ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

আগ্রাদ্বিগুনে ক্যাম্পে অপারেশনে বহু পাকসেনা হতাহত হয়

জাহিদুল ইসলাম, ধুনট, বগুড়া

প্রকাশিত: ২৩:৫১, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আগ্রাদ্বিগুনে ক্যাম্পে অপারেশনে বহু পাকসেনা হতাহত হয়

অধীর চন্দ্র সাহা

১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের সর্বস্তরের মানুষ। বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে ছিনিয়ে আনেন স্বাধীনতা। হানাদারদের বিরুদ্ধে এ দেশের যারা মরণপণ লড়াই করেছেন তাদেরই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা অধীর চন্দ্র সাহা। দৈনিক জনকণ্ঠের কাছে রক্তঝরা সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন। 
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধীর চন্দ্রের বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলার গোপালনগর ইউনিয়নের বগা গ্রামে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন এক ডানপিটে যুবক। অধীর চন্দ্র বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের নাম বাগবাটী। ১৯৭১ সালের ৫ মে গভীর রাতে ওই গ্রামে হামলা করে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। সে রাতে তারা ঘুমন্ত ১৬৫ জনকে হত্যা করে। পরের দিন ভোরে চারপাশে সে খবর পৌঁছে যায়। নির্মম নির্যাতনের চিহ্ন ছিল নারী-পুরুষের নিথর দেহে। এর পর সিদ্ধান্ত নিই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে এই দেশ থেকে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতাড়িত করব।
তিনি বলেন, বাগবাটী গ্রামে পাক বাহিনীর গণহত্যার ঘটনা তখন আমাদের মনে নির্মম ক্ষত তৈরি করেছিল। এরই মধ্যে ধুনটের রান্ডিলা গ্রামের ছাত্রনেতা নূরুল ইসলাম মিঞা কয়েক গ্রামের ছাত্র ও যুবকদের নিয়ে এক সভা আহ্বান করেন। সেই সভায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিই। ২৯ মে ধুনট উপজেলা থেকে কাজিপুর উপজেলার শুভগাছা হয়ে যমুনা নদী দিয়ে নৌকাযোগে ভারতের আসাম প্রদেশের মানিকারচর অভিমুখে রওনা দেন।
প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন অধীর চন্দ্র। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, নওগাঁ জেলার পোরশা থানার (বর্তমানে সাপাহার থানা) নিতপুর, খঞ্জনপুর, সাপাহারে পাক সেনা ও রাজাকারদের শক্তিশালী ক্যাম্প ছিল। খঞ্জনপুর এলাকায় বহু বিহারি বসবাস করত। বিহারিদের সমন্বয়ে পাকবাহিনী শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে। ঘাঁটিগুলোকে উচ্ছেদ করার জন্য পারিলা দোরগঞ্জ বাজারে অপারেশন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। পারিলা দোরগঞ্জ অপারেশন ক্যাম্প থেকেই বেশ কয়েকবার রাতে আকস্মিক আক্রমণ করা হয় পাক সেনাদের ক্যাম্পে। এতে বেশকিছু পাক সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। 
তার পর মূল ক্যাম্প ওসিএমএফ ‘তপন’ (পারিলা দোরগঞ্জ) ক্যাম্প থেকে ৭/৮ মাইল পূর্ব দিকে জলডাঙ্গা বি এস এফ ক্যাম্পের মাধ্যমে বর্তমান নওগাঁ জেলার ধামইরহাট থানার আগ্রাদ্বিগুন বাজারের দক্ষিণপ্রান্ত সংলগ্ন একটি টিলার ওপর বাংকার করে এবং ওই টিলার ডান ও বাম দিকে বাঁকা চাঁদের মতো করে পজিশন নেয় ১৫০ মুক্তিযোদ্ধা। সেখানে পাকসেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে প্রচ- যুদ্ধ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের এবং শত্রুরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরদিন ভোরে শত্রুরা আবার ভারি অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে। ওই সময় নজরুল ইসলাম (নাসির) নামের এক মুক্তিযোদ্ধা বোমার আঘাতে গুরুতর আহত হন। 
অধীর চন্দ্র বলেন, তিনি ও তার সঙ্গীরা রক্তাক্ত নজরুলকে পিঠে করে নিয়ে যান। তাদের দুজনের অস্ত্র দুটি আবু বক্করের কাছে দেওয়া হয়। এদিকে যুদ্ধের নিয়মে পিছু হটতে হলেও মাঝে মধ্যে গুলি চালাতে হয়। যেন শত্রু পক্ষ বুঝতে না পারে। যখন আহত নজরুলকে নিয়ে আধা মাইল দূরে কিছুটা নিরাপদ এলাকায় চলে যান, তখন সেখানকার একটি বাড়ির দরজার একটি পাল্লা খুলে আহত নজরুলকে শুইয়ে দেওয়া হয়।

ওই বাড়ির কূপের পানি তোলার রশি নিয়ে বাঁশ দিয়ে দরজার পাল্লা বেঁধে দুজন কাঁধে করে নজরুলকে জলডাঙ্গা বিএসএফ ক্যাম্প নিয়ে যান। নজরুলের অবস্থা ভালো না হওয়ায় ক্যাম্পের (পারিলা দোরগঞ্জ) ডাক্তার ড্রেসিং করে দ্রুত তাকে রায়গঞ্জ মিলিটারি হাসাপাতালের ভর্তি করার পরামর্শ দেন। তাৎক্ষণিক তাকে গাড়িযোগে রায়গঞ্জ পাঠিয়ে দিলেন। ১০/১১ দিন পর নজরুল সুস্থ হয়ে ফিরে ফের যুদ্ধে যোগ দেন।  
অক্টোবর মাসে আবার আগ্রাদ্বিগুনে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে দুশ’ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে অপারেশন করা হয়। এতে রাজাকার ও পাকবাহিনী নাস্তানাবুদ হয়। হতাহত হয় অনেক পাকসেনা ও রাজাকার । তারপর শক্ররা ক্যাম্প তুলে নিয়ে থানা হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যায়। 
এর পর অধীর চন্দ্র সাহা ও অন্যরা অপারেশন চালান সীমান্ত এলাকায় পাক বাহিনীর ক্যাম্পে। পাক বাহিনীর বেশ শক্ত বাংকার ছিল। রাজাকাররা বুঝতে পারে দেশ স্বাধীন হয়েই যাচ্ছে। পাক বাহিনীর পরিস্থিতি ভালো নয়। এই ভেবে অনেক রাজাকার গোপনে পালিয়ে এসে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে এবং পাকবাহিনীর ভেতরের কথা জানিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা মঙ্গলবাড়ী ক্যাম্পে আক্রমণ করলে কয়েকজন পাকসেনা মারা যায়। অনেক সেনা রাতের অন্ধকারে নওগাঁর দিকে পালিয়ে যায়। 
দেশ স্বাধীন হবার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা অধীর চন্দ্র শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। শিক্ষার্থীদের পাঠদানের পাশাপাশি সুযোগ পেলে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিময় গল্প শোনাতেন। লাল-সবুজের পতাকার জন্য গর্ববোধ করেন তিনি।

×