
ছবি: দৈনিক জনকন্ঠ
শুষ্ক মৌসুমে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার নীতি মরুকরণ প্রক্রিয়ার কু-প্রভাবে পানিশূন্য প্রায় হুরাসাগর, যমুনা, করতোয়া, বড়াল, গোহালা, ধলাই, চাকলাইসহ শাহজাদপুরের নানা নদ-নদী!
শাহজাদপুর উপজেলার পোরজনা ইউনিয়নের পোরজনা বাজার সংলগ্ন হুরাসাগর নদ থেকে ভারতের কোলকাতায় সরাসরি জাহাজ চলাচল করতো। বর্তমানে সেখানে ডিঙি নৌকাও চলার মতো সচল নৌপথ অবশিষ্ট নাই। বর্তমানে হুরাসাগর নদের মতো নানা নদ-নদীর বুকে মাইলের পর মাইল জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ বালুর চর। ওইসব চরে চলছে নানা ফসলের চাষাবাদ। বাংলাদেশের উজানে নানা স্থানে ভারত বাঁধ, ক্রসবাঁধ, ড্যাম, রাবার ড্যাম নির্মাণ করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় মিনি মরুভূমিতে ক্রমেই পরিণত হতে চলেছে শাহজাদপুরসহ নদীমাতৃক দেশের নানা অঞ্চল। ফলে সরাসরি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষি, মৎস্যসহ পানি নির্ভর নানা খাত; যা ক্ষতিগ্রস্ত করছে জাতীয় অর্থনীতিকে। শুষ্ক মৌসুমে ওইসব নদ-নদীর বুকে প্রয়োজনীয় পানির ঘাটতি ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশকে করছে ভারসাম্যহীন। এসব কারণে নানা নদ-নদীগুলোর গতি প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটছে। আমরা হারাতে বসেছি আমাদের অনেক গ্রামীণ ঐহিত্য। আবহমান গ্রাম বাংলায় গ্রামীণ জনপদের মানুষের প্রিয় সুস্বাদু নানা দেশী প্রজাতির মাছ এখন সোনার হরিণের মতো! পানির উৎস শুকিয়ে দেশীয় নানা জাতের মাছের উপযুক্ত প্রজননক্ষেত্র বিলুপ্তপ্রায় হওয়ায় 'মাছে ভাতে বাঙালি' কথাটি দিনে দিনে কল্প বাক্যে পরিণত হচ্ছে। এখন আর দেখা জায়না গ্রামীণ ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ নৌকা বাইচ, খরা জাল, সূতি ফাঁদ, সেচের মাধ্যম দাঁড়। মৎস্য ভাণ্ডার সংকুচিত বা শুকিয়ে যাওয়ায় অনেক মৎস্যজীবী বর্তমানে বেকার। আবার অনেকেই পেশার পরিবর্তন করেছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, এক সময়ের প্রবলা, প্রমত্তা, প্রগলভা, সমুদ্রের যোগ্য সহচরী পদ্মা, যমুনা, করতোয়া, বড়াল, হুরাসাগর, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুড়, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোট যমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাইসহ এ অঞ্চলের নদ-নদী শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই মরা খালে পরিণত হয়েছে। নদ-নদীগুলো পানি প্রবাহ এলাকা শুকিয়ে নদী বক্ষে মাইলের পর মাইল বিরাজ করছে ধুঁ-ধুঁ বালুচর। ভারতের মেরুকরণের প্রক্রিয়ার যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে শাহজাদপুরসহ উত্তরাঞ্চলের অসংখ্য নদ-নদী বক্ষে বর্তমানে পর্যাপ্ত পানি নেই। আর শাখা নদীগুলোর অবস্থা আরও করুণ। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে নেমে গেছে। ফলে এ অঞ্চলের সেচ কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।
'পাউবো' সূত্রে জানা গেছে, গত '১৯৫৪ ও '১৯৫৫ সালের ভয়াবহ বন্যার পর খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে ১৯৫৭ সালে জাতিসংঘের অধীনে ক্রুগ মিশন এর সুপারিশক্রমে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ইপিওয়াপদা) গঠন করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) ইপিওয়াপদা এর পানি উইং হিসাবে দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কৃষি ও মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রধান সংস্থা হিসাবে কার্যক্রম শুরু করে। স্বাধীনতার পর '১৯৭২ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-৫৯ মোতাবেক ইপিওয়াপদা এর পানি অংশ একই ম্যান্ডেট নিয়ে বাংলাদেশ বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাইবো) সম্পূর্ণ স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর পর্যায়ক্রমে সংস্কার ও পুনর্গঠনের ধারাবাহিকতায় জাতীয় পানি নীতি-১৯৯৯ ও জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা-২০০৪ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাপাউবো আইন-২০০০ প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের আওতায় এতদিন মন্ত্রী, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এর নেতৃত্বে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট পানি পরিষদের মাধ্যমে বোর্ডের শীর্ষ নীতি নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালিত এসেছে যা বর্তমানে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা দেখভাল করছেন।
তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ভারতের মরুকরণ প্রক্রিয়ার ফলে প্রতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে যৌবন হারিয়ে যমুনা, পদ্মা, করতোয়া, বড়াল, হুরাসাগর, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুড়, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোট যমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাইসহ উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়ে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অতীতের তুলনায় উদ্বেগজনক হারে নিচে নেমে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি শাখা নদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ার ফলে পর্যাপ্ত পানি প্রাপ্তি ব্যাহত হচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আগের তুলনায় অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় নদী তীরবর্তী অঞ্চলের গভীর-অগভীর নলকূপ থেকে পর্যাপ্ত পানি প্রাপ্তি ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। নদী নির্ভর এ অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির অপরিকল্পিত ও অতিমাত্রায় ব্যবহার এবং সেচ কাজে পানির অপচয় রোধ করা না গেলে বাংলাদেশ এক মহাসংকটের মুখোমুখি হবে বলে পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি উচ্চরণ করেছেন। এ অঞ্চলের এক সময়ের ভয়াল, উত্তাল অনেক নদী ও শাখানদী বক্ষে বর্তমানে পর্যাপ্ত পানি আর দেখা যাচ্ছে না। নাব্যতা সংকট, বাস যোগ্য পানি ও প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজ করায় এ অঞ্চলের নানা নদ-নদী থেকে অর্ধশতাধিক দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্তি’র পথে! এসব কারণে এ অঞ্চলের নদী নির্ভর কৃষক ও এলাকাবাসীর বুকভরা আশা ক্রমশ হতাশায় পরিণত হচ্ছে। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে এসব নদ-নদী বক্ষে প্রয়োজনীয় পানি না থাকায় একদিকে যেমন নৌ-চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে, অন্যদিকে জাতীয় অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। প্রতি বছরের শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই এ অঞ্চলের স্রোতস্বিনী যমুনা, পদ্মা, করতোয়া, বড়াল, হুরাসাগর, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুড়, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোট যমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাইসহ উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী ও এর শাখা প্রশাখাসহ খাল-বিল শুকিয়ে যায়। ফলে নদ-নদী বিধৌত উত্তরাঞ্চল বাসির শুরু হয় দুঃখ দুর্দশার পালা। প্রকৃতি নির্ভর কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা কালের আবর্তনে সময়ের পরিধিতে ক্রমেই মিনি মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। দু’চোখ নদী বক্ষের যেদিকে যায় সেদিকেই দেখা যায় ধূঁ-ধূঁ বালুচর। প্রতিবেশী দেশ ভারত নদ-নদীগুলোর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করে দেওয়ায় সুজলা-সুফলা, শস্য শ্যামলা বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে মরু অঞ্চলে পরিণত হতে চলেছে।
পানিসম্পদ বিষয়ক গবেষকদের মতে, ‘ভারতের মরুকরণ প্রক্রিয়ায় যমুনা, করতোয়া, বরাল, হুরাসাগর, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুড়, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোট যমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাইসহ নান নদ- নদীর পানির স্তর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরেরও নিচে নেমে গেছে। সরাসরি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অসংখ্য শাখা নদ-নদী ও খালবিলে। এ দুরবস্থার আরও একটি কারণ হচ্ছে, যমুনা নদী অববাহিকায় অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে অতিমাত্রায় গভীর-অগভীর নলকূপের ব্যবহার। ফলে, নদী নির্ভর ওইসব অঞ্চলে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি, মৎস্যসহ প্রকৃতি নির্ভর নানা খাত।’
বিজ্ঞ মহলের মতে, ‘শাহজাদপুরসহ উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ভারতের মরুকরণ প্রক্রিয়া। দেশের পানি হিস্যা আদায়ে বহুমুখী পরিকল্পনা ও কর্মপন্থার কথা বলা হলেও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য সাড়া মেলেনি আজও। তাই আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করে যদি ২০০ নটিক্যাল মাইল সমুদ্রসীমা অর্জন সম্ভব হয়; তাহলে কৃষিপ্রধান এ দেশকে রক্ষায় কেন আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে মামলা দায়ের করে দেশের নানা নদ-নদীর বুকে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ কেনো নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না? এজন্য সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলে অতীতের মতো আবারও ফিরে পেতে পারে নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রাণ ও হারানো গৌরব-ঐতিহ্য।'
মিরাজ খান