ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৯ মে ২০২৫, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

জৌলুস হারাতে বসেছে এশিয়ার একমাত্র দৃষ্টিনন্দন কাঠ মসজিদ — রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ জরুরি

জি. এম. আদল, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, পিরোজপুর

প্রকাশিত: ১৫:১৬, ২৮ মে ২০২৫; আপডেট: ১৫:১৭, ২৮ মে ২০২৫

জৌলুস হারাতে বসেছে এশিয়ার একমাত্র দৃষ্টিনন্দন কাঠ মসজিদ — রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ জরুরি

ছবি : জনকণ্ঠ

❝দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের ওপরে একটি শিশিরবিন্দু❞।
মমিন মসজিদের দিকে তাকালে
রবীন্দ্রনাথের এই কবিতার লাইনগুলোর প্রকৃত অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।

আমরা অনেকেই বিদেশ ভ্রমণ করতে পছন্দ করি, তবে আপনি-আমি হয়তো জানিই না আমাদের খুব কাছেই দেশে ঘুরে দেখার মতো অনেক স্থাপত্য আছে।

তেমনি এক মুসলিম স্থাপত্য ❝মমিন মসজিদ❞।

মসজিদটি পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার উদয়তারা বুড়িরচর গ্রামে অবস্থিত।

এই মসজিদটিকে ২০০৩ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে।
ইউনেস্কো প্রকাশিত বিশ্বের অন্যতম মসজিদ নিয়ে প্রকাশিত ৪০০ পৃষ্ঠার একটি বইয়ে এ কাঠ মসজিদটি সচিত্র বর্ণনায় স্থান পেয়েছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র কাঠের তৈরি, শিল্পসমৃদ্ধ, দৃষ্টিনন্দন মুসলিম স্থাপত্যকলার একটি নিদর্শন।

শতবর্ষী এই মসজিদটি কাঠ দিয়ে তৈরি এবং মসজিদটিতে রয়েছে চমৎকার কিছু কাঠের ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি। কাঠের উপর খোদাই করা এই ক্যালিগ্রাফি মসজিদের সৌন্দর্যকে অনন্য এক শৈল্পিক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
তাই স্থানীয়ভাবে এটিকে কাঠ মসজিদও বলা হয়। 

ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম জাতির ইতিহাস সংরক্ষণ ও ধর্মীয় চেতনা থেকে ১৯১৩ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেন মৌলভি মমিন উদ্দিন আকন।
মসজিদের পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়া নিজে উপস্থিত থেকে তত্ত্বাবধান করেছিলেন জনাব মমিন উদ্দিন। মসজিদটি নির্মাণে তৎকালীন সময়ের ১৫-২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল বলে জানা যায়।

কাশ্মীরে নির্মিত একটি কাঠের মসজিদের আদলে নিজের নকশায় মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন তিনি। সেজন্য আসাম, ত্রিপুরা ও কাশ্মীর থেকে শাল, সেগুন আর লোহা কাঠ সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন তিনি। 

মসজিদের প্রধান মিস্ত্রির দায়িত্ব দেওয়া হয় পিরোজপুরের স্বরূপকাঠী এলাকার দৈহারী ইউনিয়নের শ্রী হর কুমারকে। তার নেতৃত্বে ২২ জন মিস্ত্রি ১৯১৩ সালে মসজিদ তৈরির কাজ শুরু করেন, যা শেষ হয় ১৯২০ সালে।

অপূর্ব সৌন্দর্যের এ মসজিদের পুরোটা জুড়ে আছে বাহারি নকশা ও কারুকাজ।
কাঠামো তৈরিতে লোহার পেরেক ব্যবহার না করে এর পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে কাঠের শলা।
২৪ ফুট দৈর্ঘ্য আর ১৮ ফুট প্রস্থের মসজিদটির ভেতরে আলো-বাতাস ঢোকার এবং সৌন্দর্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পাটাতনের মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে আরেকটি দোচালা টিনের ছাউনি।
মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণে দুটি করে এবং পূর্ব ও পশ্চিমে চারটি করে জানালা রয়েছে।
পূর্বদিকে একটিমাত্র প্রবেশ দরজায় কারুকার্যখচিত দুটি থামযুক্ত দরজা রয়েছে, যার উপরিভাগে কাঠের ওপর আছে আরবি ক্যালিগ্রাফি। বৈচিত্র্যময় এই ক্যালিগ্রাফির ব্যবহারে মসজিদটি হয়ে উঠেছে প্রাচীন যুগের এক অনন্য শৈল্পিক নিদর্শন।

মসজিদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে স্থানীয়রা বলেন,

২০০৮ ও ২০২১ সালে খুলনা জাদুঘরের আওতায় মসজিদটির কিছু সংস্কার করা হয়েছে। মসজিদটিকে এর মধ্যে দুবার সংস্কার করা হয়েছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টিকিয়ে রাখতে হলে মসজিদটির কাঠামো ঠিক রেখে এর উপর একটি ছাদ দেওয়া উচিত। এতে করে মসজিদটির কাঠগুলো সুন্দর থাকবে এবং ঝড়-বৃষ্টিতেও নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।

এই মুহূর্তে নামাজের জায়গা সংকুলানের জন্য মসজিদের সম্মুখে বাঁশ এবং টিন দিয়ে অস্থায়ী ছাউনি দেওয়া হয়েছে, যার ফলে সামনে থেকে মসজিদটি দেখা যায় না। এতে এর সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে! তাছাড়া বাইরে ছাদ থাকলে বৃষ্টিতে বা গরমে নামাজ পড়তে কোনো সমস্যা হবে না।

তারা আরও বলেন, যেহেতু মসজিদটি আকারে ছোট, তাই এখানে একসঙ্গে বেশি সংখ্যক মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন না। আর বাইরে যেহেতু কোনো ছাদ দেওয়া নেই, তাই নামাজ পড়তে সমস্যা হয়। মসজিদটিকে যদি পাকা ছাদের কিংবা মজবুত শৈল্পিক বাহারি শেডের নিচে আনা যায়, তাহলে এখানে অনেক মানুষ নামাজ পড়তে পারবে এবং মসজিদটির সৌন্দর্যও অক্ষুন্ন থাকবে।

সা/ই

×