ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

কালিয়ানে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধে ১২ পাকসেনা নিহত হয়

মোঃ লুৎফর রহমান, সাঁথিয়া, পাবনা

প্রকাশিত: ০০:৩১, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

কালিয়ানে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধে ১২ পাকসেনা নিহত হয়

রেজাউল করিম

বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ রক্তে লেখা মহাকাব্য। এ কাব্যের সোনালি পাতায় বীরত্বগাথা কথামালা শ্রবণে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। এক সাগর রক্ত, লাখো শহীদের আত্মত্যাগ, বহু মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতা। দেশমাতৃকার মুক্তির মহানায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধারা। দেশের জন্য বীরত্বপূর্ণ ও জীবনবাজি রাখায় মুক্তিসেনারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আত্মত্যাগে বলীয়ান হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এ দেশের লাখো মুক্তিসেনা। তাদেরই একজন সাঁথিয়া পৌর সদরের ৪নং ওয়ার্ডের বোয়াইলমারী গ্রামের মেহের প্রামাণিকের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম।

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম বলেন, ১৯৭১ সালে আমি দশম শ্রেণির ছাত্র। তখন তরুণ ছাত্রনেতা রাকসুর সাবেক ভিপি অধ্যাপক আবু সাইয়িদের নেতৃত্বে সরকারবিরোধি সকল কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। ২১ মার্চ আমি, আলতাব ও লোকমান ৫০০ জাতীয় পতাকা নিয়ে আসি নেতার কাছ থেকে। বাংলাদেশের মানচিত্রসহ প্রথম জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয়। আমাদের সহযোগিতা করেন সিরাজুল হক প্রাং, সৈয়দ আলী খান, শ্রী অসিত কুমার দাসসহ অনেকে।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ৭ মে লোকমান আর আলতাব এসে বলল, তুমি ভারত প্রশিক্ষণে যাবে কিনা? আমি সম্মতি জানাই। সেদিন সকালে রিক্সাযোগে সাঁথিয়া থেকে মাধপুর আসি। গাড়িতে করে পাবনা ক্যালিকো মিলের কাছে নামি। সেখান থেকে হেঁটে পদ্মাপাড়ে যাই। পদ্মাপাড় থেকে শরণার্থীদের নৌকায় উঠে কুষ্টিয়ায় কালীবাড়ি বটগাছের নিচে আসি। তখন রাত ৯টা হবে। প্রচ- ক্ষুধার্ত। তার পরও সাত মাইল হাঁটার পর জঙ্গলের মধ্যে একটি বাড়ি দেখতে পাই।

বাড়িতে শুধু বৃদ্ধ এক মা। তিনি আমাদের কিছু মুড়ি ও গুড় খেতে দিলেন। একটু বিশ্রাম নিয়ে ভোর ছয়টায় আবার হাঁটতে থাকি। সারাদিন হাঁটার পর ভারতের প্রথম সীমানা পাই। এরপর বিএসএফ ক্যাম্পে গেলে তারা আমাদের রুটি ও পেয়ারা খেতে দেন। পরে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। পথিমধ্যে ভারতের কেচুয়াডাঙ্গা বাজার। বাজারে রফিকুল ইসলাম বকুল ও গোলাম আলী কাদরির সঙ্গে দেখা হলো। উনারা আমাদের দেখে খুব খুশি হলেন। বকুল ভাই ছিলেন ওই ক্যাম্পের প্রধান। তাাদের সঙ্গে ক্যাম্পে গিয়ে খাবার শেষে বিশ্রাম নেই।
বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম বলেন, পরেরদিন সকালে ক্যাম্পের ইনচার্জ বাঁশিতে ফুঁক দিলে লাইনে দাঁড়াই। কেচুয়াডাঙ্গা হতে করিমপুর প্রতিদিন ৬-৮ মাইল দৌড়াই। কয়েকদিন পর, হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম বালুরঘাট সাইয়িদ ভাইয়ের ক্যাম্পে চলে যাব। শেষে জলঙ্গী থেকে ট্রেনে উঠে ফারাক্কা স্টেশনে নামি। ওখানে রাতযাপন করি। পরের দিন লঞ্চযোগে ফারাক্কা-পদ্মা পার হয়ে গাড়িতে বালুরঘাট পৌঁছাই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি ও জিএস, শাহজাদপুরের এমসিএ আব্দুর রহমান ও সাইয়িদ ভাই বালুরঘাট ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। ১০-১২ দিন এখানে অবস্থানের পর ভারতের পাতিরামপুরে স্থাপিত পাবনা জেলার নতুন ক্যাম্পে তাঁবু টানাই। প্রায় ২০ দিন ভোরে উঠে কুচকাওয়াজ করি।
৩১ জুলাই, সাইয়িদ ভাই আমাদের উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য পাতিরামপুর হতে শিলিগুড়ি ক্যাম্পে পাঠায়। শুরু হলো প্রশিক্ষণ। ভোরে বাঁশির শব্দে লাইনে দাঁড়াই। জাতীয় সংগীত গাই। সেখানে গেরিলা ট্রেনিং, রাইফেল ট্রেনিং, এক্সপ্লোসিভ ট্রেনিং, গ্রেনেড ট্রেনিং, ব্রিজ ভাঙা ট্রেনিং ও স্কুল ক্লাস ট্রেনিং করি। দিনরাত ২৪ ঘণ্টার ২০ ঘণ্টাই আমাদের ব্যস্ত রাখা হতো। ৪০ দিন ট্রেনিং শেষে পানিঘাটা নিয়ে চাঁদমারি করানো হতো।
আমরা ট্রেনিং শেষ করে পানিঘাটা থেকে রাজশাহী কলা বাগানের  ক্যাম্পে চলে আসি। ৫-৭ দিন থাকার পর রাজশাহী ভোলাহাট থানায় আসি। এখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে ভোলাহাট থেকে প্রায় ১০ মাইল দূরে দলদলি ডিফেন্স ক্যাম্পে যাই। এই ক্যাম্পের ইনচার্জ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও মেজর গিয়াস।
তিনি আরও বলেন, সকালে বাঁশির শব্দে দৌড়ে লাইনে দাঁড়ালাম। সাতজনের একটি করে গ্রুপ করা হলো। পাসওয়ার্ড ছিল ‘রাজা’। তুমি কে? আমি ‘রাজা’ বুঝতে হবে মুক্তিবাহিনী, অন্যসব সন্দেহজনক। শুরু হলো আমাদের জীবন-মরণের যুদ্ধ। পরনে হাফপ্যান্ট, খালি গা। সঙ্গে গুলির ব্যাগ, ওজন ৩৫ কেজি, রাইফেল একটা, স্টেনগান একটা। কনকনে শীত, রাস্তায় পানি, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলতে থাকি। ক্যাপ্টেন ফায়ার করার নির্দেশ দিলেন।

বৃষ্টির মতো গুলি শুরু হলো। পরে বোঝা গেল, রাজশাহী থেকে ১০-১২টা লঞ্চভর্তি রাজাকার, মিলিশিয়া ও পাকি সেনারা পাকিস্তান জিন্দাবাদ, ইয়াহিয়া জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে দিতে আসছিল। আমি ছিলাম সম্মুখযোদ্ধা। আমাদের কাজ ছিল ফায়ারিং করতে করতে সামনে এগিয়ে যাওয়া। কভারিং করত অন্য গ্রুপ। এভাবে পাঁচ মাইল এলাকা দখলে নেই।
বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম বলেন, দেশ, মা-মাটি ও মানুষকে রক্ষার জন্য জীবন বাজি রেখে বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ করেছি। এভাবে বেশকিছু দিন কাটার পর আমাদের ৭ নম্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টারে আনা হলো। সেখানে প্রায় ১০ দিন অবস্থান করি। ২০ অক্টোবর ভারতের বর্ডার মানকের চরে পৌঁছি। মানকের চরের ক্যাম্প থেকে আমাদের কমান্ডার নিজাম উদ্দিনকে কিছু টাকা দিলেন। সে টাকা দিয়ে চিড়া, গুড় ও কিছু চাল কিনে নৌকা ভাড়া করে শাহজাদপুরের উদ্দেশে রওনা হলাম।

আমাদের দল তালগাছির পাশ দিয়ে নগরবাড়ী-বগুড়া রোড পার হয়ে ফরিদপুর থানার বিলাঞ্চলের বারোআনি গ্রামে অবস্থান করি। ধুলাউড়ি, নূরদহ, বিলচাড়ি ও আশপাশের কয়েক গ্রামে বেশকিছু দিন থাকি। এখানে অবস্থানের সময় ৯ নভেস্বর সকালের দিকে হঠাৎ খবর পেলাম পাকি সেনারা বাঘাবাড়ী ডেমরা হয়ে ফরিদপুর থানার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এমন সুযোগের অপেক্ষাতেই সবাই ছিলাম। আশপাশের কয়েক গ্রুপ একত্রিত হয়ে ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধার দল হলো। সকলে মিলে ধাওয়া করে কালিয়ান এলাকায় যুদ্ধ শুরু হলো।

দুপুর থেকে কয়েক ঘণ্টা অবিরাম যুদ্ধ চলার পর সন্ধ্যায় থেমে গেল। যুদ্ধে শত্রুসেনাদের ১২ জন নিহত এবং সাত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এরপর ৮ ডিসেম্বর সকাল সাতটায় স্থানীয় জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় তিনশ’ মানুষ সাঁথিয়া থানা আক্রমণ করে দখল করে অস্ত্র লুটে নেওয়া হয়। পরে নিজাম উদ্দিন ও আয়েজ উদ্দিনকে গার্ড অব অনার প্রদান করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৯ ডিসেম্বর মিলিশিয়া, এদেশীয় দোসর, রাজাকার ও পাকি সেনাদের গাড়ি সাঁথিয়ার দিকে আসতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে শত্রুদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে।

শত্রুসেনারা সামনে অগ্রসর না হয়ে বকুলতলা নামে স্থানে অবস্থান নিয়ে পাল্টা গুলিবর্র্ষণ করে। আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে সন্ধ্যার দিকে শত্রুসেনারা জিপ, ট্রাক ফেলে পালিয়ে পাবনায় ফিরে যায়। ৯ ডিসেম্বর সাঁথিয়া হানাদারমুক্ত হয়। তার কিছুদিন পরেই শত্রুরা পরাজিত হলে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা।
অতঃপর বঙ্গবন্ধু সরকারের নির্দেশে আমরা ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সম্মুখ যোদ্ধারা পাবনায় মিত্রবাহিনীর কাছে অস্ত্র জমা দেই।

×