ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনুবাদ : আদিত্য শংকর

খুলে দাও ॥ সাদাত হাসান মান্টো

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৮ আগস্ট ২০১৭

খুলে দাও ॥ সাদাত হাসান মান্টো

বেলা দুইটার দিকে স্পেশাল ট্রেনটা অমৃতসর ছেড়ে আট ঘণ্টা পর মুঘলপুরে পৌঁছায়। কিন্তু পথিমধ্যে ট্রেন আটকিয়ে অনেক যাত্রীকে খুন করা হয়েছে। আবার অনেকে আহত হয়েছে, কিছু যাত্রী নিখোঁজও হয়েছে। পরের দিন সকাল দশটার দিকে সিরাজউদ্দিন যখন জেগে উঠলেন, দেখলেন তিনি রিফিউজি ক্যাম্পের ঠান্ডা মাটিতে শুয়ে আছেন। ক্যাম্পের পুরুষ, মহিলা ও শিশুর দল তাকে ঘিরে গিজগিজ করছে। এসব দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে শুয়ে রইলেন। তারপর ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ ধরে। ক্যাম্পে অনেক শব্দ হচ্ছিলো। কিন্তু বৃদ্ধ সিরাজউদ্দিন কিছুই শুনতে পাচ্ছিলেন না। এখন কেউ তাকে দেখলে মনে করবে তিনি হয়তো কোন কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন। কিন্তু তিনি আসলে কিছু নিয়েই ভাবছেন না। সিরাজউদ্দিন সূর্যের দিকে তাকানোর আগ পর্যন্ত ধূসর আকাশের দিকে নিস্পৃহ তাকিয়ে ছিলেন। সূর্যের তাপ তার শরীরের প্রতিটি স্নায়ুতে প্রবেশ করলো। তিনি উঠে গেলেন। তখনি তার চোখে ভেসে উঠলো একটা ভয়ংকর দৃশ্য। আগুন, লুটপাট, মানুষের ছোটাছুটি....একটা স্টেশনে প্রচ- গোলাগুলি...রাত এবং সখিনা। তিনি ভয় আর দুঃচিন্তা কাটিয়ে উঠে ভিড়ের মধ্যে পাগলের মত সখিনাকে খুঁজতে শুরু করলেন। টানা তিন ঘণ্টা তিনি ‘সখিনা, সখিনা’ ডেকে ক্যাম্পের এদিক-ওদিক খুঁজলেন। কিন্তু তিনি তার মেয়ের কোনো হদিশ পেলেন না। চারিদিকে একটা হট্টগোল ছিলো। তার মতো শরনার্থীদের অনেকেই তাদের শিশু, মা, স্ত্রী এবং কন্যাদের খুঁজছিলো। ক্লান্ত আর মনমরা হয়ে সিরাজউদ্দিন বসে বসে ভাবতে লাগলেন, কিভাবে তিনি সখিনাকে হারালেন। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে তার চোখে ভেসে উঠলো তার স্ত্রীর রক্তাক্ত দেহ। কী ভয়ংকর দৃশ্য! তিনি দেখলেন তার স্ত্রী বীভৎস্যভাবে মাটিতে শুয়ে আছে। এই দৃশ্য দেখে তিনি খেই হারিয়ে ফেললেন। সখিনার মা মারা গেছেন। সিরাজউদ্দিনের সামনে তাকে মারা হয়েছিলো। কিন্তু, সখিনা কোথায়? মৃত্যুর আগে সখিনার মা সিরাজউদ্দিনকে জোর গলায় বলেছিলেন, ‘আমার জন্য চিন্তা করো না। সখিনাকে নিয়ে এখনই পালিয়ে যাও’। সখিনা তার সাথেই ছিলো। তারা দুইজনই খালি পায়ে দৌড় দিয়েছে। দৌড়ানোর সময় সখিনার ওড়না পড়ে গিয়েছিলো। সিরাজউদ্দিন ওড়নাটা তুলতে চাইলে সখিনা চিৎকার করে বলে উঠেছিলো, ‘আব্বা, ওটা ওখানেই থাকুক!’ কিন্তু তিনি ওড়নাটা তুলে নিলেন। ঘটনাটা মনে পড়ার পর তিনি ওড়নাটা তার কোটের পকেট থেকে বের করলেন। সখিনার ওড়নাটা এখনও তার কাছে আছে। কিন্তু সখিনা কোথায় গেল? সিরাজউদ্দিন মনে করা চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি পারলেন না। সখিনা কি তার সাথে স্টেশনে পৌঁছাতে পেরেছিলো? সে কি তার সাথে ট্রেনে উঠেছিলো? ট্রেনে যখন দাঙ্গাকারীরা আক্রমণ করলো তখন কি তিনি বেঁহুশ হয়ে গিয়েছিলেন? তারা কি সখিনাকে অপহরণ করেছিল? তিনি তার প্রশ্নের কোনো উত্তর পাননি। সিরাজউদ্দিন সাহায্য ও শান্ত¡না চাচ্ছেন। কিন্তু তার চারপাশের সবাই-ই সাহায্য ও শান্ত¡না চাচ্ছে। তিনি কাঁদতে চাইলেন, কিন্তু তিনি চোখের পানি ফেলতে পারলেন না। কারণ, কান্না করার শক্তিই যে তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। কিছুদিন পর, সিরাজউদ্দিন আবারও সখিনাকে খুঁজতে শুরু করলেন। তিনি আটজন যুবকের সাথে কথা বললেন। এ যুবকরা তাকে সাহায্য করতে চায়। তাদের নিজস্ব একটা ট্রাক ও অস্ত্র আছে। তিনি তাদেরকে সখিনার বর্ণনা দিলেন, ‘সে দেখতে শ্যামলা কিন্তু অনেক সুন্দর। সে কেবল তার মায়ের দেখাশোনা করতো। তার চোখগুলো বড় এবং ডান গালে বড় তিল আছে। সে আমার একমাত্র মেয়ে। আল্লাহ তোমাদের ভালো করবেন যদি তোমরা তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনো।’ স্বেচ্ছাসেবক যুবকরা তাকে বিশ্বাস ও আন্তরিকতার সাথে বারবার আশ্বাস দিয়ে বলল যে, ওনার মেয়ে যদি বেঁচে থাকে তাহলে তারা কয়েকদিনের মধ্যে তাকে অবশ্যই খুঁজে বের করে আনবে। সেই যুবকেরা সখিনাকে খুঁজতে তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করলো। বিপদ আছে জেনেও তারা অমৃতসর গেলো। তারা অনেক পুরুষ, মহিলা আর শিশুদের উদ্ধার করতে সক্ষম হলো। উদ্ধারকৃত মানুষদেরকে তাদের পরিবার পরিজনকে খুঁজতেও তারা সাহায্য করলো। কিন্তু দশদিন খোঁজার পরও তারা সখিনাকে পেলো না। একদিন আরোও কিছু শরনার্থীকে সাহায্য করার জন্য যুবকরা অমৃতসর ফিরছিলো। যাত্রাপথে রাস্তার পাশে একটা মেয়েকে তারা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। মেয়েটা ট্রাকের ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনার সাথে সাথে দৌড় দিতে শুরু করলো। স্বেচ্ছাসেবকরা ট্রাক থামিয়ে মেয়েটার পিছে দৌড়াতে লাগলো। একটা মাঠে তারা তাকে ধরলো। মেয়েটা দেখতে সুন্দর এবং তার ডান গালে বড় তিল আছে। একজন যুবক তাকে বলল, ‘ভয় পেয়ো না। তোমার নাম কি সখিনা?’ তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেলো। সে কোন উত্তর দিলো না। যখন বাকি যুবকেরা তাকে তার বাবার কথা বারবার বলল তখন সে নিজেকে সিরাজউদ্দিনের মেয়ে হিসেবে পরিচয় দিলো। তারা সখিনার প্রতি দয়ালু মনোভাব দেখালো। তারা তাকে খাবার দিলো, ট্রাকে উঠতে সাহায্য করলো। তার কাছে ওড়না নেই বলে সকিনা লজ্জা পাচ্ছিলো। সে তার বাহু দিয়ে বারবার তার বুক ঢাকার চেষ্টা করলো। এরপর অনেকদিন পার হয়ে গেলো। সখিনার সম্পর্কে কোন সংবাদ সিরাজউদ্দিন পেলেন না। সখিনাকে খোঁজার জন্য প্রতি সকালে তিনি বিভিন্ন ক্যাম্প আর অফিস ঘুরে আসেন। কিন্তু তিনি তার সম্পর্কে কোনো তথ্যই পেলেন না। যেসব স্বেচ্ছাসেবক তার কাছে সখিনাকে ফিরিয়ে আনার কথা দিয়েছিলো তাদের সাফল্যের জন্য প্রতি রাতে তিনি দোয়া পড়তেন। একদিন ক্যাম্পে তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের দেখলেন। তারা ট্রাকের ভিতর বসেছিলো। ট্রাকটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে দিবে। তিনি দৌড়ে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা... তোমরা কি আমার সখিনাকে পেয়েছ?’ ‘আমরা তাকে খুঁজে বের করব। আমরা তাকে খুঁজে বের করব।’ কথাটা দুবার বলে তারা চলে গেলো। সিরাজউদ্দিন কিছুটা স্বস্তি পেয়ে আবারও তাদের সাফল্যের জন্য দোয়া পড়লেন। সেইদিন বিকেলে ক্যাম্পে একটা গোলমাল দেখা দিলো। সিরাজউদ্দিনের সামনে দিয়ে চারজন লোক একজন মানুষকে বহন করে নিয়ে গেলো। খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারলেন, তারা একটা মেয়েকে রেললাইনের পাশে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়েছিলো। উপায়ন্তর না দেখে তাকে ক্যাম্পে নিয়ে আসলো। তিনি তাদেরকে অনুসরণ করলেন। তারা মেয়েটাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। হাসপাতালের বাইরে সিরাজউদ্দিন কিছুক্ষণের জন্য একটা খুঁটির পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর তিনি ধীরে ধীরে হাসপাতালের ভেতরে গেলেন। স্ট্রেচারে মেয়েটার দেহ ছাড়া আর কেউ রুমে ছিলো না। তিনি মেয়েটার কাছে হেঁটে গেলেন। হঠাৎ কেউ লাইট জ্বালিয়ে দিলো। মেয়েটার গালে বড় তিল দেখে তিনি ‘সখিনা’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। যিনি লাইট জ্বালিয়েছিলেন তিনি একজন ডাক্তার। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’ তিনি সামান্য ফিসফিস করে বললেন, ‘আমি... আমি তার বাবা।’ মেয়েটার দিকে গিয়ে ডাক্তার তার নাড়ির গতি মাপলেন। তারপর তিনি সিরাজউদ্দিনকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘জানালাটা খোলো।’ স্ট্রেচারে থাকা মেয়েটার দেহ কিছুটা নড়ে উঠলো। সকিনা ব্যথাতুরভাবে তার হাত সালোয়ারের দড়ির দিকে আনলো। সে তার সালোয়ার ধীরে ধীরে খুললো। মেয়ের নড়াচড়া দেখে সিরাজউদ্দিন নিজের অজান্তেই আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘সে বেঁচে আছে। আমার মেয়ে বেঁচে আছে!’ তার চিৎকারে ডাক্তার ভয় পেয়ে গেলেন।
×