ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

সিলেট-২

আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’দলই চায় জয়ের ধারায় ফিরতে

সালাম মশরুর, সিলেট

প্রকাশিত: ০০:২৭, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’দলই চায় জয়ের ধারায় ফিরতে

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আলোচিত সংসদীয় আসন সিলেট-২

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আলোচিত সংসদীয় আসন সিলেট-২। প্রবাসী অধ্যুষিত এই আসনের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে প্রবাস থেকে সার্বক্ষণিক বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের চাহিদার প্রতিফলন ঘটানোর প্রচেষ্টা চালান তারা। নির্বাচনের সময় দেশে এসে নিজের প্রার্থীর পক্ষে ভোটের মাঠে কাজও করে থাকেন।
স্থানীয়ভাবে ইতোমধ্যে এই আসনে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থীদের তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন কেন্দ্রের সঙ্গে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির মধ্যে আসনটির পালাবদল হয়ে এলেও বিগত নির্বাচনে জোটের সুবিধায় এই আসন থেকে গণফোরামের প্রার্থী এমপি নির্বাচিত হন। নির্বাচনে কার্যত বিএনপির অনুপস্থিতি এবং আওয়ামী লীগ আসনটি ছেড়ে দেওয়ায় গণফোরাম থেকে মোকাব্বির খান সহজেই জয় লাভ করে এমপি নির্বাচিত হন।
তবে সিলেট-২ আসনটি বরাবরই আওয়ামী লীগের দখলেই ছিল। একপর্যায়ে হাতছাড়া হয়ে যায়। কালক্রমে সিলেট-২ আসনে আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী নেতার অবস্থান তৈরি হওয়ায় এখানকার রাজনীতিতেও ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়। দুই প্রভাবশালী নেতার মধ্যে সাবেক এমপি, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী একজন। অপরজন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, বর্তমান সিলেট সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র। দুজনই প্রবাসী আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, জেলার রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত। দুজনই সিলেটে ছাত্র রাজনীতি করেছেন।

পরবর্তী পর্যায়ে প্রবাসী হয়েছেন। প্রবাসে অবস্থান করলেও সিলেটের রাজনীতি ও গণামানুষের  সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রয়েছে। এই সুবাদে স্থানীয়ভাবে নির্বাচন করতে তাদের কোনো সমস্যা নেই। প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট-২ আসনে শফিকুর রহমান চৌধুরী একবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। পরবর্তী পর্যায়ে ওই আসনে জেলা আওয়ামী লীগের এই দুই নেতার নেতৃত্বে দুটি বলয় তৈরি হয়। নেতাকর্মীরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যান। আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর পক্ষেও জনমত তৈরি হয়। তিনিও সিলেট-২ আসনে নির্বাচন করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। 
এই পর্যায়ে আওয়ামী লীগ জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় ওই আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে দলীয়ভাবে আনোয়ারুজ্জামান ও শফিকুর রহমান কেউই সেই সময়ে মনোনয়ন পাননি। সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে ইয়াহিয়া চৌধুরী এহিয়া এমপি নির্বাচিত হন। তবে ইয়াহিয়া চৌধুরীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। জোটগত হওয়ায় তাদের সম্পর্ক ছিল নামমাত্র। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ উদ্দীপনাও ছিল না। 
আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও শফিকুর রহমান চৌধুরীর মধ্যে এখন ঐক্য রয়েছে। আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সিটি মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় তার এই আসনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। সে কারণে শফিকুর রহমান চৌধুরী মনোনয়ন পেলে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন। শফিকুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে এলাকার গণমানুষেরও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এলাকার মানুষজন বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে তাকে সবসময় কাছে পেয়ে আসছে। এলাকার মানুষের কাছে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে।
সিলেট-২ আসনে নির্বাচনের বিষয়ে সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, এই আসনটি আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমি বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে পরাজিত করে নির্বাচিত হয়েছি। এই সময়ে শিক্ষা স্বাস্থ্য যোগাযোগসহ সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। বিগত দুটি নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কাজ করেছি। এবারও বঙ্গবন্ধুকন্যা যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সে অনুযায়ী কাজ করব।
গত দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী না থাকায় দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় নেতাকর্মীরা মনে করছেন, দলীয় এমপি না থাকায় নেতাকর্মীরা কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নিজের দলের প্রার্থী না থাকায় নেতাকর্মীরা হতাশায় ভুগছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমপি মোকাব্বির খানের সঙ্গে তৃণমূল আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি গণফোরামের পরামর্শে কিংবা জোটের নেতাদের নিয়ে চলায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন।
বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট-২ আসন। এই আসনে থেকে বিগত নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ চারবার বিজয়ী হয়েছে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি তিনবার করে এবং সর্বশেষ গণফোরাম থেকে মোকাব্বির খান এমপি নির্বাচিত হন।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। ওই নির্বাচনে সিলেট-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম খান। তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদের সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য। নুরুল ইসলাম খান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক মরহুম জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে দেওয়ান তৈমুর রাজা চৌধুরী এই আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৮৫ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটি আবার আওয়ামী লীগের দখলে আসে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে এমপি হন ইনামুল হক চৌধুরী। ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান এবং ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন ইনামুল হক চৌধুরী। পেয়েছেন বীরপ্রতীক খেতাবও। চতুর্থ ও পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন বীর মুক্তিযোদ্ধা মকসুদ ইবনে আজিজ লামা। ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করলেও পরবর্তীতে জাসদ ও জাতীয় পার্টির রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন এই নেতা। তিনি ১৯৬৭-৬৮ সালে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত হন। তিনি জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন নিয়ে এই আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ আজিজুর রহমান। ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান ছিল অপরিসীম। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া আজিজুর রহমান ছিলেন সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। ১৯৮৯ সালে তিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর প্রতিশোধ নিতে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সক্রিয় সঙ্গী ছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী (বর্তমানে নিখোঁজ)। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এম ইলিয়াস আলীকে তিন হাজার ১৭৪ ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের শফিকুর রহমান চৌধুরী।
এক সময়ে এই আসনে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত ছিল বেশ শক্তিশালী। শফিকুর রহমান চৌধুরী ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দক্ষতার সঙ্গে এলাকায় নিজের অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনটি মহাজোটের জন্য ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। দলীয় নির্দেশ মেনে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন শফিকুর রহমান চৌধুরী। জাতীয় পার্টির যুগ্ম-মহাসচিব ইয়াহিয়া চৌধুরী এহিয়া এমপি হন। তবে সম্প্রতি সিটি নির্বাচনে শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ এনে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে ইয়াহিয়া চৌধুরী এহিয়াকে।  
এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দৌঁড়ে শফিকুর রহমান চৌধুরী ছাড়াও রয়েছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক অরূপ রতন চৌধুরী ও জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আখতারুজ্জামান চৌধুরী (জগলু চৌধুরী)।
অরূপরতন চৌধুরী ইতোমধ্যে তার প্রার্থিতার বিষয়টি স্পট করেছেন। তিনি জীবনের শেষ সময়টুকু সিলেটের মাটি ও মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করতে চান। যুব সমাজকে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। অন্যায় অনিয়ম এবং মাদকবিরোধী নানা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
জগলু চৌধুরীও নির্বাচন সামনে রেখে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ব্যাপক প্রচারও দেখা যাচ্ছে। ছাত্রলীগের সক্রিয়কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে আসেন জগলু চৌধুরী। ছিলেন ইউনিয়ন ও উপজেলা ছাত্রলীগের বিভিন্ন দায়িত্বে।
অন্যদিকে, বিএনপি থেকে এই আসনে একমাত্র প্রার্থী নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর সহধর্মিণী তাহসিনা রুশদী লুনা। দীর্ঘদিন থেকে মাঠে রয়েছেন তিনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-২ আসনে প্রথমবারের মতো বিএনপির একমাত্র নারী হিসেবে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। প্রাথমিক পর্যায়ে তার মনোনয়ন বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তীতে মনোনয়ন বৈধতা প্রমাণিত হলেও গণফোরামের প্রার্থী মোকাব্বির খানকে সমর্থন জানিয়ে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।
এই আসনে এর আগে সংসদ নির্বাচনে কোনো নারী মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে মাঠে নামেননি কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখা যায়নি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে সেখানে বিএনপির একমাত্র প্রার্থী হবেন লুনা। ইলিয়াস আলীর হারানো আসনটি পুনরুদ্ধারে তাকেই বেছে নেওয়ার কথা ভাবছে বিএনপি। লুনা এর আগে স্থানীয় রাজনীতিতে অনুপস্থিত ছিলেন। তার স্বামী সাবেক এমপি ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর জনতার সামনে আসেন লুনা। 
প্রথমদিকে নিখোঁজ স্বামীর খোঁজ পাওয়ার দাবিতে নানামুখী তৎপরতা চালান। স্থানীয় নেতাকর্মীরা তাকে সঙ্গে নিয়ে ইলিয়াস আলীর সন্ধান পেতে আন্দোলন করেন। নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর জায়গায় নেতাকর্মীরা লুনাকেই নেতৃত্বের ভাগিদার করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। স্থানীয় পর্যায়ে ইলিয়াস আলীবিহীন আসনে একাধিক নেতৃত্ব দানকারীদের তৎপরতা ঠেকাতে লুনাকেই আঁকড়ে ধরেন তারা। মাঠে তিনি নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। এই আসনে বিএনপির হাল ধরেন লুনা। এদিকে দলের ভেতরে ইলিয়াস পতœী তাহসীনা রুশদীর লুনার পাশপাশি ছেলে আবরার ইলিয়াসকে নিয়েও আলোচনা রয়েছে। অনেকে বলছেন, শেষ মুহূর্তে ইলিয়াছ পুত্র আবরারও প্রার্থী হতে পারেন।
জাতীয় পার্টির সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য ইয়াহিয়া চৌধুরী দলের মনোনয়ন না পেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন। এছাড়া বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের মো. মোশাহিদ খান, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মো. মনোয়ার হোসেন, গণফোরামের মোকাব্বির খান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মাওলানা কাজী আমিন উদ্দিন, স্বতন্ত্র প্রার্থী এনামুল হক সরদার, মোহাম্মদ আব্দুর রব, মো. হাবিবুর রহমানের নাম প্রার্থী হিসেবে রয়েছে আলোচনায়।

×