ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৫ মে ২০২৪, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

নিয়ন্ত্রণে সুন্দরবনের আগুন, তদন্ত কমিটি গঠন

স্টাফ রিপোর্টার, বাগেরহাট

প্রকাশিত: ২১:০১, ৫ মে ২০২৪

নিয়ন্ত্রণে সুন্দরবনের আগুন, তদন্ত কমিটি গঠন

সুন্দরবনের আগুন

বাগেরহাটের সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধারা স্টেশনের আমরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির অদূরে লতিফের ছিলা নামক স্থানে আগুনে প্রায় দেড় কিলোমিটার পুড়েছে। 

রবিবার (৫ মে) ভোর থেকে ফের আগুন নেভাতে বনরক্ষী, স্বেচ্ছাসেবক ও স্থানীয়দের সাথে নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের  ৫ টি ইউনিট সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। তাদের পাশাপাশি কোস্টগার্ড, নৌবাহিনীর দুটি দল এবং বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার যোগ দেয়। এদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্নস্থানে বিক্ষিপ্তভাবে আগুনের ধোঁয়ার কুন্ডলী উড়তে দেখা গেছে। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো জনকণ্ঠকে জানান।  

তিনি বলেন, ‘সর্বাত্মক চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। আগুনের সূত্রপাত হবার পর চারপাশে ফায়ার লাইন কেটে আগুন নিয়ন্ত্রনে রাখা হয়। বনরক্ষী, স্বেচ্ছাসেবক, কমিউনিটি পেট্রোলিং গ্রুপ, ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম ও স্থানীয়দের সাথে নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের  ৫ টি ইউনিটসহ কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর টীম আগুন নির্বাপনে কাজ করছে। এসময় একটি হেলিকপ্টার থেকেও পানি ফেলা হয়।’

তাঁর ভাষায়, আগুন নিয়ন্ত্রণ আসলেও আগামী কয়েক দিন এখানে অগ্নি নির্বাপন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম চলমান থাকবে। কেননা ফরেস্ট ফায়ার আপাতত নিভে গেছে বা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে মনে হলেও আবার যে কোন সময় এটি নতুনভাবে জ্বলে বিস্তৃতি লাভ করতে পারে। সুন্দরবন লোকালয়সংলগ্ন নদী এবং খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় নিয়মিত জোয়ারের পানিতে বনভূমি প্লাবিত না হওয়ায় এর আগেও বিভিন্ন সময় এই এলাকায় আগুনের ঘটনা ঘটেছে। 

এখানে মাটির উপর কয়েক ইঞ্চি পুরু জৈব পদার্থ (লতাপাতা ও ডাল-পালা) মজুদ হয়ে আছে। কাজেই এই তীব্র গরমে সেখানে নিচের দিকে মিথেন গ্যাস মজুদ হয়ে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। আবার লোকালয়সংলগ্ন হওয়ায় কোন ব্যক্তি বনে প্রবেশ করলে তার বিড়ি বা’ সিগারেটের আগুন থেকে সূত্রপাত হতে পাবে। এছাড়া, মধু আহরণের মৌসুমি হওয়ায় মৌয়ালদের মৌচাক ভাঙ্গার আগুন থেকেও আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।’ 

তাছাড়া দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় শুকনো ডালের ঘর্ষনেও আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। তবে আগুন লাগার সঠিক কারন এখনো আইডেন্টিফাই করা যায়নি। এজন্য এবং ক্ষয়ক্ষতি নিরুপনে বন বিভাগের ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।’

রবিবার প্রধান বন সংরক্ষক মোঃ আমীর হোসাইন চৌধুরী, বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মোহা: খালিদ হোসেন এবং পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত খান (পিপিএম) ঘটনা স্থল পরিদর্শন করেছেন। তাঁরা বলেন, আগুন লাগার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট মুনতাসীর ইবনে মহসীন বলেন, আগুন নেভানোর কাজে সহযোগিতার জন্য সকাল থেকে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর দুটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করে।’

বাগেরহাট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক মামুন আহমদ জানান, রাতে বনের মধ্যে কাজ করা সম্ভব না হলেও ভোর থেকে ৫ টি ইউনিট অগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের বিভাগীয় কর্মকর্তারাও আসেন।’

ঘটনাস্থল থেকে স্থানীয় নিশানবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম বলেন, শনিবার দুপুরে আগুন লাগার খবর পেয়ে আমি তাৎক্ষনিক ২/৩ শত লোক নিয়ে বনে যাই এবং বনকর্মীসহ আমরা সবাই মিলে আগুন নেভাতে চেষ্টা করি। এসয়য় ঊর্ধ্বতন বন কর্মকর্তাদের খবর দেওয়া হয়। তারা ঘটনা স্থলে আসেন। আনুমানিক ১০/১২ একর জায়গা জুড়ে আগুন জ্বললেও এর ব্যপ্তি দেড় কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে। আগুন লাগা স্থানটি ঘুরে আসতে আমার প্রায় আধাঘন্টা সময় লেগেছে। 

গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত আগুন যেখানে ছিল, তা আরও নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। একটি নালা এবং প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের ভোলা নদী থেকে পানি এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। দ্বিতীয় দিনেও ফায়ার সার্ভিস ও বনকর্মীদের সাথে আমরা স্থানীয় লোকজন কাজ করছি। শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় আগুন নেভাতে খুব বেগ পেতে হয়। বনের শুকনো পাতায় আগুন দ্রুত ছড়ায়।’’

মোরেলগঞ্জ উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউপি সদস্য আবু তাহের মিয়া বলেন, ‘আমুর বুনিয়া ফাঁড়ির কাছেই আগুন লেগেছে। বেশ বড় এলাকা। আগুন যে পর্যন্ত ছিল, রাতে তা আশপাশে আরও ছড়িয়েছে। প্রায় দেড়/দুই কিলোমিটার এলাকা হবে। সবাই চেষ্টা করেছি নেভাতে। বেশ কিছু গাছপালা, লতাগুল্ম পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুন লাগা বনাঞ্চলের ওই এলাকায় মূলত বলা, সুন্দরী, বাইন, গেওয়া, জিন, সিংড়াসহ বিভিন্ন ধরনের লতাগুল্ম জাতীয় গাছ রয়েছে।’

সুন্দরবনের আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির বনকর্মী মনিময় মন্ডল জনকণ্ঠকে বলেন, বনের লতিফের ছিলা নামকস্থানে প্রথম আগুনের সূত্রপাত হয়। শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় তা দ্রুত বনের শুকনো লতাপাতায় ছড়িয়ে পড়ে। আমরা বনরক্ষীরা সাথে সাথে স্থানীয় এলাকাবাসীদের সহযোগীতায় আগুন নেভাতে সাধ্যমত চেষ্টা করি। বনের একটি বড় এলাকা জুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে আগুন জ্বলে।’

পশ্চিম আমুরবুনিয়া গ্রামের কৃষক ও বাওয়ালী পিন্টু মিস্ত্রি জনকণ্ঠকে বলেন, আমার বাড়ির পূর্বদিকে বনের ২ থেকে আড়াই কি:মি: দূরে বনের মধ্যে শনিবার দুপুরে আগুনের সুত্রপাত হয়। বর্তমানে মধু আহরণের মৌসুম চলছে। মধু সংগ্রহ করতে ওই স্থান থেকে মধু সংগ্রহকরীরা বনে যায়। ধারণা করছি তাদের ফেলে দেওয়া আগুনের সলতে (মশাল) থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় পানির সংকটের কারনে আগুন নেভাতে কষ্ঠ হচ্ছে।’

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ নুরুল করিম বলেন, আগুন লাগার খবর পরে বনকর্মীরা স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেছে। ফায়ার সার্ভিসের একাধিক ইউনিট পৌচেছে। আমিও ঘটনাস্থলে আছি। রাতে কাজ বন্ধ থাকলেও খুব ভোর থেকে আবার আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। 

তবে কি কারণে আগুন লেগেছে বা কি পরিমাণ জায়গা আগুন ছড়িয়েছে সে বিষয়ে জানতে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) রানা দেবকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন- রেঞ্জের জিউধার স্টেশন কর্মকর্তা (এসও) ওবায়দুর রহমান এবং ধানসাগর স্টেশন কর্মকর্তা (এসও) রবিউল ইসলাম।

কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে আগুন লাগার সঠিক কারণ ও ক্ষক্ষতি নিরুপনসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।’ তাছাড়া, এ ব্যাপারে স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া নানামুখী তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আশা করি সঠিক তথ্য জানা যাবে।’

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মোরেলগঞ্জ স্টেশনের স্টেশন কর্মকর্তা আবুল ফারুখ বলেন, ‘আগুন নিভাতে আমাদের বিভিন্ন স্টেশনের ৫০ জন কর্মী এবং ২৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক রবিবার সকাল থেকে ফের কাজ শুরু করেছে। পাম্প মেশিন, ফায়ার হোজ পাইপসহ সব মালামাল নিয়ে আসা হয়েছে। কাছের পানির উৎস ভোলা নদী থেকে আগুনের স্থান প্রায় দুই কিলোমিটার ভেতরে। এজন্য বেগ পেতে হচ্ছে।’

স্থানীয় বাসিন্দা ও চাঁদপাই রেঞ্জের পূর্ব আমোরবুনিয়া ভিলেজ কনজারভেশন ফোরামের সম্পাদক মহিদুল হাওলাদার বলেন, ‘রাতে আগুন আরও বাড়ছে, সন্ধ্যা পর্যন্ত যতটুকু ছিল পাশের নতুন এলাকাও পুড়েছে। বেশ কিছু এলাকা একেবারে ছাই হয়ে গেছে। বাতাসের গতিতে কিছু কিছু এলাকায় আগুন লম্বা হয়ে ছুটছে। একটা হেলিকপ্টার এসে আগুনের এলাকার ওপর দিয়ে ঘুরেছে। তারাও পানি দেওয়া শুরু করেছে। এতে আগুন দমছে।’

এলাকাবাসী জানান, বনের ওই এলাকায় বন্য প্রাণীর চাপ বেশি। বাঘ, হরিণ, বানরসহ অনেক প্রাণীর বাস এখানে। বন থেকে লোকালয় কাছে হওয়ায় এবং সহজে বনে প্রবেশের সুযোগ থাকায় এখানে চোরা শিকারিদের বনে প্রবেশ সহজ। বনের ওই এলাকায় বর্ষা মৌসুমে মাছ শিকারের জন্য এর আগে আগুন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
শনিবার (০৪ মে) দুপুরে পূর্ব সুন্দরবনের আমুরবুনিয়া এলাকার লতিফের ছিলা নামক স্থানে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) রানা দেব জানান।

সর্বশেষ ২০২১ সালের ৩ মে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় আগুন লেগেছিল। এ নিয়ে গত ২৩ বছরে সুন্দরবনের ভোলা ও মরা ভোলা নদীসংলগ্ন ওই এলাকায় অন্তত ২৫ বার অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটল। এসব ঘটনায় প্রায় দেড়’শ একর বনভূমি পুড়েছে।

 

শহিদ

×