ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

সীমান্ত এলাকায় বহু অপারেশনে অংশ নেই

মাহমুদুল আলম নয়ন, বগুড়া অফিস

প্রকাশিত: ০০:৩৯, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

সীমান্ত এলাকায় বহু অপারেশনে অংশ নেই

মোখছুদুর রহমান ঠাণ্ডু

বয়স অল্প ছিল বলে বাবা রাজি ছিলেন না। মা বললেন, মরতে তো হবেই, দেশের জন্য যুদ্ধ করেই মরবি। মায়ের সেই সাহসে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। রণাঙ্গন থেকেই খবর পাই বাবাসহ পরিবারের সাত সদস্য পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম বলেই আমার পরিবারের সাত সদস্যকে পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়। পরিবারের সদস্যদের এই মৃত্যুর জন্য এখনো নিজেকেই দায়ী মনে হয়।

পরক্ষণেই মনে হয়, দেশমাতৃকা তো স্বাধীন হয়েছে। বাবা, চাচা, ছোট ভাই ও চাচাত ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের জন্য শোক জানাতে ওই সময় গিয়েও থাকতে পারিনি। দাফন শেষেই এক বুক ব্যথা নিয়ে ফের চলে যাই রণাঙ্গনে। বিজয়ের মাত্র এক মাস পাঁচ দিন আগে পরিবারের ওই সাত সদস্যকে হারাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের যাতায়াত ছিল বাড়িতে। রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পেয়ে পাক হানাদার বাহিনী গ্রাম ঘেরাও করে ‘পীরবাড়ির সাতজন ছাড়াও একই দিন গ্রামের আরও চারজনকে পবিত্র রমজান মাসে গুলি করে হত্যা করেছিল। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে পরিবার হারানোর স্মৃতিচারণ করেন রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোখছুদুর রহমান ঠা-ু।
বগুড়ার গোকুল ইউনিয়নের রামশহর পীরবাড়ির ছেলে ঠাণ্ডু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় ছিলেন একাদশ শ্রেণির ছাত্র। পীরবাড়ির প্রভাবও ছিল বেশ। কলেজের শিক্ষার্থী হলেও ছোটখাটো গড়নের কারণে তাকে বয়সে ওই সময় আরও ছোট মনে হতো। পড়তেন বগুড়া শাহসুলতান কলেজে। ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা। তবে এত দ্রুত যে তাকে যুদ্ধের ময়দানে যেতে হবে সেটি ভাবনায় ছিল না।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর বগুড়ায় প্রতিরোধযুদ্ধে নিজ এলাকায় গ্রামবাসীর সঙ্গে যোগ দিলেও যুদ্ধে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি খুব একটা ছিল না। তবে পরিবারের কয়েকজন সদস্য মাতৃভূমি হানাদারমুক্ত করতে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। তাদের মধ্যে ছিলেন চাচাত ভাই জিল্লুর রহমান, ভাগ্নে তোফাজ্জল হোসেন, চাচা এবং আরও দুই চাচাত ভাই। তবে প্রস্তুতি ক্যাম্পে গিয়েও এক চাচাত ভাই খলিলুর রহমান এবং আরেক চাচা হাবিবর রহমান পারিবারিক কারণে শেষ পর্যন্ত প্রশিক্ষণের জন্য ভারত যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।

আর ঠা-ু যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পীরবাড়ি হলেও বাড়ির সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের সমর্থক ও মুক্তিবাহিনীর পক্ষে। যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পরিবারের অনুমতি তো লাগবে। সে জন্য বড় ভাই আলতাফ হোসেনের কাছ থেকে অনুমতি আদায় সহজ হবে বলে তার কাছেই প্রথম বিষয়টি জানান। পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে কতোটা টেকা যাবে তা নিয়ে বড় ভাই ছিলেন সংশয়ে। তাই বলেছিলেন নিজ দায়িত্বে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।

এটাকে ভাইয়ের অনুমতি হিসেবে ধরে বাবাকে বললে ছোট বলে তিনি মত দেননি। তবে চারদিকে মৃত্যুর খবর প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকায় মা রোকেয়া বেগম বলেছিলেন, মরতে হলে দেশের জন্য যুদ্ধ করেই মারা যাওয়া ভালো। মায়ের এই কথায় সাহস পেয়েছিলেন তিনি। বগুড়া থেকে প্রথম পর্যায়ে যারা ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ঠা-ু ও তার সঙ্গীরা ছিলেন অন্যতম।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোখছুদুর রহমান ঠাণ্ডু বলেন, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে আমি, বৃন্দাবনপাড়ার মোজাম, চাচাত ভাই জিল্লুর রহমান, ভাগ্নে তোফাজ্জল হোসেন ও আরেক চাচাত ভাই আব্দুস সালাম মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের উদ্দেশে রওনা হই। জানি না কোথায় যেতে হবে, পথঘাটও আগে থেকে চিনি না। হেঁটেই রওনা হই ভারতের উদ্দেশে। সঙ্গে শিবগঞ্জ এলাকা থেকে আরও একজন যাওয়ার কথা থাকলেও পারিবারিক কারণে না যাওয়ায় কিছুটা সমস্যা হয় আমাদের পাঁচজনের। তবে দমে যাইনি। ২০ এপ্রিল বাড়ি থেকে যাত্রা শুরু করে অনেক বন্ধুর পথ পেরিয়ে দুদিন পর যখন হেঁটে ভারতের মঙ্গলবাড়ী সীমান্তে পৌঁছাই, তখন শক্তি প্রায় নিঃশেষ।

পা ফুলে কলাগাছ। চাচাত ভাই আব্দুস সালাম কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে আমরা হয়ে যাই চারজন। সীমান্ত পার হয়ে আমরা মিশে যাই শরণার্থীদের সঙ্গে। তার পর জিজ্ঞাসা করতে করতে জানতে পারি বালুরঘাটে কামারপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প রয়েছে। অবশেষে পৌঁছাই সেখানে। ক্যাম্পটি একটি স্কুলে। সেখানে বগুড়া থেকে প্রশিক্ষণের জন্য যাওয়া আব্দুস সামাদসহ (ক্যালা সামাদ) আরও মুক্তিযোদ্ধাকে দেখতে পাই। সেখানে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে পাঠানো হয় রায়গঞ্জ ট্রেনিং ক্যাম্পে।

সেখানে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাইফেল, এসএমজি ও এলএমজি চালানো প্রশিক্ষণ নেই। এখান থেকে পাঠানো হয় শিলিগুড়ির পানিঘাটা ক্যাম্পে। সেখানে গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গেরিলা যুদ্ধের কৌশলসহ মাইন সেটিং ও বিস্ফোরক দ্রব্যের অন্যান্য প্রশিক্ষণ নেই। জুনের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই পানিঘাটার প্রশিক্ষণ শেষে যাই কুরমাইল অপারেশন ক্যাম্পে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ঠা-ু বলেন, আমাদের ৩৩ জনের কমান্ডার ছিলেন ফজলুল আহসান দিপু। এখান থেকে আসল যুদ্ধ শুরু হয়। ক্যাম্প কমান্ডার ক্যাপ্টেন অশোক খোদ সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় পাকবাহিনীর একটি টিমের ওপর হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। খবর ছিল- পাকবাহিনী একটি স্কুলে অবস্থান করছে। আমাদের ৩০/৪০ জনের মুক্তিযোদ্ধা দল অপারেশনের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে দেশের ভেতরে ঢুকি। রাত তখন প্রায় ১০টা। পানি, কাদা ভেঙে অবস্থান নিই স্কুলের কাছে একটি আইলের ওপর। চারদিকে চুপচাপ।

কমান্ডার নির্দেশ দেন, পাঁচ মিনিট পর পর দু’বার গুলি চালানোর। দু’দফা গুলির পরও একই অবস্থা। তবে এর কিছু পরেই হঠাৎ করে পাকসেনাদের অবস্থান থেকে ৫/১০টি মেশিনগান দিয়ে ঝাঁক ঝাঁক গুলি। একপর্যায়ে তারা আলো নিক্ষেপ করে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানার চেষ্টা চালায়। এ সময় আমরা মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা গুলি চালালেও হানাদার বাহিনীর মেশিনগানের অবিরাম গুলির সামনে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। তবে এর পরও আমাদের টিম সীমান্ত এলাকায় বহু অপারেশন করি। এর কিছুদিন পরেই কুরমাইল থেকে কালিয়াগঞ্জ হয়ে ট্রেনে ধুবড়ি আসি। সেখান থেকে নিজ জেলায় যুদ্ধের জন্য দেশে আসি।

তখন আমাদের গ্রুপে দুজন পুলিশ, একজন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য এবং একজন ইপিআর সদস্য যোগ দেন। আমরা চলে আসি মানকার চরে। সেখান থেকে জুলাইয়ের প্রথমদিকে নৌকায় বগুড়ার সারিয়াকান্দির হাটশেরপুর আসি। ৩/৪ দিন পরে সিদ্ধান্ত হয়, সারিয়াকান্দি থানা আক্রমণ করা হবে। কমান্ডার দীপু ভাই এ জন্য আমাকে রেকিতে পাঠান। পরের রাতে আমরা থানা ঘিরে সফল আক্রমণ চালিয়ে ফিরে আসি।
মুক্তিযোদ্ধা ঠা-ুু জানান, আমাদের গ্রুপ অনেক সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে ছিল সারিয়াকান্দির রামচন্দ্রপুর যুদ্ধ। আগস্টের প্রথমদিকে হবে। আমাদের কাছে খবর আসে, পাক হানাদার বাহিনী রামচন্দ্রপুর গ্রামে হামলা চলাবে। খবর পেয়ে আমরা সেখানে  গিয়ে অবস্থান নিই। সেখানে অবস্থানকালে আমাকে আরেক জায়গায় মাইন স্থাপনের জন্য পাঠানো হয়েছিল। পাকবাহিনীর এক মেজরের হাটশেরপুরে গাড়ি নিয়ে আসার খবরে রাস্তায় মাইন পাতি আমি।

তবে সে অপারেশন সফল হয়নি। সেখান থেকে রামচন্দ্রপুরের অবস্থানে সঙ্গীদের সঙ্গে খেতে বসার সময় খবর পাই, পাক হানাদার বাহিনী আসছে। গ্রুপের অন্য সদস্যরা আগে চললেও খাওয়া শেষে অস্ত্র নিয়ে তৈরি হতে আমার দেরি হয়। এতে দলছুট হয়ে পড়ে সামনের দিকে এগোতে থাকি। হঠাৎ করে মুখোমুখি হই পাকবাহিনীর। শুয়ে পড়ে আড়াল হওয়ার চেষ্টা করি। একা কী করব, বুঝতে না পেরে প্রথমে ফাঁকা গুলি ছুড়ি। এ সময় পাকবাহনী আমার অবস্থান লক্ষ্য করে লাগাতার গুলিবর্ষণ শুরু করে।

আমি ক্রল করে আগের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে দেখতে পাই, পাকবাহিনীর কয়েক সদস্য খড়ের পালার আড়ালে লুকিয়ে। এটি দেখে আর ভুল করিনি। লক্ষ্য নির্ধারণ করে নির্ভুল লক্ষভেদী গুলি চালাই। এতে তিনজন পাকসেনা গুলিবিদ্ধ হয়। এরই মধ্যে সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধারা চলে এসে ফায়ার শুরু করেন। এতে টিকতে না পেরে পাক বাহিনী একটি লাশ ফেলে পিছু হটে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ঠা-ু স্মৃতি হাতড়ে বলেন, সারিয়াকান্দি থেকে আমরা আবার ১১ জনের একটি গ্রুপ সদর এলাকায় চলে আসি। অবস্থান নিই দাড়িয়াল এলাকায়। এখান থেকে আরও কয়েকটি গ্রুপের সঙ্গে রাজাকারদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযান চালাই। আরেকটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ ছিল চাঁদমুহা সরলপুর এলাকার যুদ্ধ।

পাকহানাদার বাহিনীর কয়েক সদস্য একটি ঈদগাহের উঁচু জায়গায় অবস্থান নিয়েছিল। সেখানে আমাদের গ্রুপ আক্রমণ চালায়। তবে এই যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর দুজন নিহত হলেও আমাদের দুই মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হয়েছিলেন। এরা হলেন নামাজগড় এলাকার বাবলু ও আজিজার নামে আরেক মুক্তিসংগ্রামী।

×