
দে দে পাল তুলে দে মাঝি হেলা করিস না/ ছেড়ে দে নৌকা আমি যাবো মদিনা..
দে দে পাল তুলে দে মাঝি হেলা করিস না/ ছেড়ে দে নৌকা আমি যাবো মদিনা...! দেশবরেণ্য বাউল শিল্পী আব্দুর রহমান বয়াতির লেখা ও গাওয়া এই গান এখনো মন ছুঁয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানাজীর নির্বাচনেও এই গান সে দেশের মানুষকে আলোড়িত করেছে। ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৌকা ডুবি’ কিংবা ‘কাগজের নৌকা’ কবিতাও মন ছুঁয়ে যাবার মতো সাহিত্যকর্ম। বাউলশিল্পী আব্দুর রহমান বয়াতির দেখা নৌকা, তাঁর মননের প্রতিচ্ছবির নৌকা আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় অনেকটাই অচল।
সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীতে এখন আর পালতোলা নৌকার দেখা মেলে না। চলাচল করে না পাট ও খাদ্যশস্যসহ মালবাহী বড় বড় নৌকা, নদীর পাড় দিয়ে গুন টানা নৌকাও। তবে যমুনা নদীর দুর্গম চরে পারাপারের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া যাত্রীবাহী ইঞ্জিনচালিত নৌকার দেখা মেলে। দেখা মেলে ছোট ছোট নদীর বুকে ও বিলে মাছ ধরার ছোট ছোট নৌকা।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকা আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাচীনকালে যখন কোনো প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটেনি তখন যানবাহন বা চলাচলের অন্য কোনো বাহন তৈরি হয়নি। সে সময়ে মানুষের জীবনের প্রধান বাহন ছিল নৌপথ, ছিল শুধু নৌকা। সেসময় মানুষ নিজের প্রয়োজন, জীবন জীবিকার প্রয়োজনে নৌকায় চলাচল করতো, নৌকাই ছিল তাদের একমাত্র বাহন। বিশেষ করে যমুনা পাড়ের সিরাজগঞ্জের অভ্যন্তরীণ নদী বড়াল, হুড়াসাগর, ইছামতি, দৈভাঙ্গা, ফুলজোড়, করতোয়সহ নানা নামে পরিচিত ছোট ছোট নদীতে সে সময় নৌকার বহর ছিল। এই বহরে বড় বড় মালবাহী নৌকা, ছোট বড় নানা সাইজের পালতোলা নৌকা, যাত্রীবাহী নৌকা ঘাটে অবস্থান করেছে। নৌকা ঘাটকে কেন্দ্র করে খাবার হোটেলও গড়ে উঠেছে। নদী ঘাটে খেয়া পারাপারের মাধ্যমও ছিল নৌকা। বৃহত্তম চলনবিলের গ্রামে নৌকা ছাড়া এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যাবার কোনো উপায় ছিল না। নদী-নালায়, খাল-বিলে জাল ফেলার নৌকার আধিক্য ছিল। বর্ষায় এখনো শাহজাদপুরের কৈজুরী, কাজিপুরের মেঘাই ঘাটে নৌকার হাট বসে। বেচা বিক্রিও হয় প্রচুর।
বর্ষা শেষে শান্ত যমুনায় এমনকি জেলার অভ্যন্তরীণ নদী বড়াল, হুড়াসাগর, ইছামতি, ফুলজোড়, করতোয়ায় প্রতি বছর নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা হয়েছে। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পানসি, কোশা, ছিপ নৌকা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। নদীর বুকে নৌকা প্রতিযোগিতার এই খেলা শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ পরিবার পরিজন নিয়ে নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করেছে। এ প্রতিযোগিতার সময় আত্মীয়-স্বজনেরও আগমন হয়েছে। বাড়িতে আয়োজন করা হয়েছে পায়েস, পিঠা-পুলিসহ নানা ধরনের খাবার। এখনো কিছু কিছু এলাকায় নৌকা বাইচের আয়োজন হয়। উৎসবে মেতে ওঠে মানুষ।
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির আবির্ভাবের কারণে উন্নত যানবাহন ও স্থলপথে মানুষ নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করলেও নৌকাকে কেউ ভুলে থাকতে পারেনি। প্রমত্তা যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণকালে এবং বর্তমানে নির্মাণাধীন বাংলাদেশ রেলওয়ের মেগা প্রকল্প শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণে বিশে^র সেরা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলেও সেখানে নৌকার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। ঢাকার বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচে এখনো নৌকায় মালামাল আানা নেওয়াসহ যাত্রী পারাপারের দৃশ্য চোখে পড়ে। লঞ্চঘাটেও নৌকা দেখা যায়। এখনো মানুষ শখের বসে হলেও নৌকা ভ্রমণ করে থাকে। নদী ভ্রমণের জন্য তারা নৌকা ব্যবহার করে থাকে। নদীর বুকে নৌকা উঠার আনন্দ ও অনুভূতি বলে শেষ করা যাবে না।
নৌকা ভ্রমণের মাধ্যমে নদীর শান্ত পরিবেশ ও মনোরম প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায়। প্রাচীন বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতীক ছিল নদীতে নৌকার বহর। যার সংস্কৃতি ঐতিহ্য এখনো বাংলার মানুষের মাঝে রয়েছে। প্রতিটি মানুষ নদীর নৌকার অপরূপ সৌন্দর্য উপলব্ধি করার জন্য নৌকাভ্রমণ করে থাকে।
এত আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন প্রকারের যানবাহন, উড়াল সেতু, আন্ডারপাস, ৬০ ফুট, ৯০ ফুট চওড়া রাস্তা নির্মিত হয়েছে, হাওড়-বাঁওড়, চলনবিলের বুক চিরে সড়ক মহাসড়ক নির্মিত হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। পিকনিক স্পট নির্মিত হয়েছে, তারপরও নৌকায় চড়ে বিয়ের উৎসব, পিকনিক এখনো চোখে পড়ে। নৌকাডুবিতে বরসহ নববধূর মৃত্যুর ঘটনা প্রায়ই খবরের কাগজে উঠে আসছে। একই পরিবারের মা-বাবাসহ ৬ জনের মৃত্যু বা তারও বেশি মানুষের মৃত্যুর ঘটনা আমাদের বেদনায় ভারাক্রান্ত করে তোলে।