ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সাতক্ষীরার রেলপথ: শতবর্ষের স্বপ্ন, কাগজে বন্দি বাস্তবতা

এবিএম কাইয়ুম রাজ, সাতক্ষীরা।

প্রকাশিত: ২০:১৬, ১১ জুন ২০২৫

সাতক্ষীরার রেলপথ: শতবর্ষের স্বপ্ন, কাগজে বন্দি বাস্তবতা

সরকারি অনুমোদন, নির্দেশনা ও দীর্ঘ প্রতিশ্রুতির পরও এখনো বাস্তবায়িত হয়নি সাতক্ষীরার স্বপ্নের রেলপথ। বাজেটে বরাদ্দ এলেও কাজ শুরু হয় না, আর এভাবেই বছরের পর বছর ধরে ফাইলবন্দি অবস্থায় রয়েছে সাতক্ষীরা-নাভারণ-মুন্সিগঞ্জ রেল প্রকল্প।

১১১ বছর ধরে রেলপথের স্বপ্ন দেখছে সাতক্ষীরাবাসী। কৃষি, মৎস্য, সুন্দরবনভিত্তিক পর্যটন ও ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও অবকাঠামোগত উন্নয়নে সাতক্ষীরা এখনো অনেক পিছিয়ে। জেলার এক-তৃতীয়াংশ কৃষিজমিতে বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষ হয়। মাছের উৎপাদন উদ্বৃত্ত থাকে প্রায় ৯০ হাজার মেট্রিক টন, যার একাংশ রপ্তানি হয় বিদেশে এবং বাকি অংশ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। এছাড়া আম, কুল, ধানসহ অন্যান্য শস্যও দেশজুড়ে সরবরাহ হয় সাতক্ষীরা থেকে।

যোগাযোগ ব্যয়ের কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে জেলার কৃষিপণ্য। যেমন সাতক্ষীরা থেকে আম ঢাকায় পাঠাতে প্রতি কেজিতে খরচ হচ্ছে গড়ে ২০ টাকা, যেখানে চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে রেলপথে পাঠালে খরচ হয় মাত্র ৫ টাকা। অথচ সাতক্ষীরার আম স্বাদে উন্নত হওয়া সত্ত্বেও পরিবহন ব্যয় বেশি হওয়ায় বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।

এদিকে নাভারণ থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথের দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করেছে সাতক্ষীরার সর্বস্তরের জনগণ। ৩ জুন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এই কর্মসূচি পালন করা হয়।

এক সময় নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল সাতক্ষীরার যোগাযোগ বর্তমানে সড়কপথের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। তবে সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন অন্যান্য জেলার তুলনায় এখানে অনেক কম। যোগাযোগ ব্যবস্থার এই দুর্বলতাকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয় রেলবঞ্চনার।

১৮৬২ সালে দর্শনা-জগতি রেললাইন এবং ১৮৮২-৮৪ সালে বনগাঁ-যশোর-খুলনা রেলপথ নির্মাণের সময়ই নাভারণে একটি রেলস্টেশন নির্মাণ করা হয়। ১৯১৪ সালে বৃটিশ ভাইসরয় কলকাতা থেকে নাভারণ হয়ে সাতক্ষীরা ও সুন্দরবন পর্যন্ত রেল সংযোগের নির্দেশ দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৮ সালে ভেটখালী সড়ক নির্মাণের সময়ও রেলপথের জন্য জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনার কথা শোনা যায়।

বর্তমানে প্রায় ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানারেইল কোম্পানি লিমিটেড সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করেছে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নাভারণ থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত ৯৮ দশমিক ৪২ কিলোমিটার রেলপথে থাকবে আটটি স্টেশন—নাভারণ, বাগআচড়া, কলারোয়া, সাতক্ষীরা, পারুলিয়া, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর ও মুন্সিগঞ্জ। এছাড়া কয়েকটি নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণেরও প্রস্তাবনা রয়েছে।

২০২০ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নে ১ হাজার ৬৬২ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রস্তাবনা চীন সরকারের কাছে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৩২৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ঋণ সহায়তা হিসেবে চাওয়া হয়, বাকি অর্থ সরকারি অনুদানে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল।

এই প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহম্মেদ বলেন, “সাতক্ষীরাবাসীর স্বপ্নের রেলপথ বাস্তবায়নে সরকার কাজ করছে। বরাদ্দ পেলেই কাজ শুরু হবে।”

সাতক্ষীরাবাসী এখন সেই বরাদ্দ এবং কার্যকর উদ্যোগের অপেক্ষায়।

রিফাত

×