
নাজিয়া বেগম ও রিন্টু হাওলাদার দম্পতির জীবিকার চাকায় গতি নেই। আগেই অচল হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এখন থমকে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। যেন দুচোখে সর্ষেফুল দেখছেন। অভাবের তাড়নায় দিশেহারা হয়ে গেছেন। পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে ইসা, মেয়ে প্রথম শ্রেণির ইভা ও আট মাস বয়সী ইমামকে নিয়ে পাঁচ জনের সংসারে দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের যোগান দেওয়ার চিন্তায় বিনিদ্র রাত কাটে এ দম্পতির।
স্বামী রিন্টু হাওলাদার কোনো উপায় না পেয়ে এখন মাছ কিনে বিক্রি করতে পারলে সংসারের চাকা ঘোরে, নইলে উপোস করতে হয়। চোখেমুখে বিরাজ করছে হতাশার ছাপ। বৃহস্পতিবার তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে কথা হয় অসহায় নাজিয়ার সঙ্গে।
নাজিয়া জানান, তাদের ছিল অন্তত ২০ বছরের সাজানো সংসার। টিনশেড ঘর। সামনে পেছনে পুকুর ছিল। মাছ চাষ করতেন। জমি যেটুকু ছিল তার ফলন থেকেই সারা বছরের খোরাকির চাল সংগ্রহ করতেন। মাছেভাতে ছিল পরিপূর্ণ। সন্তানদের লেখাপড়া করানো। সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। এখন সর্বস্বহারা হয়ে গেছেন।
আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের অধিগ্রহণের আওতায় পড়ে নাজিয়া-রিন্টু দম্পতি এভাবে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। কী করবেন তাও জানা নেই। ছাড়তে হবে জেনেও ঘরটিতেই বাধ্য হয়ে এখনো থাকছেন। পাঁচজুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা এ দম্পতি। এরপরের গন্তব্য পর্যন্ত জানেন না। ঘরটির চারদিকে এখন বালির আস্তরণে সব ঢাকা পড়ে গেছে। থাকছেন বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায়। সবুজে ঢাকা ছিল তিন বছর আগেও। এখন নিজের কাছেই চিরচেনা বাড়িঘর আশপাশ সব অচেনা মনে হয়। গাছগাছালি অনেক আগেই কাটা পড়েছে। পুরনো তিনটি নারকেল গাছ কাটা না পড়ায় সাক্ষ্য দিচ্ছে বাড়িঘর কতটা পুরনো।
জানালেন নাজিয়া, জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ নয় লাখ টাকা পেয়েছেন। তা স্বামী রিন্টু বিদেশ যাওয়ায় দেনা করতে হয়েছে, তা শোধ করেছেন। ভাগ্য যেন এ দম্পতির উল্টো দিকে ঠেলছে। কারণ, কর্মসংস্থানে বিদেশ গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আবার রিন্টুকে দেশে ফেরত আসতে হয়েছে। এখন চিকিৎসা পর্যন্ত চলছে না। ঠিকমতো কাজকর্ম করতে পারেন না। অনেক আকুতি করেছিলেন, তাদের ঘরটির ক্ষতিপূরণ যেন দেওয়া হয়।
সবাইকে ঘরের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও এ দম্পতির নামটি বাদ পড়েছে। নাজিয়া এ জন্য বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের রাব্বানী সাহেবকে দুষছেন। কবে বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট হবে, আদৌ হবে কি না তা নিশ্চিত করে কেউ জানে না। অথচ রিন্টু-নাজিয়া দম্পতিসহ ২৭৫ পরিবারের প্রায় ১০০০ একর তিন ফসলি কৃষি জমি হাতছাড়া হয়ে এখন বালুর নিচে চাপা পড়েছে।
এ দম্পতি জানালেন, আমন-আউশসহ রবিশস্য, কোনো না কোনো ফসল থাকত জমিতে। আর এখন সব মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। কোনো আবাসন পুনর্বাসনের আওতায় না পড়ায় এই দম্পতি এখন একেবারে আশ্রয়হারা হওয়ার আশঙ্কায় বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন। বিগত সরকারের উচ্চবিলাসী প্রকল্প কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য এভাবে আশ্রয়হারা হচ্ছেন এই দম্পতি।
তাদের সাজানো-গোছানো জমি-জিরেত, ঘরবাড়ি, মাছ চাষের পুকুর হারিয়েছেন। গবাদিপশু পালনসহ উপার্জনের সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। তিন সন্তানকে নিয়ে নাজিয়া যেন অসহায়ত্বের বোঝার চাপে এখন স্বাভাবিক কথা পর্যন্ত বলতে পারছেন না। বললেন, ‘মোর তিন সন্তান নিয়া কই যামু জানি না। কামাই নাই। কীভাবে সংসার চলবে তাও জানি না।’ একরাশ চরম হতাশায় নাজিয়া প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে এসব বলছিলেন, তার আকুতি যদি তার একটু আশ্রয় জোটে কোথাও।
ঘরটির ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা ও আবাসন সুবিধা কেউ করতো তাইলে সন্তান তিনটি নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু জুটতো। পরিবেশ বিনাশী প্রকল্পের কারণে এসব নাজিয়ারা স্বামী-সন্তান নিয়ে এখন যে কোনো সময় উদ্বাস্তুর তালিকায় যুক্ত হয়ে যাবেন,এমন শঙ্কা পরিবেশ কর্মীদের। স্থানীয়রা জানান, ২০২১ সাল থেকে তাদের সাজানো-গোছানো সংসার উন্নয়ন নামের বুলডোজার তছনছ করে দেওয়ার তাণ্ডব শুরু হয়। এখনো থামেনি এর দাবানল। মানবিক বিবেচনায় এ দম্পতি ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসন চেয়েছেন।
আফরোজা