ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কৃতজ্ঞ ঢাবি প্রশাসনের কাছে

টিএসসিতে দোকান, স্বপ্নপূরণ তৃতীয় লিঙ্গের প্রিয়ার

মোতাহার হোসেন

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ২০ অক্টোবর ২০২৪

টিএসসিতে দোকান, স্বপ্নপূরণ তৃতীয় লিঙ্গের প্রিয়ার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে চা বানাতে ব্যস্ত তৃতীয় লিঙ্গের প্রিয়া খান

সচ্ছল পরিবারের সন্তান প্রিয়া খান- তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) হওয়ায় অল্প বয়সেই ঘর ছাড়তে বাধ্য হন। পরে বেড়ে ওঠেন গুরুমার কাছে। তার বর্তমান ঠিকানা রাজধানীর চাঁনখারপুলে। রাস্তাঘাটে, গণপরিবহনে যেখানে অন্য হিজড়ারা জবরদস্তি করে মানুষের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন, সেখানে ব্যতিক্রম প্রিয়া খান।  
ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন স্বাবলম্বী হওয়ার। সাধারণ মানুষের মতো বাঁচার। কিন্তু হিজড়া বলে সমাজ তাকে সে সুযোগ দেয়নি। তবে, তার পাশে দাঁড়িয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাদের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) একটি চায়ের দোকান বসাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। তবে, এ দোকান বসাতেও তাকে করতে হয়েছে অমানবিক পরিশ্রম। অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ৯টি বছর।   
জানা যায়, ঘর ছেড়ে প্রিয়া বাঁচার তাগিদে  হাত পাতেন মানুষের দ্বারে দ্বারে। এই সুবাদে ২৩ বছর ধরে তার সম্পর্ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। প্রতিদিন সালাম দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে সাহায্য চান। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও হাসিমুখে তাকে সহায়তা করেন। কিন্তু এ পেশা কখনোই তার ভালো লাগত না। এক সময় ছুটতে থাকেন চাকরির জন্য। কিন্তু সে-ই সুযোগ হয়ে ওঠেনি। একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি হলেও তার হিজড়া পরিচয় জানার পর না করে দেওয়া হয়। অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে দোকান বসানোর মনস্থির করেন তিনি। এই কাজে তার সঙ্গী হন তৃতীয় লিঙ্গের আরেক মানুষ নদী হিজড়া। কিন্তু দোকান বসানোটা তো এত সহজ নয়! 
একদিকে, বাধা হয়ে দাঁড়ায় ছাত্রলীগ। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দীর্ঘদিন ঘুরেও কোনো দোকান বসাতে পারেননি। এক পর্যায়ে যোগাযোগ করেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরও জীবন ধারণের জন্য তার এমন এ উদ্যোগকে স্বাগত জানান। কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গের হওয়ায় তিনিও সুযোগ দিতে সাহস পাননি। 
একদিন-দু’দিন করে দিন যায়, প্রক্টরের পর প্রক্টর আসেন কিন্তু প্রিয়ার ভাগ্য বদলের সুযোগ আসেনি। তবুও আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিছুদিন পর পর দাবি নিয়ে যেতেন প্রক্টর অফিসে। অবশেষে তার ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর। পরিবর্তন এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করেই শুরু করে নতুন প্রশাসন। সিদ্ধান্ত হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো দোকানে কেউ চাঁদাবাজি করতে পারবে না। টিএসসিতে দোকান থাকবে ১০টি।

এমন খবরে ফের আবেদন করেন প্রিয়া খান। তবে, প্রক্টর অফিসের কর্মকর্তারা শুরুতে পাত্তা দিচ্ছিলেন না। এ সময় তার পাশে এসে দাঁড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির এক সদস্য। তার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় প্রিয়ার। প্রশাসনও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। পরে মানবিক বিবেচনায় ১১তম দোকান হিসেবে টিএসসিতে একটি দোকান বসানোর সুযোগ হয় প্রিয়া খানের। সেই দোকানে এখন নানান স্বাদের চা তৈরি হচ্ছেÑ লেবু, মাল্টা, তেঁতুল, দুধ ও ঝাল মরিচের চায়ের পাশাপাশি কফিও বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। ভাগ্য ফিরতে শুরু করেছে প্রিয়া খানের।

প্রিয়া খান বলেন, প্রায় দুই যুগ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। মাঝে আমার একটি চাকরি হয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ যখন জানতে পারে আমি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, তখনই আমার চাকরিটি চলে যায়। আমি সামর্থ্যবান একজন মানুষ। আমি কেনো অন্যের কাছে হাত পেতে সাহায্য নেব। এ জীবন থেকে মুক্তি চাচ্ছিলাম। টিএসসিতে একটি দোকান বসানোর জন্য অনেকের হাত-পা ধরেছি। ৯ বছর চেষ্টার পর দোকান পেয়েছি। এটি পাওয়ার পেছনে অনেকের অবদান আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রক্টরসহ এক সাংবাদিক ভাইয়ের কথা না বললেই নয়। সেই ভাই যিনি আমাকে আবেদন লেখা থেকে শুরু করে জমা দেওয়া, প্রক্টর, ভিসি অফিসে পৌঁছতে সহায়তা করেন।

তবে, তিনি তার নামটি বলতে নিষেধ করেছেন। এ ছাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও পাভেল ভাই আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমি একটি দোকান পেয়েছি। আজ আমি আর কারও কাছে হাত পাতি না। এই দোকান ঘিরেই আমার স্বপ্ন। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। 
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন মহতী কাজে ভূয়সী প্রশংসা করছেন ঢাবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাদের মতে, হিজড়ারাও মানুষ। তাদেরও বাঁচার অধিকার আছে। 
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার প্রশংসা কুড়িয়েছেন প্রিয়া খান। অন্য সময়ের চেয়ে ওই সময় গাড়িভর্তি লাশ এসেছে। তবে, তা নামিয়ে স্ট্রেচারে করে হাসপাতালের নিয়ে যাওয়া, ভর্তি করা, ওষুধ ও রক্তের ব্যবস্থা করা, মরদেহগুলো নির্দিষ্ট স্থানে রাখাÑ এমন কাজের জন্য হাসপাতালে পর্যাপ্ত লোকবল ছিল না। এমন দৃশ্য ব্যথিত করে প্রিয়া খানকে। এক সময় শাহবাগ থানার হিজড়া কমিউনিটির সদস্য তৃতীয় লিঙ্গের মুক্তা, নদী, বৈশাখী, মুগ্ধ ও হাবিবাকে নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৬ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন তারা নিরবছিন্ন কাজ করে গেছেন।
প্রিয়া খান বলেন, আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে অনেক ছাত্র, জনতা, নারী শিশু ঢাকা মেডিক্যালে আসছিল। এসব কাজের জন্য পর্যাপ্ত লোক ছিল না। পরে গুরু মাকে বললাম, আমরা তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের সাহায্য নিয়ে চলি। তাদের বিপদ মানে আমাদেরও বিপদ। এখন তাদের পাশে দাঁড়ানোর দরকার। গুরুমার অনুমতি নিয়ে আমি কাজ শুরু করি। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের বাধা দেয়। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডাও হয়। প্রথমে স্ট্রেচার ধরা শুরু করি। পরে আহত ও মৃত মানুষদের বহন করেছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফুদ্দীন আহমদকে সামগ্রিক বিষয়ে বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের হওয়ায় তারা কোনো কাজ পাচ্ছিল না। যখন আমাদের দ্বারস্থ হলেন তখন মানবিক বিবেচনায় ইচ্ছে হলো তাদের জন্য কিছু করার। তাদের এই অবস্থার জন্য তারা দায়ী নন। আমার যেহেতু তাদের জন্য কিছু করার সুযোগ আছে তাহলে আমি কেনো সেই কাজটি করব না। তারা নানান জায়গায় মানুষের কাছে চেয়ে খায়। এটিকে অনেকে চাঁদাবাজি মনে করেন। কিন্তু তারা এটি করতে বাধ্য হন। কারণ, তাদের কিছু করার সুযোগ নেই। সমাজের উচিত এসব মানুষের পাশে থাকা।

×