ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একদা এখানে নদী ছিল

সমুদ্র হক

প্রকাশিত: ২৩:৩৩, ১ এপ্রিল ২০২৩

একদা এখানে নদী ছিল

এককালের খরস্রোতা ইছামতি এখন শুকিয়ে ফসলের মাঠ। সম্প্রতি বগুড়ার গাবতলীর কদমতলি গ্রাম থেকে তোলা

একদা সেখানে নদী ছিল। বর্ষায় ছিল ঢেউ। নদী পথে যাওয়া হতো এক গাঁও থেকে আরেক গাঁও। দূরের গ্রামে যোগাযোগে ছিল কাঁচা সড়ক। আশির দশকে সড়ক সংযোগে ওই নদীর ওপর নির্মিত হয় কংক্রিটের সেতু। আবার সেতুর নিচ দিয়ে নদী পথে ছিল সহজ যোগাযোগ। সেই নদীর অস্তিত্ব আজ আর নেই। গ্রামের লোক অবশ্য নদীর নামটি জানে।

কেমন ছিল সেই নদী, প্রবীণরা তাও বলেন। প্রজন্মরা নদীর নাম জানতে পারে পূর্বসূরিদের কথায়। নদীর নাম ইছামতি। তবে তারা নদী দেখে না। দেখে ফসলের মাঠ। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার নশিপুর ইউনিয়নের কদমতলি গ্রামে গেলে শুকিয়ে যাওয়া ইছামতি নদীতে আবাদ চোখে পড়ে। দূরে দেখা যায় কংক্রিটের ব্রিজ। এই ব্রিজটি এখন ইছামিত নদীর পরিচয়ে কালের সাক্ষী।

এভাবে কত নদী হারিয়ে গেছে আর কত নদী মরুপথের যাত্রী তা এখনো অজানা। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পানি বিজ্ঞানীদের হাতে একটা হিসাব আছে। সেই হিসাবে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলার শতাধিক নদী অস্তিত্ব টিকে থাকার লড়াই করছে। নাব্য অনেক আগেই হারিয়েছে। কোনো নদী খালের মতো। নদী যে ছিল তা মনেই হয় না। তারপরও লোকমুখে বলাবলি হয় সেই নদীর নাম। কোনো কোনো নদী আঁকাবাঁকা পথে বয়ে চলেছে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায়। সেই নদী কোথাও একবারে শুকনো। কোথাও ভরাট হয়ে গেছে। কোথাও খালের মতো। কোথাও সামান্য জলাশয়ে জানান দিচ্ছে তার অস্তিত্ব। যেমন বগুড়ার করতোয়া।

ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, তিস্তা, ধরলা, বাঙ্গালীর ভেতরে চর জেগে উঠেছে। তারপরও চরের কাছেই স্রোতের দেখা মেলে। বর্ষায় স্রোতের তীব্রতা বাড়ে। তারপর সেই স্রোত আর থাকে না। কোথায় হারিয়ে যায়, তাও জানা যায় না। শুধু বলা হয় নদী আছে অন্য কোথাও। বড় ও মাঝারি নদীর এই অবস্থা। ছোট নদী আর টিকে থাকে কেমনে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গত শতকের প্রথমে নওগাঁর পতিসরে নারদ নদী দেখে সুদূরপ্রসারী ভাবনায় লিখেছিলেন ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে’।

কবিগুরুর সেই কবিতা শতবর্ষ পরে আজ বাস্তব। ছোট নদীগুলোর মধ্যে খলসডাঙ্গা, মহানন্দা, আত্রাই, বড়াল, তেঁতুলিয়া, ইছামতি, নারদ, হুরাসাগর, গুমানি, কাঁকন, কাঁকেশ^রি, চিকনি, রূপনাই, করতোয়া, নদীশুখা, মাথাভাঙ্গা, বাঙ্গালী, ফুলেশ^রিসহ বহু নদীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনার শাখা নদীগুলোর যে হাল, পদ্মার শাখা ও উপ-নদীগুলোরও একই অবস্থা। যমুনা, পদ্মা তো অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে আছেই, শাখা নদীগুলোও রক্ষা করতে পারছে না। যমুনা ও পদ্মার তীর ঘেঁষে চর জেগেছে। রাজশাহীর পদ্মার গোদাগাড়ি উপজেলার বালিয়াঘাটা থেকে সুলতানগঞ্জ পর্যন্ত মহানন্দা নদীর অন্তত ১০ কিলোমিটার এবং সুলতানগঞ্জ মোহনা থেকে প্রেমতলি পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার নদীর পদ্মার অংশে ষাটভাগে পানি নেই।

বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনার প্রবাহের কামালেরপাড়া-কর্নিবাড়ি-বলাইল-ধুনটের-গোসাইবাড়ি-ভেলাবাড়ি-এলাকা হয়ে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর-বেলকুচি পর্যন্ত যমুনার অস্তিত্বের অর্ধেক আজ কোথাও বালিয়াড়ি, কোথাও চর। আবার বগুড়ার সোনাতলা-হরিখালির বাঙ্গালী নদী হয়ে যমুনার যে প্রবাহ গাইবান্ধার ফুলছড়িতে গিয়ে ঠেকেছে, তার মধ্যেও যমুনা অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারছে না।
এদিকে রাজশাহীর চারঘাটের বড়ালের দশা শীর্ণকায়। সেখানে এখন ফসলের মাঠ। উত্তরাঞ্চলের ইতিহাসখ্যাত নদ নারদের তিনটি প্রবাহ টিকে থাকতে পারছে না।

নারদের প্রথম প্রবাহ রাজশাহীতে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রবাহ নাটোরে। ছোট কোনো নদী বর্ষাতেও উত্তাল থাকতে পারছে না। এইসব নদীকে ঘিরে অনেক ইতিহাস আছে। রাজশাহীতে পদ্মার শাখানদীগুলোতে প্রায় একশ’ কিলোমিটার প্রবাহ পথে ব্রিটিশরা পাঁচটি নীলকুঠি তৈরি করে। পাবনার ঈশ^রদীর পাকশীতে পদ্মার তীরে ব্রিটিশরা বানায় বাংলো, যা আজো দৃশ্যমান। তবে নেই শুধু সেদিনের সেই পদ্মার অস্তিত্ব।
ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তার তীরে গেলে এখন খালি চোখেই দেখা যায় নদীগুলো কী সংকটে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সামান্য কিছু সংস্কার করে। তারপর যে অবস্থা সেই। পলি জমে ভরাট হয়ে যায়। যেমন উজান থেকে বিপুল প্রবাহ এসে বড়াল নদীর দুই কূল ছাপিয়ে যায়। শকুনা মৌসুমে সেই চিত্র আর থাকে না। পাবনার চাটমোহরে গোমানি নদীর পানি প্রবাহ বর্ষায় যেখানে থাকে প্রতি সেকেন্ডে ১৬ হাজার কিউসেক, শুকনা মৌসুমে তা নেমে আসে প্রতি সেকেন্ডে মাত্র ২শ’ কিউসেকে। পাবনার বাঘাবাড়ী ঘাটে হুরাসাগরে বর্ষায় পানির যে উচ্চতা শুকনা মৌসুমে তা অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসে।
এভাবে প্রতিটি নদী পড়েছে চরের থাবায়। নদী হারিয়ে ফেলছে তার অস্তিত্ব। এক হিসাবে বলা হয়েছে, রাজশাহীর চারঘাট থেকে বাঘাবাড়ী পর্যন্ত চর জেগেছে অন্তত ২শ’টি। কুড়িগ্রাম থেকে ঢালারচর পর্যন্ত চর জেগেছে ৩শ’রও বেশি। ঢালারচর থেকে রাজশাহী পর্যন্ত চর জেগেছে প্রায় দুশ’টি। একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে বলা হয়েছে, যমুনায় চর জেগেছে দেড় হাজার বর্র্গ কিলোমিটার। পদ্মায় অন্তত ৭শ’ বর্গ কিলোমিটার।

মেঘনার উত্তর ও দক্ষিণ অববাহিকায় চর জেগেছে ৪শ’ বর্গ কিলোমিটার। প্রতিবছর এই চর বাড়ছে। নদী থেকে জেগে ওঠা এই চরের পরিমাণ অন্তত আড়াই হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা মোট ভূমির প্রায় দুই শতাংশ।
ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বর্ষায় উত্তর থেকে যে প্রবাহ পূর্ব দিক হয়ে দক্ষিণের দিকে যায় এবং গঙ্গার যে প্রবাহ পদ্মা হয়ে দক্ষিণ-পূর্বে যায়, সেই প্রবাহ এখন কমেছে। এরই মধ্যে পানিবিজ্ঞানীরা বড় নদীগুলোর নাব্য ও প্রবাহ ধরে রাখার পরিকল্পনা করছেন। ইতোমধ্যে যমুনায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। আরেকটি সূত্র জানায়, যমুনার প্রশস্ততা কমিয়ে বড় নদী ও শাখানদীগুলোর অস্তিত্ব ধরে রাখার চেষ্টা চলছে।

×