ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৪ জুন ২০২৫, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ভোলার ঐতিহ্যবাহী মহিষের দুধের দই

জিআই পণ্যের স্বীকৃতিতে খুলে গেছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার

হাসিব রহমান

প্রকাশিত: ০০:৫০, ৩ জুন ২০২৫

জিআই পণ্যের স্বীকৃতিতে খুলে গেছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার

ভোলার ২শ’ বছরের বেশি সময়ের ঐতিহ্যবাহী মহিষের কাঁচা দুধের দই

ভোলার ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি ২শ’ বছরের বেশি সময়ের ঐতিহ্যবাহী মহিষের কাঁচা দুধের দই। এবার সেই মহিষের দুধের টক দই জিও-গ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে গেছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগের মতে, বর্তমান বছরে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকার দই বিক্রি হয়। ইতোমধ্যে চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে খুশি মহিষ খামারি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। তবে খামারিরা বলেছেন, শুধু জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিলেই হবে না, পাশাপাশি মহিষের সুরক্ষা ও তাদের খাবার ঘাসের অভাব দূর করতে সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন। ভোলার মানুষ মনে করছে সরকারি সহযোিগতা পেলে ভোলার জনপ্রিয় টক দই জিআই পণ্যের স্বীকৃতিতে দেশের অর্ধনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখবে।
স্থানীয়রা জানান, নদী ও সাগর বেষ্টিত উপকূলীয় দ্বীপজেলা ভোলা জেলার চার দিকে রয়েছে অসংখ্য চর। প্রাচীন কাল থেকেই এসব চরে পালন করা হচ্ছে মহিষ। আর লাভজনক হওয়ায় অনেকেই মহিষ পালন করে দুধ উৎপাদন করেন, আয় করছেন লাখ লাখ টাকা। চরাঞ্চলের এসব মহিষ থেকে গোয়ালারা দুধ সংগ্রহ করেন। সেই দুধ কন্টেইনারে নিয়ে ট্রলারযোগে শহরের বিভিন্ন দোকানে নিয়ে যান। দুপুরের দিকে সেই দুধ ছেঁকে বিভিন্ন সাইজের মাটির হাঁড়ি পরিষ্কার করে ঢেলে বসিয়ে দেন। পর দিন সকালে মাটির হাঁড়িতে দুধ থেকে দইয়ে রূপান্তর হলে খাওয়ার উপযোগী হয়। জানালেন, ভোলা আদর্শ দধি ভা-ারের মালিক ও খামারি আব্দুল হাই। তিনি আরও জানান, বিভিন্ন সাইজের দই ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে ৩শ’ এবং চার টাকায় মাটির হাঁড়ি বিক্রি হয়।
স্থানীয় ভোজনরসিক রায়হান বলেন, এই দই খুবই সুস্বাদু এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার। উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষের দৈনন্দিন আতিথিয়েতার সঙ্গে মহিষের দুধের টক দই জড়িয়ে রয়েছে যুগ যুগ ধরে। ভোলায় বিয়ে বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান এ দই ছাড়া হয় না বলেই চলে। খাবারের শেষে ভাতের সঙ্গে চিনি গুড় মিশিয়ে এই দই খায় ভোজনরসিকরা। শুধু ভাতের সঙ্গেই নয়, দই চিড়ার সঙ্গে হালকা মুড়ি ও চিনি মিশিয়ে মজা করে খাওয়া যায়। গরমের মৌসুমে দইয়ের সঙ্গে হালকা পানি ও চিনি মিশিয়ে ঘোল তৈরি করেও বিক্রি করা হয় দোকানে। এই ঘোল গরমের দিনে বেশ জনপ্রিয়। এই দইয়ের চাহিদা শুধু ভোলয়ই নয়, সারা দেশেই রয়েছে । এমনকি দেশের বাইরেও অনেকে আত্মীয়স্বজনদের কাছে পাঠান ভোলার ঐতিহ্যবাহী দই।
সম্প্রতি জিও-গ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতিস্বরূপ সনদ পেয়েছে ভোলার মহিষের দুধের টক দই। সেদিন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর হাত থেকে এ সনদ গ্রহণ করেন ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান। এর আগে গত বছর ২৪ সেপ্টেম্বর ভোলার মহিষের দুধের কাঁচা দইকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এতে করে খুশি স্থানীয় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মহিষ পালনকারী ও দই ব্যবসায়ীরা। তারা বলছে এ স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে ভোলায় মহিষ পালনকারী ও দই ব্যবসায়ীদের জন্য একটি নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে শুধু স্বীকৃতি পেলেই হবে না, পাশাপাশি মহিষের সুরক্ষা ও খাবারের ঘাষ উৎপাদন বৃদ্ধি করা গেলে ভোলার মানুষের চাহিদা মিটিয়েও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে রপ্তানি করা যাবে।
ভোলা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম খাঁন জানান, ভোলার ৭ উপজেলায় প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার মহিষ রয়েছে। প্রতি বছর দুই হাজার পাঁচ শত মেট্রিক টন দুধ উৎপাদন হয়। বছর প্রায় ৫ শত কোটি টাকার দই বিক্রি হয়। জেলায় সরকারিভাবে কিল্লা রয়েছে ২২টি ও বেসরকারি রয়েছে ৩টি। তিনি আরও বলেন, জিআই পণ্যের ¯ী^কৃতি পাওয়ার জন্য আমরা গর্বিত। মহিষের দুধ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মহিষের খাবার ঘাসের সঙ্গে দানাদার খাদ্য যেন দেওয়া হয় সে জন্য জন্য আমরা মহিষের খামারিদের পরামর্শ দিচ্ছি। এছাড়াও গোচারণ ভূমি ও ঘাস উৎপাদনের জন্য সার্বিক চেষ্টা চালাচ্ছি।
ভোলা জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান জানিয়েছেন, মহিষের দইয়ের দেশের বাইরেও সমাদর রয়েছে। যার কারণে আমরা এর জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছি। এর কারণে যারা মহিষ লালন পালন করে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে। এখানে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। এই দই দেশের বাইরে রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়াও এই দই যাতে ভালোভাবে বাজারজাত করা যায়  সেই বিষয়েও সরকারের প্রচেষ্টা রয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যা যা প্রয়োজন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এতে শুধু ভোলা নয়, দেশেরও প্রভূত উন্নতি হবে।

×