ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রধান উপদেষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা চট্টগ্রামবাসীর

টানা তিনদিনের বৃষ্টিতেও চট্টগ্রামে নেই জলাবদ্ধতা

নুরউদ্দীন খান সাগর, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ২৩:৫০, ৩১ মে ২০২৫

টানা তিনদিনের বৃষ্টিতেও চট্টগ্রামে নেই জলাবদ্ধতা

টানা তিনদিনের বৃষ্টিতেও চট্টগ্রামে নেই জলাবদ্ধতা

এক বছর আগের কথা। মাত্র ৫ মিনিটের বৃষ্টিতেও ডুবে গিয়েছিল বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বহু নিম্নাঞ্চল। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেও সুফল দেখাতে পারেনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তবে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনার পদত্যাগের পর দায়িত্ব নিয়েই চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় এই সমস্যার দিকে নজর দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। 
আলাদাভাবে এই সমস্যা সমাধানে দায়িত্ব দিয়েছিলেন চার উপদেষ্টাকে। তারা প্রতি সপ্তাহেই একেকজন একবার করে চট্টগ্রামে আসতেন। তাগাদা দিতেন চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনকে। জলাবদ্ধতার যত সংকট সব কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সে বিষয়ে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেন তারা। যে কারণেই এবার প্রথমবারের মতো সুফল পাচ্ছেন নগরবাসী। টানা তিনদিনের ভারি বৃষ্টিতেও চট্টগ্রামের কোথাও দেখা যায়নি জলাবদ্ধতা। এমন উদ্যোগের কারণে প্রধান উপদেষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে চট্টগ্রামবাসী।
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, এবার বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে নগরের খাল ও নালা-নর্দমা পরিষ্কার ও খননে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্ষা শুরুর আগে অধিকাংশ খাল ও নালা-নর্দমা পরিষ্কার করা হয়েছে। এ কারণে ভারি বর্ষণে পানি উঠছে না। তবে জলাবদ্ধতার শঙ্কা পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি তাঁরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরের ডিসি সড়ক, বাকলিয়া, চকবাজার, ফুলতলা, কে বি আমান আলী সড়ক, চান্দগাঁও, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, দুই নম্বর গেট, প্রবর্তক মোড়, হালিশহর, আগ্রাবাদ, ওয়াসা মোড় এলাকায় প্রতি বছরই বারবার জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো। ভারী ও টানা বর্ষণে এসব এলাকায় হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি জমে থাকত। বৃষ্টি থামলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকত পানি। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হতো। তবে গভীর নি¤œচাপের কারণে বৃহস্পতিবার রাত থেকে টানা বৃষ্টি হলেও শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। 
ডিসি সড়ক এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমানের বাড়ি চাক্তাই খালের পাশে। নগরের পানি নিষ্কাশনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হচ্ছে এই চাক্তাই খাল। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির সময় মিজানুর রহমানের বাড়ির সামনের সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার রাতভর বৃষ্টি হলেও তাঁর এলাকায় পানি ওঠেনি বলে জানান তিনি।
নগরের আরেক জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকা চকবাজারের বাসিন্দা আবদুল হামিদ। প্রতি বর্ষায় ভারি বর্ষণের সময় বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তাঁর বসতঘর তলিয়ে যায়। তবে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর ঘরে পানি ঢোকেনি বলে জানান তিনি। চকবাজার ডিসি রোডের বাসিন্দা আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, আগে সামান্য বৃষ্টি হলেই ডিসি রোডে পানি উঠত। ড্রেন পরিষ্কার ও বড় করায় এ বছর ডিসি রোডে পানি ওঠেনি। এ ছাড়া এবার চাক্তাই খাল খনন করা হয়েছে। খালের ভেতর থাকা বাঁধও অপসারণ করা হয়েছে। খাল পরিষ্কারের কারণে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়নি। তাই এবার জলাবদ্ধতা নেই। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা মো. ইসমাইল ভুঁইয়া বলেন, ‘শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ১৯২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। নি¤œচাপের প্রভাবে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। শনিবারও বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে।’
আবহাওয়া অফিস জানায়, সাধারণত ২৪ ঘণ্টায় ১ থেকে ১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তাকে হাল্কা, ১১ থেকে ২২ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তাকে মাঝারি, ২৩ থেকে ৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তাকে মাঝারি ধরনের ভারি, ৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তাকে ভারি এবং ৮৮ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি রেকর্ড হলে তাকে বলা হয়ে থাকে অতিভারি বৃষ্টিপাত। মূলত জলাবদ্ধতা নিরসনে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পেও প্রত্যাশিত সুফল না আসায়, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চারজন উপদেষ্টাকে বিশেষ দায়িত্ব দেন। এরপর তারা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে খাল ও নালার অবস্থা পরিদর্শন করে ৮টি স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। চলতি বছরে প্রথম পাঁচ মাসে এখন পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামে অন্তত আটটি সভা হয়েছে। 
এসব সভায় নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রামের সেবা সংস্থাগুলোর করণীয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এসব কাজ শেষ করতে মে মাস পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু করে সিটি করপোরেশন, সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড, সিডিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সেবা সংস্থাগুলো। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন জানান, বর্ষার আগেই জলাবদ্ধতা সহনীয় পর্যায়ে আনার লক্ষ্যে ১৭টি খাল খননসহ সমন্বিতভাবে কাজ চলছে। তারই অংশ হিসেবে নালার ওপর নির্মিত অবৈধ মার্কেট ভেঙে ফেলা, খাল-নালার সংস্কার ও মাটি অপসারণের ফলে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত হওয়ায় এবার দেখা যাচ্ছে বাস্তব সুফল। 
শুক্রবার (৩০ মে) বিকেলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সমন্বিত জলাবদ্ধতা নিরসন কার্যক্রম পরিদর্শন করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম। নি¤œচাপের প্রভাবে টানা বৃষ্টিতেও বন্দর নগরী চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা না হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। 
উপদেষ্টা বলেন, ‘টানা বৃষ্টির পরও নগরে জলাবদ্ধতা না হওয়া একটি বড় সাফল্য। এই সাফল্যের পেছনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা রয়েছে। পরিকল্পিতভাবে কাজ চালিয়ে গেলে ভবিষ্যতেও নগরবাসী জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। চলমান কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে বাকি কাজগুলো দ্রুত শেষ করতে হবে।’ 
নগরীতে চিরাচরিত জলাবদ্ধতার দেখা না মেলার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, পানি প্রবাহের পথগুলো পরিষ্কার থাকায় পানি জমতে পারছে না। এখন পর্যন্ত জলাবদ্ধতা প্রবণ এলাকাগুলোতে পানি ওঠার কোনো খবর পাইনি। পরিস্থিতি ভালো আছে। 
তবে এতে এখনই পুরোপুরি ‘খুশি’ হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি মন্তব্য করে কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রামে নগরীতে জোয়ারের পানির চাপ আছে। এই বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। তাই কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে যুক্ত সিল্টট্র্যাপ স্থাপন এবং সেগুলো পরিষ্কার রাখা জরুরি। পাশাপাশি স্লুইস গেটগুলো ক্লিয়ার রাখতে হবে। আগ্রাবাদ এলাকায় বক্স কালভার্টটি পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বহু বছর পর। সেটার কাজ চলছে। এই কাজ শেষ হলে কর্ণফুলী নদীর জোয়ারের কিছু পানি হয়তো সহজে নেমে যেতে পারবে। আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহ আছে।

×