ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৩ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রায়পুরে নদীগর্ভে ডুবে যাচ্ছে আলতাফ মাস্টার ঘাট

প্রদীপ কুমার রায়, রায়পুর (লক্ষ্মীপুর)

প্রকাশিত: ১৩:০৭, ১ জুন ২০২৫

রায়পুরে নদীগর্ভে ডুবে যাচ্ছে আলতাফ মাস্টার ঘাট

একসময় বিকেল নামলেই মানুষের ভিড়ে মুখর হয়ে উঠত ঘাটের পাড়। নদীর হাওয়ায় জেগে উঠত প্রাণ, ভেসে আসত স্থানীয়দের হাসির শব্দ। এখন সেখানে শূন্যতা, আতঙ্ক আর নদীভাঙনের ক্রমশ গিলে-ফেলা স্মৃতি।

লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেঘনার কোল ঘেঁষা গড়ে ওঠা আলতাফ মাস্টার ঘাট ছিল উপজেলার একমাত্র গড়ে ওঠা পর্যটন কেন্দ্র। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদীর নৈসর্গিক টান আর স্থানীয় আলতাফ মাস্টারের উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই স্থানটি এখন ভাঙনের মুখে। আলতাফ মাস্টার ঘাটের পশ্চিম অংশ থেকে শুরু হয়েছে মাটি সরে যাওয়া। প্রথমে বাঁধের মাটি ভাঙে, তারপর সিঁড়ি, এখন পুরো ঘাট এলাকা হুমকির মুখে।

স্থানীয়রা বলছেন, এটা শুধু একটা ঘাট ছিল না, আমাদের অস্তিত্বের একটা অংশ ছিল। প্রতিদিন একটু একটু করে নদী গিলে খাচ্ছে ঘাটটা, আমাদের চোখের সামনে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অথচ যেন কিচ্ছু করার নেই কারো।

স্থানীয় বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলতাফ মাস্টার নিজ উদ্যোগে এই ঘাট গড়ে তোলেন প্রায় এক সাত বছর আগে। প্রথমে এটি ছিল যাতায়াতের একটি ঘাট। পরে ধীরে ধীরে বাঁশের ছাউনি, বাঁধানো সিঁড়ি, পাশে গড়ে ওঠা চায়ের দোকান আর শিশুদের খেলার জায়গা মিলিয়ে এটি হয়ে ওঠে একটি প্রাকৃতিক বিনোদন কেন্দ্র। আধুনিক রেস্তোরাঁর সব সুবিধা নিয়ে গড়ে ওঠে কলাপাতা রেস্তোরাঁ, জলপরী রেস্তোরাঁ, নিউ দরবার, রিভার ভিউ রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর দোকান।

নিউ দরবারের মালিক আলাউদ্দিন খান বলেন, জলপরী ও কলাপাতা রেস্তোরাঁ ভাঙনের কবলে পড়ে ইতিমধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে রিভার ভিউ রেস্তোরাঁটি। মো. রাসেল নামের স্থানীয় এক যুবক বললেন, আমি একটি ট্রলারের মালিক। নদীপাড়ে ঘুরতে আসা পর্যটকদের ট্রলারে করে নদীর মাঝে জেগে ওঠা চরে নিয়ে যেতাম। গত ৯ মাস ধরে ঘাটে পর্যটক আসা কমতে কমতে এখন শূন্যের কোঠায় ঠেকেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, বিকেল হলেই নৌকায় চড়ে তরুণরা নদীতে ঘুরতে যেত, জানালেন এখন সব স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। ২ নম্বর ইউপি ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রোকন দেওয়ান বলেন, বিষয়টি তারা অবগত হয়েছেন। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এদিকে, এলাকার মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, কেবল কথা দিয়ে পরিস্থিতি সামলানো যাবে না। ঘাটের পাড়ে বালির বস্তা দেওয়া যেত। নদীর গতিপথ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা যেত। কেউ কিছু করেনি, অভিযোগ জান্নাতুল ফেরদৌস নামে স্থানীয় স্কুলশিক্ষিকার।

আলতাফ মাস্টার ঘাট শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র ছিল না; এটি ছিল একটি সামষ্টিক আবেগ, যা একে অন্যকে যুক্ত করেছিল। বর্তমানে দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের একমাত্র উন্মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশের স্থান ছিল এটি। এখন সেটি ধ্বংস হয়ে গেলে, হারিয়ে যাবে গ্রামের শিশুদের খেলার জায়গা, প্রেমিক-প্রেমিকাদের নির্জন প্রহর, নদীর জলে ঘুরে বেড়ানোর উৎসাহ।

নদী সবকিছু নিয়ে যায়, কিন্তু যদি আমরা একসাথে দাঁড়াই তাহলে আবারও গড়ে উঠবে আলতাফ মাস্টার ঘাট, বললেন বৃদ্ধ আলতাফ মাস্টার নিজেই। তার কণ্ঠে ক্লান্তি, চোখে জল, কিন্তু একটুকরো আশার ঝলক ঠিকই টের পাওয়া যায়।

রায়পুরের মানুষ জানে, নদী গিলে খেতে পারে মাটি, কিন্তু তারা হার মানতে জানে না। সেই লড়াইয়ের গল্পই হয়তো একদিন আবার শুরু হবে আলতাফ মাস্টার ঘাটের নতুন ইতিহাস দিয়ে।

আফরোজা

×