরমে আমাকে কোলে করে নিয়ে গেছেন বাজারে, খেলার মাঠে, কখনো বা মসজিদে। কারও সামনে না বললেও জানি—আমার দুষ্টামির পেছনে তাঁর ছিল নিঃশব্দ ভালোবাসা। আমার বাবা ছিলেন সাত ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম। আর আমরা তিন ভাইবোন। আমি সবার ছোট। বাবা আমাকে একটু বেশিই আদর করতেন, আবার প্রয়োজন মতো শাসনও করতেন। সন্ধ্যার পর বাইরে থাকতে দিতেন না। শীতের কনকনে ভোরে সাইকেলে করে স্কুলে পৌঁছে দিতেন। নিজের না খেয়ে, না পড়ে আমাদের স্বপ্নপূরণ করেছেন।
আমার বাবা আমার নির্ভরতার প্রতীক:
যে মানুষটা চুপচাপ সারা বছর কষ্ট করেন, আমরা তিন ভাই বোন যেন নিজের স্বপ্ন গড়তে পারি। শৈশব থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রতিটি কঠিন সময়ে যাঁর উপর নির্ভর করতে পারি চোখ বন্ধ করে, তিনি আমার বাবা। তাঁর উপস্থিতি মানেই একটা আশ্বাস—'যা-ই হোক, বাবা আছেন।' কখনো রাত জেগে আমার জন্য পথ চেয়ে থাকা, কখনো কাঁধে তুলে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, কখনো চুপচাপ কষ্ট করে প্রয়োজনীয় জিনিস জোগাড় করে দেওয়া—এই নির্ভরতার কোনো মূল্য হয় না, কিন্তু অনুভব করা যায় প্রতিটি নিঃশ্বাসে। আমি জানি, জীবনের ঝড় যত বড় হোক না কেন, বাবার ছায়া মানেই নিরাপত্তা, মানেই ঠেকার দেয়াল। তিনি আমার সবচেয়ে দৃঢ় ভরসা।
আমার সেরা শিক্ষক:
আমার হাতে প্রথম খাতা তুলে দিয়েছিলেন যিনি, তিনিই আমার জীবনের প্রথম পাঠদাতা। শুধু অঙ্ক শেখাননি, শিখিয়েছেন জীবন বুঝতে। আমার ভুলে কখনো ধমক দিয়েছেন, কখনো আবার চোখের জল লুকিয়েছেন। সেই ধমকই আজ ভরসার উচ্চারণ মনে হয়।
এখনও স্পষ্ট মনে আছে বিকালে একবার মিরপাড়ার মধ্য দিয়ে স্কুলমাঠে যেতে ঠিক যখন রমিজ কাকার বাসার ওখানে পৌঁছেছিলাম তখন আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম—“আব্বু, এই সুন্দর পৃথিবীটা কে বানিয়েছে? সবাই বলে আমাদের জন্ম মৃত্যু সবকিছু আল্লাহর হাতে, তো আল্লাহ কে, পরিচয় কি, কিভাবে বাঁচে বাবা তখন খুব সহজভাবে সূরা ইখলাসের ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝিয়েছিলেন মহান আল্লাহর পরিচয়। সেই শিক্ষাই আমার ঈমানের ভিত্তি।
মনে পড়ে একবার ঈদে এক আত্মীয় বাসায় বেড়াতে যেয়ে তাদের রুমে দেওয়াল ঘড়ি দেখে পড়ে, সময় বলতে পারছিলাম না। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম—“আব্বু, কয়টা বাজে বুঝি কীভাবে?” বাবা তখন ধৈর্য নিয়ে হাতে ধরে বুঝিয়েছিলেন। এভাবে প্রতিটা সময়ের প্রতিটা ধাপে ধাপে হাজার হাজার কত কিছুই যে শিখছি কৌতুহলবশত জিজ্ঞাসা করছি আর শিখেছি তার কোন শেষ নাই। আমার বাবা আমার কাছে শুধু একজন মানুষ নন- তিনি আমার আদর্শ, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়।
আমার সুপার হিরো:
ছোটবেলায় যখন হাঁটতে পারতাম না ঠিকমতো, তিনি হাত ধরতেন। আজও যখন হতাশা আসে, সেই অদৃশ্য হাত যেন পিঠে পড়া সাহসের চাপ হয়ে আসে। তাঁর পরিশ্রমের প্রতিটি ঘামে, আমার স্বপ্নের ভিত্তি গাঁথা।
আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছেন—সংসারে সীমাবদ্ধতা থাকলেও স্বপ্নের কোনও সীমা নেই। শীতের সকালে স্কুলে দিয়ে আসা হোক, না হয় সন্ধ্যায় খোঁজ নিয়ে ডেকে আনা—সবই ছিল আমার জীবনে নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার পাঠ। তিনি নিজে কখনো বড় স্কুলে পড়েননি, কিন্তু আমার পড়ালেখার জন্য সবকিছু দিয়েছেন। শুধু দায়িত্বই নয়—তিনি নিজের জীবনের চর্চা দিয়ে শিখিয়েছেন কিভাবে একজন ভালো মানুষ হতে হয়।
খেলার সাথী:
ছোটবেলার স্মৃতিগুলো আজও ঝকঝকে। ক্রিকেট খেলার জন্য পাগল ছিলাম। গ্রামে ক্রিকেট ব্যাট কিনে খেলা করা এতটা সহজলভ্য ছিল না । বাবা তখন কষ্ট করে বাহির থেকে কাঠ সংগ্রহ করে নিজ হাতে কাঠের ব্যাট বানিয়ে দিতেন। সেই ব্যাট ছিল আমাদের গ্রামের সবার আনন্দের উৎস। শুধু ব্যাটই নয়—গুলতি, লাটিম, ধনুক-তীর, জুতা-বোতলের গাড়িও নিজ হাতে বানিয়ে দিতেন বাবা। খেলার সামগ্রী যেন তার হাতেই যাদু হয়ে উঠত।
ঈদের সকালে নতুন জামা গায়ে দিয়ে বাবা আর আমি একসাথে মাঠে বের হতাম। তাঁর হাত ধরে আমার প্রথম ঈদগাহ যাত্রা। সেই স্মৃতির গায়ে এখনো রোদ পড়ে।
আমার সর্বদা অনুপ্রেরণার উৎস:
আমি যতবার হেরে গেছি, মনে পড়েছে বাবার পরিশ্রম।তপ্ত ক্লান্ত দুপুরে যখন ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটি, তখন বাবার পায়ের কষ্টই আমাকে টেনে নিয়ে যায় সামনে।
আমার জীবনের প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি সিদ্ধান্তে, প্রতিটি চেষ্টায় আমি যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছি—তিনি আমার বাবা। ছোটবেলায় যখন পড়ালেখা বুঝতাম না, তিনি ধৈর্য ধরে শিখিয়েছেন। খেলাধুলা যখন জীবনের স্বপ্ন হয়ে উঠেছিল, তিনি হয়েছিলেন সবচেয়ে বড় সমর্থক। আমি যখন হীনমন্যতায় ভুগতাম, তখন তিনিই প্রথম বলতেন—"নিজেকে ছোট ভাবিস না, আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।" আজ আমি যা হতে পেরেছি, তার পেছনে এই মানুষের প্রতিদিনের পরিশ্রম, সীমাহীন ভালোবাসা আর নিরলস অনুপ্রেরণাই আমার আসল মূলধন। তিনি শুধুই আমার বাবা নন, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা।
তিনি আমার আদর্শ:
আজও যখন বাসায় যাই, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে যান। শিখিয়েছেন সালাম দিতে, মুরুব্বীদের সম্মান করতে, নামাজ-কালাম পড়তে, সমাজে অবদান রাখতে। বাবা সবসময়ই একটা কথা বলেন —“শুধু নিজে ভালো থাকা মানেই ভালো থাকা নয়, আশপাশে দাঁড়িয়ে সবাইকে নিয়েই ভালো থাকতে হয়। তাহলেই সমাজটা পরিবর্তন হবে, পৃথিবীটা আরো সুন্দর হবে।" এই শিক্ষা আমার পাথেয়। এই মানুষটির মতই পরিশ্রম করতে চাই, মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই।
আমার বাবা শুধু একজন অভিভাবক নন—তিনি আমার জীবনের অভিভাবক আলো, আমার আত্মার ভিত, আমার প্রতিটি স্বপ্নের প্রথম অনুপ্রেরণা। যেভাবে তিনি নিঃস্বার্থভাবে ত্যাগ স্বীকার করে আমাদের বড় করেছেন, প্রতিটি চাওয়া পূরণের পেছনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন—তা কেবল একজন প্রকৃত বাবার পক্ষেই সম্ভব। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে আমি এটা অনুভূত করি যে আমার বাবাই পৃথিবীর সেরা বাবা।
বিশ্ব বাবা দিবসে আমি শুধু আমার বাবার জন্য নয়, বরং পৃথিবীর প্রতিটি যেন বাবা ভালোবাসা, সম্মান ও নিরাপত্তায় দিন কাটাতে পারেন—এটাই আমার হৃদয়ের সবচেয়ে গভীর চাওয়া। যেভাবে তারা আমাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে লালন-পালন করেছেন, আমরাও যেন তাদের বৃদ্ধ বয়সে তেমনই যত্ন নিতে পারি, পাশে থাকতে পারি। যেন কখনো তাদের মুখে কষ্টের রেখা না আসে, তাদের চোখে না ভেসে ওঠে কোনো হাহাকার।
অন্তরের গভীর থেকে একটি প্রার্থনাই করি— "হে আমার প্রতিপালক! তুমি দয়া করো আমার বাবা-মায়ের প্রতি, যেমন করে তারা আমাকে শৈশবে লালন-পালন করেছেন।"
রাজু