ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সময়ের পরিক্রমায় বিলুপ্তির পথে ঔষধি গাছ ভেন্না

আরএম সেলিম শাহী, ঝিনাইগাতী, শেরপুর।

প্রকাশিত: ১৪:৫৪, ১৯ মে ২০২৫

সময়ের পরিক্রমায় বিলুপ্তির পথে ঔষধি গাছ ভেন্না

একসময় শেরপুরের ঝিনাইগাতীর জনপদে জাদুকরী ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ ভেন্না গাছ সচরাচর চোখে পড়লেও সময়ের পরিক্রমায় বিলুপ্তির পথে এই গাছ। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের নানা চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি মানবদেহের নানা রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই ভেন্না গাছ ও তার ফল থেকে তৈরি তেল।

তাই তো পল্লীকবি জসীম উদ্দীন তাঁর এক বিখ্যাত কবিতায় এভাবেই তুলে এনেছিলেন ভেন্না গাছের কথা।“আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,/ রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।/ বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি/ একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।”

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই জনপদের বনে-বাদাড়ে, পথের ধারে, পুকুরপাড় ও বাড়ির আঙিনায় একসময় দেখা যেত ঔষধিগুণে সমৃদ্ধ ভেন্না গাছ। এই অঞ্চলের মানুষের নানা অসুখ-বিসুখে ভেন্না গাছের পাতা ও তার ফল থেকে তৈরি তেল ব্যবহার করা হতো।

আধুনিকায়ন আর আধুনিক চিকিৎসার উৎকর্ষে ভেন্না গাছসহ নানারকম ঔষধি উদ্ভিদ ও গাছ পরিবেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে।

এলাকার স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, পরিবেশবান্ধব ও ঔষধি গাছ ভেন্না মানুষের শরীরের কাটা অংশ জোড়া লাগাতে, চুল পড়া রোধে, মুখের রুচি বাড়াতে, শরীরের বাতব্যথায়, ক্ষত সারাতে ও দাঁত এবং মাড়ির যেকোনো সমস্যায় যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে আসছে। এ ছাড়া ভেন্না গাছের ফলের বীজ থেকে তৈরি তেলে রয়েছে জাদুকরী ঔষধি ক্ষমতা। একসময় বাড়ির বা বাড়ির পাশের ক্ষেতখামারে বেড়া স্থাপনেও এই ভেন্না গাছ ব্যবহার করা হতো।

এদিকে ইউনানি চিকিৎসকরা জানান, মানবদেহের নানা রোগে ভেন্না গাছের পাতা ও বীজ থেকে তৈরি তেল প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চোখ ওঠায় ভেন্না পাতার রস হালকা গরম করে ছ্যাঁকা দিলে অল্প সময়েই আরোগ্য পাওয়া যায়। পেটে ব্যথা হলে ভেন্নার কচি পাতা পানিতে সেদ্ধ করে পরিমাণমতো খেলে পেটব্যথা সেরে যায়, এতে মাথাব্যথাও সেরে যায়। রাতকানা রোগে ১০ থেকে ১৫ গ্রাম ভেন্না পাতা ঘিয়ে ভেজে বা যেকোনো শাকের সঙ্গে ভেজে খেলে তা কমে যায়।

মহিলাদের রক্তস্রাবের কারণে তলপেটে ব্যথা নিরাময়ে ভেন্না পাতা গরম করে তলপেটে ছ্যাঁকা দিলে ব্যথা সেরে যায় এবং এভাবে দু-একদিন ব্যবহারে এ থেকে নিরাময় মেলে। এ ছাড়াও ভেন্না গাছের মূলের ছাল ও হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে ব্যবহারে খোসপাঁচড়া তাড়াতাড়ি সেরে যায়। প্রস্রাব কমে যাওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে ভেন্না গাছের কাঁচা ছাল পানিতে সেদ্ধ করে পরিমাণমতো খেলে প্রস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে ভেন্নার বীজ থেকে তৈরি তেল গরম করে বিষফোঁড়ার ওপর লাগালে ফোঁড়া পেকে ফেটে যায়, এতে ব্যথা উপশম হয় ও রোগ থেকে আরোগ্য মেলে। সায়াটিক বাতের ক্ষেত্রে ভেন্নার বীজ বেটে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে এ রোগ থেকে আরোগ্য পাওয়া যায়। শরীরের পোড়া ক্ষতের মধ্যে ভেন্না তেল ব্যবহার করলে রোগীর জ্বালাপোড়া কমে যায় এবং কয়েকদিন ব্যবহারে এর থেকে আরোগ্য মেলে।

এ ছাড়াও ভেন্না গাছের পাতা, পাতার রস ও বীজ এবং বীজ থেকে তৈরি তেল মানুষের আরও অনেক রোগ নিরাময়ে আদিকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

ঝিনাইগাতী উপজেলার স্বনামধন্য হেকিম আবদুল কুদ্দুস বলেন, ভেন্না গাছ ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ একটি গাছ। প্রাচীনকাল থেকেই ইউনানি চিকিৎসায় এই গাছটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ভেন্নার বৈজ্ঞানিক নাম Ricinus communis। ভেন্নার তেলের অপর নাম ক্যাস্টর অয়েল বা বেড়ির তেল। ভেন্না গাছের চারা দেখতে অনেকটা পেঁপে গাছের চারার মতো। এ গাছ একসময় এমনি এমনিতেই গ্রামীণ পরিবেশে জন্মাত।

সময়ের পরিক্রমায় আর ভেষজ চিকিৎসার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যাওয়ায় ঔষধি গাছ ভেন্নাসহ নানা ধরনের ঔষধি উদ্ভিদ ও গাছ পরিবেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে। ইউনানি চিকিৎসাও এক ধরনের বিজ্ঞান। এই চিকিৎসা ব্যবস্থাকে প্রাচীনকালের মতো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে আমাদের সকলকে ঔষধি উদ্ভিদ ও গাছের পরিচর্যা করতে হবে।

আফরোজা

×