ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাবনা-৪

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান অনেকে, বিএনপিতে কোন্দল

তৌহিদ আক্তার পান্না,  ঈশ্বরদী

প্রকাশিত: ২৩:৩৫, ২০ মার্চ ২০২৩

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান অনেকে, বিএনপিতে কোন্দল

দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার’খ্যাত ঈশ্বরদী ভৌগোলিক কারণে ব্রিটিশ আমল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ

দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার’খ্যাত ঈশ্বরদী ভৌগোলিক কারণে ব্রিটিশ আমল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে ঈশ^রদীর   গুরুত্ব¡ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। 
সঙ্গে রয়েছে আটঘরিয়া উপজেলা। পাবনা জেলার ঈশ্বরদী ও আটঘরিয়া উপজেলা নিয়েই পাবনা-৪ আসন। পাবনা জেলার পাঁচটি আসনের মধ্যে এই আসনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 
কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডল, আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা প্রয়াত ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু, বাংলাদেশের প্রথম সংসদের প্রয়াত এমপি মহিউদ্দিন আহমেদ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা প্রয়াত ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হুদা পাখি সরদারের মতো ব্যক্তির জন্ম এই এলাকায়। 
বিএনপি-জামায়াতের এক সময়ের দুর্গ বলে খ্যাত পাবনা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের শামসুর রহমান শরীফ ডিলু পর পর পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিএনপি-জামায়াতের সে দুর্গ ভেঙে দেন। তার মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে এই আসন থেকে জেলার মুজিব বাহিনী প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ নুরুজ্জামান বিশ্বাসকে মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি এই আসনের সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালন করছেন। 
১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাবনা-৪ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিএনপির প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম সরদার। ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব বিএনপিতে যোগদানের পর থেকে বিএনপির গ্রুপিং রাজনীতি শুরু হয়। এ কারণে এই আসনটিতে বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থী বার বার ধরাশায়ী হন আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতিবিদ প্রয়াত শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর কাছে। এই আসন থেকে ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে রয়েছে। 
আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান বিশ^াস, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অর্থ কমিটির চেয়ারম্যান ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অন্যতম কৌঁসুলি সিনিয়র অ্যাডভোকেট রবিউল আলম বুদু, প্রয়াত ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর ছেলে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সাকিবুর রহমান শরীফ কনক, সাবেক সংসদ সদস্য পাঞ্জাব আলী বিশ্বাস, আটঘরিয়া পৌর মেয়র শহিদুল ইসলাম রতন, পাবনা  জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউর রহমান লাল, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক উপকমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম লিটন, সাবেক পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ মিণ্টু, আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান স্বপন, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক ব্যারিস্টার সৈয়দ আলী জিরু, কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুল আলিম ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ জালাল উদ্দিন তুহিন। 
অপরদিকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম সরদার। বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পাবনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব। সার্বক্ষণিক এলাকায় অবস্থান করা সচেতন রাজনীতিবিদ হিসেবে সিরাজুল ইসলাম সরদারের অবস্থান মজবুত বলেই তৃণমূলের নেতাকর্মীরা জানান। 
অন্যদিকে কেন্দ্রীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও এলাকায় কম অবস্থান করা এবং দলীয় নানা কোন্দল ও দ্বন্দ্বের কারণে নেতাকর্মীদের কাছে কিছুটা ভাটা পড়েছে হাবিবুর রহমান হাবিবের অবস্থান। তার পরও আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপির এই দুই নেতা পৃথকভাবে নিজ সমর্থিত নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন সভা সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল গনসংযোগ ও প্রচার অব্যাহত রেখেছেন। একইসঙ্গে পৃথকভাবে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীদেরও নাম শোনা যাচ্ছে। 
এ দিকে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন জামায়াতে ইসলামের প্রার্থী মওলানা নাসির উদ্দিন। পরবর্তী ২০০১ ও ২০০৮ সালে জোটকে ছাড় দিয়ে এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। পর পর পাঁচবার বিএনপি-জামায়াত জোট আসন হারালেও এবার পুনরুদ্ধার করতে চায় জামায়াতে ইসলামীও। মাঠ পর্যায়ে জনপ্রিয়তা থাকায় এখানে জেলা জামায়াতের  আমির অধ্যাপক আবু তালেব ম-ল প্রার্থী হতে চেয়েছেন বলে বিশ^স্ব সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া উপজেলা জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকেও একজন প্রার্থী হওয়ার কথা শোনা গেলেও যোগ্য প্রার্থীর অভাবে বিষয়টি এ নো পরিষ্কার হয়নি। 
পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ও বর্তমান এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ নুরুজ্জামান বিশ^াস জনকন্ঠকে জানান, বঙ্গবন্ধুর কর্মী ছিলাম বিধায় আমি ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ৬০ বছরে দলের বিরোধিতা করিনি। এমপি হয়ে এলাকার রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ নির্মাণসহ অনেক উন্নয়ন কাজ করেছি। ব্যক্তিগত পক্ষ থেকেও মানুষকে সহযোগিতা করেছি। মানুষ আমাকে ভালোবাসে তাই আমার স্বপ্ন বিমানবন্দর চালুকরণ,  রেলগেটে ফ্লাইওভার নির্মাণ, সাঁড়ায় স্থলবন্দর নির্মাণ, কৃষি প্রসেসিং জোন স্থাপন ও আটঘরিয়ায় কৃষি বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন করা। নেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে ভালো করে চেনেন। তাই আমি শতভাগ  বিশ^াস করি মনোনয়ন পাব এবং বিপুল ভোটে আবারও বিজয়ী হব। 
মনোনয়নপ্রত্যাশী বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার কৌঁসুলি সাবেক ছাত্রনেতা অ্যাডভোকেট রবিউল আলম বুদু বলেন, আমার পরিবার দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে ঈশ্বরদী আটঘরিয়ার মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। আমার বড় ভাইয়েরা সব মুক্তিযোদ্ধা, আমাদের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প করত, আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া দাওয়া করাতেন। ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমাদের পরিবারই স্থানীয় আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রেখেছিল। সকল সময়ে আমি এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে রয়েছি।

করোনাকালে এলাকায় খাদ্য-অর্থ-সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ এক মাস আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে  লড়েছি। আমার প্রিয় ঈশ্বরদী-আটঘরিয়ার মানুষের দোয়ায় আল্লাহতায়ালা আমাকে নতুন জীবন দান করেছেন। এজন্য আমি আমার প্রিয় ঈশ্বরদী-আটঘরিয়ার সকল জনগণ এবং মহান আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞ। মনোনয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ বোর্ডের সদস্যরা নিশ্চয় যোগ্য ব্যাক্তিকেই মনোনয়ন দিবেন বলে বিশ্বাস করি। মনোনয়ন পেলে জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত বিজয়ী হবো।

আওয়ামী লীগের অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক ভূমিমন্ত্রী প্রয়াত শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর ছেলে আওয়ামী লীগ নেতা সাকিবুর রহমান শরীফ কনক বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য নেতাকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছি। আমার প্রয়াত বাবার দেখানো পথ অনুসরণ করেই করোনার সময় থেকে এক লাখেরও বেশি পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে খাদ্য, শীতের সময়গুলোতে কম্বল, ঈদ, পূজা-পার্বণে শাড়ি-লুঙ্গি ও নগদ অর্থ উপহার দিয়ে পাশে থেকেছি।

এ ছাড়া করোনার কঠিন সময়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার নামে ২’শ অক্সিজেন সিলিন্ডার, পিপিই, স্যানিটাইজার, ডাক্তার সেবা ও ওষুধ নিয়ে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা মানুষকে সেবা দিয়েছি। তিনি বলেন, সামাজিক সব ধরনের কর্মকা-ে সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ করায় আমার প্রয়াত বাবার মতো এলাকার মানুষ আমাকে কাছে টেনে নিয়েছে। প্রয়াত বাবার রাজনৈতিক দীক্ষা, রাজনৈতিক কর্মকা- তথা জনগণের অভিমত সেটা শেখার চেষ্টা করেই জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে মনোনয়ন দিলে এই আসনে এলাকার জনগণ বিপুল ভোটে আমাকে নির্বাচিত করবে। 
সাবেক ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, ঈশ্বরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ মিন্টুও নীরবে নিভৃতে প্রচার চালাচ্ছেন এবং তিনিও মনোনয়ন পেলে নির্বাচন করবেন বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউর রহমান লাল ঈশ^রদী-আটঘরিয়ার বিভিন্ন স্থানেব কিছু বিল বোর্ড টাঙ্গিয়েছেন, যেগুলো দেখে মানুষ নানা রকম মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ বলছেন,তিনি নির্বাচন করতে চান বলেই বিভিন্নস্থানে বিলবোর্ড ঝুলিয়েছেন।  
এদিকে, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও পাবনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান হাবিবের কাছে  মোবাইল ফোনে জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রথমে প্রার্থী নন এবং নির্বাচন করবেন না বলে জানান। তবে দল মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করবেন বলেও নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, নেত্রী খালেদা জিয়া রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছেন, তাই রাজনীতি করছি। দল মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করব, আর না দিলে করব না।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক এমপি সিরাজুল ইসলাম সরদার বলেন, আসন্ন নির্বাচনে যদি দল অংশগ্রহণ করে এবং  আমাকে মনোনয়ন দেয়, নির্বাচন করবো এবং আমি নিশ্চিত বিজয়ী হবো। আর জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক আবু তালেব ম-লের সঙ্গে মোবাইল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

×