ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান: প্রাচীন বিস্ময় থেকে আধুনিক বিতর্কের কেন্দ্র

মো: আতিকুর রহমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ২২:৫০, ২৮ মে ২০২৫

ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান: প্রাচীন বিস্ময় থেকে আধুনিক বিতর্কের কেন্দ্র

ছবিঃ সংগৃহীত

ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান, প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম এক নিদর্শন, যুগ যুগ ধরে ইতিহাস, প্রকৌশল এবং রহস্যের এক অপার সংমিশ্রণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, এটি বর্তমান ইরাকের ইউফ্রেটিস নদীর তীরে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে নব্য-ব্যাবিলনীয় সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার তার প্রিয় রানি অ্যামিটিসের জন্য নির্মাণ করেন। মিডিয়া দেশের সবুজ পাহাড় ও উপত্যকা থেকে আসা রানি ব্যাবিলনের শুষ্ক ও সমতল ভূমি পছন্দ করতেন না। রানির মন ভালো রাখতে সম্রাট এক বিশাল কৃত্রিম বাগান নির্মাণের নির্দেশ দেন, যা ‘ঝুলন্ত উদ্যান’ নামে ইতিহাসে খ্যাতি লাভ করে।

উদ্যানটি প্রকৃত অর্থে শূন্যে ঝুলে থাকত না, বরং এটি ছিল বহুস্তরবিশিষ্ট সোপানযুক্ত একটি ছাদবাগান। এর ভিত্তি প্রায় ৮০০ বর্গফুট আয়তনের ছিল এবং মাটি থেকে উচ্চতা ছিল প্রায় ৮০ ফুট। দূর থেকে দেখলে মনে হতো এটি যেন বাতাসে ভাসছে। ধারণা করা হয়, প্রায় ৪,০০০ শ্রমিক দিনরাত খেটে এটি নির্মাণ করেছিলেন এবং ১,০৫০ জন মালী নিয়োজিত ছিলেন এর পরিচর্যার কাজে। এখানে ৫ থেকে ৬ হাজার প্রজাতির ফুল ও গাছপালা রোপণ করা হয়েছিল। সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক ছিল এর সেচব্যবস্থা—ইউফ্রেটিস নদী থেকে মোটা পেঁচানো নলের সাহায্যে প্রতিদিন প্রায় ৮২ হাজার গ্যালন পানি ৮০ ফুট উচ্চতায় উত্তোলন করে বাগানে সরবরাহ করা হতো। সেই সময়ের জন্য এটি ছিল প্রকৌশলের এক অভাবনীয় উদাহরণ। প্রচলিত মত অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব ৫১৪ অব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাসের আক্রমণে অথবা কোনো বিধ্বংসী ভূমিকম্পে উদ্যানটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।

তবে আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি ঘিরে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক ড. স্টেফানি ডালি, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটের একজন গবেষক, তার গবেষণায় দাবি করেছেন যে এই উদ্যান ব্যাবিলনে নয়, বরং প্রাচীন অ্যাসিরীয় রাজধানী নিনেভেতে অবস্থিত ছিল। তিনি অ্যাসিরীয় রাজা সেনাচেরিবের শিলালিপির পুনঃঅনুবাদ করে এমন ধারণা তুলে ধরেন।

ডালির মতে, নিনেভেতে খননে আবিষ্কৃত উন্নত জল সরবরাহ ব্যবস্থাই প্রমাণ করে যে সেখানে একটি বিশাল বাগান বিদ্যমান ছিল। তিনি মনে করেন, ব্যাবিলনের পতনের পর নিনেভেকে ‘নতুন ব্যাবিলন’ নামে পরিচিত করা এবং সেনাচেরিব কর্তৃক শহরের প্রবেশপথগুলোর নাম ব্যাবিলনের প্রবেশদ্বারের আদলে নামকরণ করা—এইসব কারণেই ঐতিহাসিক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে এখনো ব্যাবিলনে ঝুলন্ত উদ্যানের কোনো নির্ভরযোগ্য নিদর্শন পাওয়া যায়নি। ১৯ শতকের শেষদিকে জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক রবার্ট কোল্ডওয়ে একটি ১৪ কক্ষবিশিষ্ট পাথরের ছাদযুক্ত কাঠামোকে ঝুলন্ত উদ্যান বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেই কাঠামো নদী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় প্রচলিত সেচব্যবস্থার বিবরণের সঙ্গে সেটির সামঞ্জস্য নেই। এ কারণেই অনেক গবেষক এখনও মনে করেন যে ঝুলন্ত উদ্যানের ধারণা সম্ভবত কেবল একটি রোমান্টিক কিংবদন্তি—বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্ব ছিল না।

আজও ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান ইতিহাসবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাধারণ পাঠকের কল্পনা ও কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এটি কেবল প্রাচীন স্থাপত্য ও প্রকৌশলের এক বিস্ময়কর নিদর্শন নয়, বরং মানব সৃষ্টিশীলতা, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধার এক অনন্য প্রতীক। উদ্যানটি আদতে কোথায় ছিল, আদৌ কি ছিল, তা নিয়ে বিতর্ক আজও অব্যাহত—আর এ বিতর্কই হয়তো একে আরও রহস্যময় ও মোহনীয় করে রেখেছে।

আলীম

×