ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ জুন ২০২৫, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শিল্প নয়, সুর- ঠাকুরগাঁওয়ের পাখায় বাজে প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম

আব্দুন নুর আজাদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার,ঠাকুরগাঁও 

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ৮ জুন ২০২৫

শিল্প নয়, সুর- ঠাকুরগাঁওয়ের পাখায় বাজে প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম

এক টুকরো তালপাতা, কয়েকটি বাঁশের ফালি, রঙিন সুতা আর অনেকখানি ধৈর্য—এই দিয়েই তৈরি হয় ঠাকুরগাঁওয়ের সেই হাত পাখা, যা শুধু গরমের বাতাস নয়, বহন করে জীবনের গল্প। কেউ দেখলে বলবে এটা একটা হাতের শিল্প, কিন্তু ভেতরের চোখে দেখলে বোঝা যায়—এটা একেকটি সুর, যেখানে বাজে অভাব-জয়ের লড়াই আর প্রান্তিক মানুষের আত্মসম্মানের সঙ্গীত।

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ছোট্ট এক গ্রামে বাস করেন রাবেয়া খাতুন। বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। মুখে বয়সের রেখা, কিন্তু হাতে এখনো কাজের শাণ। প্রতিদিন বিকেলে বসে যান নিজের উঠানে, তালপাতা শুকোতে দেন, আর ছোট নাতিটিকে শিখিয়ে দেন কীভাবে বাঁশের কাঠিকে বেঁকিয়ে পাখার হাড় বানাতে হয়।

“বড়লোকের ফ্যান চলে বিদ্যুতে, কিন্তু আমাদের পাখার ভরসা হাতে, আর মনে। এই পাখা বানাই আর বিক্রি করি, এতে বাড়ির বাজার চলে। কিন্তু শুধু টাকায় না, নিজের আত্মার শান্তিও পাই এই কাজে,” বলেন রাবেয়া।

তার মতো শতাধিক নারী, পুরুষ ও কিশোর এই হাত পাখা তৈরির সঙ্গে জড়িত। কাজটি মূলত পরিবারভিত্তিক—সকালে কেউ বাঁশ কাটে, দুপুরে পাতার সাজ, রাতে হয় নকশা আঁকার কাজ। এক ধরনের ছন্দ তৈরি হয় তাদের দিনযাপনে, যা কেবল অর্থনীতির সমীকরণ নয়, বরং সম্পর্ক, সংস্কৃতি আর সহমর্মিতার এক অনন্য উদাহরণ।

ঠাকুরগাঁওয়ের এই হাত পাখাগুলো এখন শুধু গৃহস্থালির প্রয়োজন নয়, শোভা পাচ্ছে শহরের মেলা, হস্তশিল্প প্রদর্শনী ও এমনকি কিছু হিপ কাফে রেস্টুরেন্টেও। কারিগররা পাখায় আঁকছেন নকশা—আলপনা, পাখি, পদ্মফুল, গ্রামীণ দৃশ্য। কেউ কেউ পুরাতন লোককথা বা আবেগী উক্তিও লিখে দিচ্ছেন সুতার জালে।

স্থানীয় কলেজছাত্রী ও উদ্যোক্তা রোকেয়া সুলতানা বলেন, “আমি এই পাখাগুলো শহরে এনে অনলাইনে বিক্রি শুরু করি। ঢাকার ক্রেতারা খুব আগ্রহ দেখায়। একেকটা পাখায় যে পরিমাণ সময় আর শ্রম দেয় এখানকার নারী-পুরুষ, তা দেখলে মন কাঁদে।”

একটা সাধারণ হাত পাখা ৫০ টাকা থেকে শুরু করে বিশেষ নকশার ক্ষেত্রে ২০০ টাকাও বিক্রি হয়। তবে লাভের হিসাব সহজ নয়। বাজারজাতকরণের অভাব, কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া আর প্রশিক্ষণের ঘাটতি এই শিল্পের বড় প্রতিবন্ধকতা।


জেলা শিল্পকলা একাডেমির কর্মকর্তার মতে, “এটা শুধু ঐতিহ্য নয়, এটি একটি সম্ভাবনাময় হস্তশিল্প। প্রান্তিক মানুষদের জন্য এটি হতে পারে আত্মনির্ভরতার একটি টেকসই পথ, যদি সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা মেলে।”

ঠাকুরগাঁওয়ের হাত পাখা যেন গ্রীষ্মের এক টুকরো স্নিগ্ধতা নয়, বরং শত কষ্টেও বেঁচে থাকার এক অবিচল শপথ। এই পাখার প্রতিটি সুতোয় গাঁথা আছে ভালোবাসা, লড়াই আর মানুষের গল্প—যেখানে শিল্প নয়, বাজে জীবনের সুর।

Jahan

×