
ছবি: সংগৃহীত
গত ১৫ বছরে কুড়িগ্রাম জেলায় বহু সেতু নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও অর্ধেকের বেশি সেতু এখনো অসম্পূর্ণ, পরিত্যক্ত কিংবা ধসে পড়া অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
এ অবস্থায় জেলার কয়েক লাখ মানুষ ন্যূনতম যাতায়াত সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)-এর তথ্য বলছে, ২০০৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে যেসব সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
২০২৩ সালের অক্টোবরে উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের কাগজিপাড়া গ্রামে গিদারী নদীর ওপর ১৯৬৯ সালে নির্মিত সেতুটি ভেঙে পড়ে। ৬টি গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষ সেই সেতু ব্যবহার করতেন। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মজিদ জানান, ‘ছেলে-মেয়েরা এখন কোমরে পানি বেঁধে স্কুলে যায়। বন্যার সময় কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিতে পারাও যায় না।’
এলজিইডি’র সূত্রে জানা গেছে, জেলাজুড়ে ৩২টির মতো সেতু বর্তমানে আংশিক ধসে পড়া বা চলাচলের অনুপযোগী অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে ১৭টির নির্মাণকাজ শুরু হলেও অনিয়ম ও তদারকির অভাবে অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে।
রাজারহাট উপজেলার বাহিরগোলা বাজারের কাঁটাখালি নদীর ওপর সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২১ সালে। কিন্তু ২০২৪ সালের শেষ নাগাদও কাজ শেষ হয়নি। স্থানীয়রা জানান, ‘ঠিকাদার প্রথম কিছু দিন কাজ করেই চলে গেছে, এরপর কেউ আর আসেনি।’
এলজিইডি কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর অনেকটাই বাজেট সংকটে পড়ে। নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ না আসা পর্যন্ত কাজ বন্ধ থাকছে। জেলা প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নতুন দরপত্রের মাধ্যমে প্রকল্পটি পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’
কুড়িগ্রামের রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলা ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা মূল জেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন। দীর্ঘদিন ধরে সেতু নির্মাণের দাবি থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। স্থানীয় কৃষক সাহেব আলী বলেন, ‘ধান নিয়ে ঘাটে আসতে ৩ ঘণ্টা লাগে, তারপর নৌকা না পেলে বিক্রি করা যায় না। এক কিলোমিটার নদী পার হতে গিয়ে মনে হয় ঢাকায় যাচ্ছি।’
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন জমা দিলেও প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময় সেতু উদ্বোধন ও নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে সেগুলোর কাজ আর আগায় না। কুড়িগ্রামের এক প্রবীণ নাগরিক বলেন, ‘নির্বাচনের সময় নেতারা সেতু নিয়ে কথা বলেন, আবার সেতু পার হয়ে চলে যান। এরপর আর খোঁজ নেই।’
সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রবিউল হক বলেন, ‘প্রতিটি প্রকল্পেই রাজনৈতিক চাপ, তদবির আর দুর্নীতির ছায়া পড়ে। এজন্য কোনো প্রকল্পই শেষ পর্যন্ত ঠিকমতো হয় না।’
সরেজমিনে জানা যায়, শিক্ষার্থী, কৃষক, গর্ভবতী নারী ও বৃদ্ধদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বাঁশের সাঁকো, নদী পারাপারে নৌকার ঝুঁকি—এসবই তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। স্কুলপড়ুয়া এক ভুক্তভোগী কিশোরী বৃষ্টি আক্তার বলেন, ‘বৃষ্টির দিনে স্কুলে যাই না, কারণ পানি বাড়লে সাঁকো পার হওয়া যায় না।’
প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন ও সময়মতো কাজ শেষ করার নিশ্চয়তা বিধান
- সেতু নির্মাণে দুর্নীতি ও ঠিকাদারি গাফিলতি দূর করতে স্বাধীন তদারকি কমিটি গঠন
- স্থানীয় জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন
- এলজিইডি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমন্বিত পরিকল্পনা
কুড়িগ্রামের এই দীর্ঘস্থায়ী অবহেলা ও অবকাঠামোগত দুর্দশার চিত্র যেন শুধুই পরিসংখ্যান না থাকে। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ বাস্তবায়ন এবং জবাবদিহিতার চর্চা—যাতে সেতু হয়ে ওঠে শুধু ইট-পাথরের কাঠামো নয়, উন্নয়নের সঠিক প্রতীক।
রফিকুল ইসলাম রফিক/রাকিব