ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিলেট-৬

আওয়ামী লীগের লক্ষ্য জয় ধরে রাখা, পুনরুদ্ধারে মাঠে বিএনপি

সালাম মশরুর, সিলেট

প্রকাশিত: ০০:০৫, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আওয়ামী লীগের লক্ষ্য জয় ধরে রাখা, পুনরুদ্ধারে মাঠে বিএনপি

মাঠে ময়দানে চলছে নির্বাচনী আলোচনা

মাঠে ময়দানে চলছে নির্বাচনী আলোচনা। পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে কর্মী-সমর্থকরা এখন সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিভিন্ন সম্ভাব্য প্রার্থীর প্রচারে এলাকাবাসীর ব্যানারে প্রচারপত্র, পোস্টার সাঁটানো চলছে। অনন্য সৌন্দর্যময় নৈসর্গিক দুটি উপজেলা গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার নিয়ে গঠিত সিলেট-৬ আসন। দুই উপজেলাই প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে বেশ পরিচিতি রয়েছে। ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই এলাকায় রয়েছে কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র।

বিয়ানীবাজার শেওলা স্থলবন্দরের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা দেশের রাজস্ব খাতে অবদান রেখে চলেছে। গোলাপগঞ্জ নামের উৎপত্তি সম্পর্কীয়  ইতিহাস আজও রহস্যাবৃত। এ সম্পর্কে এখনো কোনো প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায়নি। অনেকের মতে, কোনো ব্যক্তি বিশেষের বিশেষ করে কোনো রাজা-বাদশাহ, স্থানীয় শাসকের নাম গোলাপগঞ্জ নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। 
অন্যদিকে বিয়ানীবাজার উপজেলার পূর্ব নাম ছিল পঞ্চখণ্ড। তৎকালীন সময়ে পঞ্চখ- গহীন জঙ্গল ও টিলা বেষ্টিত ছিল। সিলেটের প্রথম রায় বাহাদুর হরেকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর পুত্র কৃষ্ণকিশোর পাল চৌধুরী এখানে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হিংস্র জীবজন্তুদের ভয়ে লোকজন সকালবেলা বাজার শেষ করে নিজ নিজ আশ্রয়ে ফিরতেন। স্থানীয় ভাষায় বিয়ানবেলা এই হাট বসত। তাই এর নাম হলো বিয়ানীবাজার, যা কালের আবর্তনে বিয়ানীবাজার নাম ধারণ করেছে।
এই আসন থেকে একাধিকবার নির্বাচিত বর্তমান সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ ছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী। একজন ক্লিন ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবেও তার সুনাম রয়েছে। এই আসনে প্রবাসীদের দাপট রয়েছে। জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচন এলে প্রবাসীদের তৎপরতা দেখা যায়। কেউ কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে দেশে আসেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রবাসীরাও মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।  
গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার নিয়ে গঠিত সিলেট-৬ আসনের মোট ভোটার ৩ লাখ ৯৩ হাজার ১১৫ জন। পুরুষ ভোটার এক লাখ ৯৫ হাজার ৩৯৬ এবং নারী ভোটার এক লাখ ৯৭ হাজার ৭৪৬ জন। মোট কেন্দ্র ১৯১টি।  
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে একাধিক প্রবাসী মনোনয়নপ্রত্যাশী মাঠে রয়েছেন। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ছাড়াও আওয়ামী লীগের শক্তিশালী আরেক প্রার্থী হচ্ছেন কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সারওয়ার হোসেন। নির্বাচনী মাঠে এই দুই নেতার অবস্থানকে কেন্দ্র করে দলের নেতাকর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ক্ষমতায় থাকাকালে নিজে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু সেসময় তার আশপাশে থাকা  কিছু লোক সুবিধা নিয়েছেন। আর যারা সুবিধা পাননি আজ তারা তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।  
এ অংশের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, নুরুল ইসলাম নাহিদ এই আসন থেকে একাধিকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য হলেও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান এবং রাস্তাঘাটের খুব একটা উন্নয়ন হয়নি। প্রবাসী অধ্যুষিত হলেও প্রবাসীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী খুব একটা উন্নয়ন হয়নি। স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গেও তার কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। 
তবে এসব অভিযোগকে নিছকই মিথ্যা রটনা উল্লেখ করে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সমর্থকরা বলছেন, শিক্ষা ব্যবস্থাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে এই নির্বাচনী এলাকায় যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। একটা সময় বিদ্যুৎ  ও গ্যাসের যথেষ্ট সংকট থাকলেও এই অঞ্চলের মানুষকে এখন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকটে পড়তে হয় না বললেই চলে। কারণ বিয়ানীবাজার গ্যাসফিল্ড থেকে গ্যাস গোটা এলাকাতে বিতরণের ফলে রান্নায় গ্যাস ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছেন এলাকাবাসী। আর এসব উন্নয়নের রূপকারই হচ্ছেন নুরুল ইসলাম নাহিদ।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী নুরুল ইসলাম নাহিদ ছয় দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ ওই সময়কালের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।  
নুরুল ইসলাম নাহিদ ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে তিনি সিপিবির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৯৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগদান করেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তিনি ৬ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ ফোরাম সভাপতিম-লীর সদস্য ছিলেন।
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, পদ-পদবি বা নমিনেশনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত নেবেন, আমি সেটাই গ্রহণ করব। দেশ একটা উন্নয়নের গতিধারায় এগিয়ে যাচ্ছে এটা শুধু আমরা নয়, সারা দুনিয়া স্বীকার করছে। কে ক্ষমতায় গেল না গেল সেটা আসল নয়, তার চেয়ে বড় হচ্ছে লক্ষ্যটা কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশটা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
এদিকে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে মনোনয়ন যুদ্ধে নুরুল ইসলাম নাহিদ ছাড়াও একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। ইতোমধ্যে তাদের অনেকেই প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। নতুন মনোয়নপ্রত্যাশীরা দলীয় বলয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সাধারণ ভোটারদের নিয়ে উঠান বৈঠকসহ সভা-সামবেশ করে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাদের অনুসারীরা প্রচার চালাচ্ছেন। 
আগামী নির্বাচনে এই আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা সারওয়ার হোসেন এখন মাঠে সক্রিয়। তিনি ২০০৮ সাল থেকে এই আসনে নৌকার মনোনয়ন চেয়ে আসছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। সারওয়ার হোসেন কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বিগত ১৫ বছর ধরে তিনি এলাকায় সক্রিয় রয়েছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে একের পর এক সভা-সমাবেশ এবং নিজ এলাকার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করে আসছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তার ব্যাপক প্রচার লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সারওয়ার হোসেন বলেন, ২০০৮ সাল থেকে এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে আছি। মন্ত্রী-এমপি না হওয়া সত্ত্বেও এলাকার মানুষ আমাকে মূল্যায়ন করে ঋণী করে রেখেছেন। শেষ জীবনটা তাদের পাশেই থাকতে চাই।
অন্যদিকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জোটের শরিক জামায়াতকে আসনটি ছেড়ে দিলেও এবার ছাড় দিতে রাজি নয় বিএনপি। এজন্য অনেকটা প্রস্তুতি নিচ্ছেন দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা। বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী শামীম, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী ও সিলেট জেলা বিএনপির সদস্য ফয়সল আহমদ। 
একাদশ সংসদ নির্বাচনে এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন জেলা ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক ফয়সল আহমেদ। নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পেয়েছিলেন এক লাখ আট হাজার ৮৯ ভোট। বিপরীতে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী নুরুল ইসলাম নাহিদ এক লাখ ৯৬ হাজার ১৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন।
বিএনপি থেকে এবার মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। তিনি নিয়মিত এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। স্থানীয় পর্যায়ে নেতা কর্মীদের সঙ্গে রয়েছে তাঁর সুসম্পর্ক। পরিচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে দলের উচ্চপর্যায়েও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সাম্প্রতিককালের সরকারবিরোধী আন্দোলনে এমরান আহমদের অগ্রণী ভূমিকাকে দলের মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্র হিসাবে দেখছেন তাঁর অনুসারীরা।  
দল নির্বাচনে গেলে তিনি মনোনয়ন পাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে এমরান আহমদ চৌধুরী বলেন, মানুষের সেবা করার জন্যই রাজনীতি করি। সারাজীবন ত্যাগ স্বীকার করে এসেছি। বাকি জীবন সেবা করে যেতে চাই। দলের মনোনয়ন পেলে নির্বাচনে যাব। উন্নয়নের দিক থেকে পিছিয়ে থাকা আমার এলাকার উন্নয়নের জন্যই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে লড়াই করব।

×