
এক সময় গ্রামবাংলার অলিতে-গলিতে দেখা যেত বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড়, মাটিতে বসে মার্বেল খেলা, লুকোচুরি কিংবা গুলতি হাতে পাখির পেছনে ছোটা। সময়ের আবর্তনে সেই দৃশ্য এখন যেন অনেকটাই দুর্লভ। তবে এখনো কিছু জায়গায় দেখা মেলে সেই চিরচেনা শৈশবের—যেখানে প্রযুক্তির দৌড়ে শিশুরা পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি।
যশোরের ঝিকরগাছার বামনালী-চাপাঁতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আঙিনায় সম্প্রতি এমনই এক চিত্র চোখে পড়েছে। প্রায় এক ডজন শিশু মাটিতে বসে মগ্ন হয়ে খেলছে মার্বেল। কিশোরদের চোখেমুখে আনন্দের ঝলক, প্রতিযোগিতার উত্তেজনা আর নির্মল শৈশবের ছোঁয়া। কেউ মাটি থেকে মার্বেল লক্ষ্য করে ছুড়ছে, কেউবা পাশে বসে হিসাব রাখছে কে কয়টা মার্বেল জিতেছে। এ যেন এক খেলার রাজ্য, যেখানে নেই কোনো ডিজিটাল পর্দা, নেই প্লাস্টিকের খেলনা—আছে কেবল নিখাদ খেলা আর বন্ধুত্ব।
মাঠের এক পাশে বসে মুগ্ধ চোখে খেলা দেখছিল এক বিশেষ শিশু—সাব্বির। তার ডান পা খানিকটা দুর্বল, হাঁটতেও অন্যদের চেয়ে ধীর, কিন্তু চোখে-মুখে সেই একই উচ্ছ্বাস। সময় পেলে সেও মার্বেলের বৃত্তের পাশে গিয়ে নিজের মতো করে একটি মার্বেল ছুঁড়ে দেয়, হাততালি দেয় অন্যদের খেলায়। কেউ তাকে থামায় না, কেউ তাকে সরায় না—বরং তাকে ঘিরেই যেন খেলার পরিধি বড় হয়ে ওঠে।
সাব্বিরের কণ্ঠে শোনা গেল— "আমি খেলতে পারি না সবসময়, কিন্তু ওরা আমাকে পাশে রাখে। আমি খুব খুশি যাইতে পারি, দেখতেও মজা লাগে। কখনো ওরা বলে, ‘এই সাব্বির, এবার তুই মার’—তখন মনে হয় আমি-ও পারি। আমি এই খেলাটা খুব ভালোবাসি।" স্থানীয় এক শিশু রূপম (১২) জানায়, “স্কুল বন্ধ থাকলে সকাল-বিকেলে সবাই মিলে এখানে খেলতে আসি। ফোন নাই, তবুও অনেক মজা লাগে।” তার পাশে থাকা জুনায়েদ বলে ওঠে, “আমি আজ ৫০ টা মার্বেল জিতেছি!”
স্থানীয় অভিভাবক শেখ রমজান বলেন, "এই সময়টায় মোবাইল আসক্তি থেকে দূরে রেখে বাচ্চাদের এমন খেলায় মেতে ওঠা সত্যিই আনন্দের। বাচ্চারা এখনো মাঠে আসে, খেলাধুলা করে—এটাই বড় পাওয়া। আমরা চাই ওরা খেলুক, হাসুক, মোবাইলের নেশায় না পড়ে প্রকৃতির সঙ্গে বড় হোক।"
মীর নাহিদ নামে একজন বলেন, "ছোটবেলায় আমরাও মার্বেল খেলতাম, এখন ওদের খেলতে দেখে মনে হয় সময়টা ফিরে পেয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে অধিকাংশ বাচ্চারা তো এসব খেলা জানেই না। কিন্তু এই পাড়ার ছেলেগুলো এখনো মাঠে আসে, মার্বেল খেলে। এটা দেখে ভালো লাগে।
শামীম নামে একজন বলেন, একসময় প্রতি গ্রামে গ্রামে অলিতে গলিতে মার্বেল খেলা শিশু-কিশোরদের প্রিয় সময়। স্কুল শেষে মাঠে নেমে পড়ত সবাই। সন্ধ্যা পর্যন্ত ধুলায় গড়াগড়ি খাওয়া ছিল স্বাভাবিক। এখন সেই দৃশ্য দেখা যায় না বললেই চলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, "গ্রামীণ খেলাধুলা শিশুর সামাজিক দক্ষতা ও মানসিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। মোবাইল-ভিত্তিক খেলাধুলা শিশুদের একাকীত্বে ঠেলে দেয়, যা উদ্বেগ ও অবসাদের জন্ম দিতে পারে। মার্বেল খেলা শুধু বিনোদনই নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে একধরনের গাণিতিক চিন্তা, লক্ষ্য নির্ধারণ আর ধৈর্যের অনুশীলন।"
প্রযুক্তির এই যুগে শিশুদের এমন গ্রামীণ খেলাধুলায় আগ্রহ সমাজের জন্য আশার আলো। এখনো কিছু শিশু আছে, যারা মাটির গন্ধ চেনে, যারা বিকেল বা দুপুরে মাঠে গিয়ে নিজেদের আনন্দ নিজেই খুঁজে নেয়। তবে এই আনন্দ টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন মাঠের, প্রয়োজন অভিভাবক ও শিক্ষকদের উৎসাহ, এবং সর্বোপরি একটি সমাজের সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি—যা মোবাইল আসক্তির বিপরীতে নির্মল খেলাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইবে।
বামনালী-চাপাঁতলা গ্রামের এই দুপুরবেলার দৃশ্য কেবল একটি খেলার নয়, এটি আমাদের সমাজের একটি দিশা, একটি বার্তা—যেখানে শৈশব এখনো মাটির ওপর গড়াগড়ি খায়, এবং নির্মল হাসিতে ভরে দেয় পুরো আকাশ।
আঁখি