ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

যশোরে বড়দের স্কুল

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৬ নভেম্বর ২০১৯

যশোরে বড়দের স্কুল

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ পঞ্চাশোর্দ্ধ হাসিনা বেগম স্কুলে পড়েন। স্কুলে পড়েন ৪৮ বছরের হামিদা খাতুন ও ৪৫ বছরের ছকিনাও। তাদের এ স্কুলে যাওয়া শুধু খতা-কলমে সীমাবদ্ধ নয়। তারা জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেও শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছেন। লিখতে পড়তে তো পারেই, হাতের কাছের সরকারি নানা সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করতে শিখেছেন মেবাইলের ব্যবহারও। যশোর ইনফো ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাদের দিচ্ছে পুঁথিগত ও ব্যবহারিক শিক্ষা দিচ্ছেন। শিক্ষা গ্রহণের ফলে কর্মজীবনে নানাভাবে প্রতারিত মানুষগুলো খুঁজে পেয়েছেন আলোর দিশা। শুধু হাসিনা, হামিদা ও ছকিনা নয় ২০০৮ সালে এই প্রতিষ্ঠানটির শুরু থেকে এ পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি বয়স্ক নারী শিক্ষা নিয়েছেন। বর্তমানে এই কেন্দ্রের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২৯। যশোর শহরের শংকরপুর গোলাম প্যাটেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনটি কক্ষে সপ্তাহে ৬দিন বিকেলে চলছে বয়স্ক শিক্ষার এ কার্যক্রম। বিনামূল্যের এই বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। আবার অনেকে ব্যবসাও করেন। কিন্তু লেখাপাড়া না জানায় প্রতিনিয়ত নানাভাবে অন্যের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছিলেন তারা। তাই জীবনে চলার পথ সহজ করতে সারাদিনের কাজ শেষে পড়ন্ত বিকেলে আসেন এ শিক্ষা কেন্দ্রে। তাদের শেখানো হচ্ছে বাংলা, অংক, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান, ধর্ম, স্বাস্থ্য ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ছাড়াও মোবাইলের ব্যবহার। শেখানো হচ্ছে ৯৯৯, ৩০৩ ও ১০৯ এর মতো হট লাইনগুলোর সুযোগ সুবিধা। যাতে তারা হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি বিপদে আপদে সহজেই পেতে পারেন সরকারি সুযোগ সুবিধাগুলো। আর এর সুফলও পাচ্ছেন বলে জানালেন শিক্ষার্থীরা। হামিদা খাতুন (৪৮) বলেন, ছোট বেলায় লেখাপড়া করেছি সেটা এখন আর মনে নেই। এখন আমি থ্রিপিচ ও কাপড়ের ব্যবসা করি। কিন্তু হিসাব করতে পারতাম না। গত তিন বছর আমি এই শিক্ষা গ্রহণ করে এখন ভালোভাবে সবকিছু লিখে রাখতে পারি। প্রতিদিন বিকেলে আমরা সবাই স্কুলে আসি। এই শিক্ষা গ্রহণ করার ফলে আমাদের কেউ ব্যবসায়ে ক্ষতি করতে পারবে না। হাসিনা বেগম (৫৪) বলেন, গত চার বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে বাংলা, ইংরেজি, অংক ও ধর্ম শিক্ষা গ্রহণ করেছি। আমি যার কাছে যা পাবো তা হিসাব করে এখন নিতে পারি। আগে মোবাইল চালাতে পারতাম না, কিন্তু এখন পারি। সেই সঙ্গে অনেক কিছু শিখতে পারছি। ছকিনা (৪৫) বলেন, ছোট বেলায় বাবা মায়ের সংসারে অভারের কারণে পড়ালেখা করতে পারিনি। এখন এখানে পড়ি। আমার ফলের ব্যবসা আছে, সেখানে আমি এখন হিসাব লিখে রাখতে পারি। এসব বয়স্ক শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য কেন্দ্রে আছেন তিনজন শিক্ষক। যারা এখনও শিক্ষাজীবন শেষ করেননি। কোনো প্রকার বেতন ভাতা ছাড়াই কেবল মনের প্রশান্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তারা। শিক্ষক সোনিয়া খাতুন যশোর সরকারি মহিলা কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। তিনি বলেন, চার বছর ধরে আমি মা ও নানী বয়েসের মহিলাদের শিক্ষা দেই। এখানে যেসব শিক্ষার্থী আছে তারা খুব আন্তরিক ভাবে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাদের পড়াতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। শিক্ষক সালমা খাতুন উর্মি বলেন, আমি বিকেলে খেলাধুলা করে সময় পার করতাম। এখন বয়স্কদের পড়াতে পেরে অনেক ভালো লাগছে। শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু সহজে বোঝে না, কিন্তু কোনোকিছু শিখতে অপারগতা প্রকাশ করেন না। যখন পড়াই তখন তারা মনোযোগ দিয়ে পড়েন। সবকিছু ভালো ভাবে নেন। মুষলধারায় বৃষ্টিতেও তারা এসে ক্লাস করে। যশোর ইনফো ফাউন্ডেশনের সহ-সভাপতি হাবিব খান বলেন, শিক্ষার কোনো বয়স ইেন, সেই ধারণা থেকে কোন প্রকার অর্থ গ্রহণ ছাড়াই আমরা বয়স্ক শিক্ষার কার্যক্রম চালাচ্ছি। এখান থেকে যারা মোটামুটি শিখে যাচ্ছে তারাই বাইরে গিয়ে অন্যদের উৎসাহ দিয়ে এখানে পাঠাচ্ছেন। আমরা তাদেরকে ভর্তি করে নিচ্ছি। তারা সমাজের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হচ্ছে। যশোর ইনফো ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন সিদ্দিকী মিশু বলেন, ১১ বছর ধরে চলা এ কেন্দ্রটির কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে স্থায়ী অবকাঠামোর প্রয়োজন বলে জানালেন নেপথ্যের এ কারিগর। যেকোনো সরকারি জায়গা যদি আমাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়, তাহলে আমরা নিজস্ব অর্থায়নে বা কিছু টাকা-পয়সা জোগাড় করে ছোট-খাটো স্থাপনা গড়ে তুলতে পারি। যার মাধ্যমে দীর্ঘদিন আমরা এ কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারবো।
×