
ঢাকা থেকে ২৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহরের নাম পানাম নগরী। এটি এখন পর্যটনের নগরী হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। এখনে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের হাজারো পযর্টক ঘুরতে আসেন। এবছরও ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে বুধবার ও বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাজারো দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। এতে কর্তৃপক্ষ পযর্টকদের সামাল দিলে হিমশিম খেয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ব সূত্রে জানা যায় : পানাম নগরীর ৫ মিটার প্রশস্ত ও ৬শ’ মিটার দীর্ঘ একটি সড়কের দু’পাশে এক তলা, দ্বিতল ও তিনতলা ৫২টি পুরনো ভবন রয়েছে। এসব ভবনের মধ্যে ১৩ নম্বর ভবনটি প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরে নিজস্ব অর্থায়নে দক্ষ কারিগর দ্বারা সংস্কার করে আদিরূপ ফিরে আনা হয়েছে। বাকি ভবনগুলো দক্ষ কারিগরের অভাব ও অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এখন সংস্কার করা হয়নি। তবে এগুলোর বেশিরভাগই ধ্বংসপ্রাপ্ত। এর মধ্যে কয়েকটি ভবনের মালিকানা নিয়ে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে মামলাও চলমান। পানাম নগরকে সরকার ২০০৩ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে গেজেটভুক্ত করে ২০১৫ সালে ৬ অক্টোবর পর্যটকদের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় : পানাম নগরীকে নতুন সাজে সাজানো হয়েছে। প্রতিটি ভবন রয়েছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। পানাম নগরীতে ঘুরতে আসা দর্শনাথীদের নিরাপত্তার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ, আনসার, থানা পুলিশসহ প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের কর্মকর্তারা যৌথভাবে কাজ করছেন। ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে পানাম নগরী ও বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনসহ আশপাশ এলাকায় দেশ-বিদেশ থেকে ঘুরতে আশা প্রায় ১৫ হাজার দর্শনাথী সমাগম ঘটে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোনাকপাট, আবাসিক হোটেলসহ বাসা বাড়িতেও রয়েছে প্রচুর পর্যটকদের ভিড়। এতে পানাম নগরীসহ আশপাশ এলাকায় তীব্র জানযটের সৃষ্টি হয়।
পানাম নগরীর ইতিহাস-ঐতিহ্য : ১২৮১ খ্রিস্টাব্দ থেকে সোনারগাঁয়ে মুসলিম আধিপত্যের সূচনা। ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের সময়ে সোনারগাঁ স্বাধীন সুলতানি আমলে বাংলার রাজধানীর মর্যাদা পায়। তার পর পর্যায়ক্রমে শামস্ উদ্দীন ইলিয়াস শাহ, সিকান্দার শাহ, গিয়াস উদ্দীন আজম শাহ, শামসুদ্দীন হামজা শাহসহ আরও অনেক শাসক শাসনকার্য পরিচালনা করে বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেন। তবে বারভূঁইয়ার প্রধান ঈশাখাঁর সময়কালে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে সোনারগাঁ বিশেষ স্থান দখল করে। সেই সময়ে শাসকদের রাজকার্য পরিচালিত হতো পানাম নগরী থেকে। তাই রাজকার্য পরিচালনার পাশাপাশি আমির-ওমরাহদের জন্য পানাম ও এর আশপাশের গ্রামে গড়ে উঠেছিল পাকা ইমারতরাজি।
পানামে ছিল অসংখ্য প্রাচীন ইমারত। এখানে সরু রাস্তার দুই পাশে গড়ে উঠেছিল অট্টালিকা, সরাইখানা, মসজিদ, মন্দির, মঠ, ঠাকুরঘর, গোসলখানা, কূপ, নাচঘর, খাজাঞ্চিখানা, টাকশাল, দরবার, গুপ্তপথ, প্রশস্ত দেয়াল, প্রমোদালয় ইত্যাদি। পানাম নগরীতে দেখা যায় ৪০০ বছরের পুরনো মঠবাড়ি। এর পশ্চিমে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যকুঠি (নীলকুঠি)। রয়েছে পোদ্দারবাড়ি, কাশিনাথের বাড়ি, আর্টগ্যালারিসহ অনেক প্রাচীন ভবন। তবে এখন বেশিরভাগই জীর্ণ, ভগ্নাবশেষ অবস্থায়। পানামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পঙ্খিরাজ খাল। এ খাল পানামের গুরুত্বপূর্ণ সব ভবন ছুঁয়ে পূর্ব দিকে মেনিখালি নদ হয়ে মেঘনায় মিশেছে। খালের ওপর আদমপুর বাজারের কাছে রয়েছে মোগল আমলের সেতু (পঙ্খিরাজ সেতু)। তিনটি খিলানের ওপর নির্মিত এ সেতু ১৪ ফুট প্রশস্ত। তলদেশ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২৮ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ১৭৩ ফুট। এ সেতুটি কে কখন নির্মাণ করেন তার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। শের শাহের আমলে নির্মিত সোনারগাঁ থেকে সিন্ধু পর্যন্ত প্রায় ৩০০ মাইলের ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের কিছু অস্তিত্ব পানামে আজও দৃষ্ট হয় বলে হাল আমলে তা পাকা করা হয়। সম্প্রতি সরকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে এ সেতু দিয়ে চলাচল বন্ধ করে এর পাশে একটি বাইপাস কালভার্ট নির্মাণ করেছে। খালের অনেক অংশ প্রায় স্থানীয়রা দখল করে রেখেছে। চতুর্দশ শতকে পানাম ও এর আশপাশের গ্রামে বিকশিত হয়েছিল সমৃদ্ধ চারুকারু শিল্পের। যে শিল্পের কারণে পানামের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল উপমহাদেশের গন্ডি ছাড়িয়ে পাশ্চাত্যেও। বিশ্বখ্যাত মসলিনের আদিস্থান ছিল সোনারগাঁয়ে। পানাম নগরী ছিল মসলিনের বিশাল আড়ং। পৃথিবীবিখ্যাত মসলিন শবনম, মলমুলখাস, আব-ই-রওয়া উৎপাদিত হতো পানাম নগরের আশপাশ ঘিরেই। জেমস টেলরের মতে, আড়ংয়ের তাঁতখানা সোনারগাঁয়ের পানামে ছিল এবং মসলিন শিল্প ক্রয়-বিক্রয়ের এক প্রসিদ্ধ বাজার ছিল এ নগরে।
যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে ২৬ কিলোমিটার পূর্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা হয়ে উত্তর দিকে পর্যটন নগরী সোনারগাঁয়ের পানাম নগরীর অবস্থান। ঢাকা থেকে বাসে কিংবা প্রাইভেটকারে সোনারগাঁয়ে যাওয়া যাবে। সময় লাগবে বাসে এক থেকে দেড় ঘণ্টা এবং প্রাইভেটকারে আধা থেকে এক ঘণ্টা। ঢাকায় গুলিস্তান এসে হকি স্টেডিয়ামের পাশে বাস কাউন্টার রয়েছে। এখান থেকে ঢাকা-মেঘনা সড়কের দোয়েল সার্ভিস, স্বদেশ পরিবহন, বোরাক বাসে চড়ে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তায় নামতে হবে। বাস ভাড়া ৫০-৫৫ টাকা। এছাড়া প্রাইভেটকারেও আপনি আসতে পারেন।
কোথায় থাকবেন : ঢাকা থেকে সোনারগাঁয়ে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সাধারণত থাকার পরিকল্পনা থাকে না। ঢাকার খুব কাছাকাছি বলে একদিনে আপনি ঘোরাঘুরি শেষে আবার বাসায় ফিরে যেতে পারবেন। দেশ/ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যারা এখানে বেড়াতে আসেন তারা অনেক সময় থাকতে চান। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য হলো- এখানে একটি থ্রি স্টার মানের ‘সোনারগাঁ রয়েল রিসোর্ট’ নামে একটি রিসোর্ট রয়েছে। এটি পানাম নগরীর পাশেই খাসনগর দীঘিরপাড় এলাকায় অবস্থিত। এখানে রাতযাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে থাকতে হলে আগেই বুকিং দিতে হবে। এছাড়া বেসরকারী উদ্যোগে একটি রেস্ট হাউস রয়েছে এখানে। সেটি এমএ সাত্তার কেন্দ্রীয় গণবিদ্যালয় (বেইস)। এখানে অনেকগুলো মনোরম কক্ষ রয়েছে। জাদুঘর সংলগ্ন খাসনগর দিঘীরপাড় ইছাপাড়া গ্রামে এর অবস্থান। এছাড়া সরকারী অতিথিদের জন্য জাদুঘর ও উপজেলা প্রশাসনের নিজস্ব গেস্ট হাউস বাংলো রয়েছে।
পানাম নগরীতে কুমিল্লার লাকসাম এলাকা থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা কবির হোসেন বলেন (৪০), সব সময় পড়েছি ও শুনেছি পানাম নগরীর ইতিহাস। ব্যস্ততার কারণে পরিবারদের নিয়ে আসতে পারিনি। এসে দেখলাম পানাম নগরী সাক্ষী হয়ে আছে সোনারগাঁয়ের ঈসা খাঁর রাজধানী ইতিহাস-ঐতিহ্য।
ফরিদপুর থেকে আসা রুজিনা আক্তার (৩০) বলেন, ঈসা খাঁর শাসন আমলের বাংলার রাজধানীর ইতিহাস-ঐতিহ্য অনেক পড়েছি। সবসময় স্বপ্ন দেখতাম কেমন জানি সে সোনারগাঁয়ের রাজধানী ছিল। আজ বাস্তবে এসে দেখলাম এত সুন্দর একটি শহর ছিল সেই শহরটি আজও সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যদি সরকার এই শহরের পুরনো ভবনগুলো সংস্কার করে আদিরূপে ফিরিয়ে আনতে পারে পর্যটন নগরী হিসেবে বিশে^র মধ্যে প্রথম পর্যটন নগরী হিসেবে রূপান্তরিত হবে বলে মনে করেন তিনি। ময়মনসিংহ জেলা হালুয়াঘাট থেকে আসা বৃদ্ধা কুদ্দুস মিয়া বলেন, জীবনের শেষ দিকে এসে হলেও পানাম নগরীতে আসতে পেরেছি। পানাম নগরীর পরিবেশ দেখে অনেক শান্তি লাগছে।
ঢাকার যাত্রবাড়ী থেকে ঘুরতে আসা মোহাম্মদ হোসেন জানান, পানাম নগরী দেখে অনেক ভাল লাগল। পরিবারের সবাই এখানে এসে অনেক খুশি। ব্যস্ত যান্ত্রিক নগরীর একঘেয়েমিতা দূর করতে উপযুক্ত দর্শনীয় স্থান হলো পানাম নগর। কিন্তু আশপাশের দোকানে খাবারের দাম অনেক বেশি এবং গাড়ি ভাড়া জিম্মি করে অতিরিক্ত আদায় করছেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ী সেলিম মিয়া বলেন, করোনাকালীন সময় তেমন বেচা-বিক্রি হয়নি। বর্তমানে পানাম নগরীতে প্রচুর পর্যটক রয়েছে। তাই বেচা-বিক্রি অনেক ভাল।
পানাম নগরীতে দায়িত্বে থাকা সহকারী কাস্টডিয়ান কর্মকর্তা মোঃ সিয়াম চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর একটি করে ভবন নির্মাণে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে একটি সংস্কার করা হয়েছে। আরেকটি সংস্কার করা হচ্ছে। পানাম নগরী দর্শনার্থীদের জন্য সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৬টা পযন্ত খোলা থাকে। দেশের দর্শনার্থীদের জন্য ১৫ টাকা, বিদেশী দর্শনার্থীদের জন্য ১শ’ টাকা, সার্কভুক্ত দেশের দর্শনার্থীদের জন্য ৫০ টাকা এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের আবেদনের ভিত্তিতে ৫ টাকা টিকেট বরাদ্দ রয়েছে।
সোনারগাঁ ট্যুরিস্ট পুলিশের দায়িত্বরত অফিসার ইনচার্জ গোলাম কিবরিয়া বলেন, আমাদের যে জনবল রয়েছে তা দিয়ে পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। থানা পুলিশও আমাদের সহযোগিতা করে থাকে।
সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদ এলাহী জনকণ্ঠ বলেন, দর্শনাথীরা যাতে পরিবারদের নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরতে পারে সে জন্য পানাম নগরীসহ আশপাশ এলাকা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। পানাম সিটির পুরনো ভবন সংস্কার করে আদিরূপ ফিরে আনতে সরকার ইতোমধ্যে কাজ করছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা দিতে সবসময় কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
ফারুক হোসাইন, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ।