**কুমারখালীতে প্রিয় রোকোনালী
মাকিদ হায়দার
[কবি বাবলু জোয়ারদার, প্রীতিভাজনেষু]
যদি তাই হয় ফেরাবো নিজেকে
ভীষণ অস্থিরতার ভেতর রাত্রি যাপন করি
আমি আর আমার মাতুল
পরের বাড়িতে।
সেই অস্থিরতার ভেতরেই মাতুলকে জিজ্ঞেসিলাম
আপনি আমাকে
নিশ্চিত করে বলুন, আমাদের জিন্দাবাদ
এই দেশে থাকবে কিনা?
অদম্য সাহসী মাতুল ফিসফিসিয়ে জানালেন
নিশ্চয়ই থাকবে জিন্দাবাদ, যদি উচ্চলয়ে আজ
বলি কথা, হারামজাদা
চুক্তিযোদ্ধারা জেনে যাবে
তোর প্রিয় মাতুল আছে লুকিয়ে
কুমারখালীর সাহাবাবুদের
লুট করা লোহার সিন্দুকে
গতপরশু স্বপ্নে দেখি আমার হারানো কলকাতা,
কাছে এসে যেন বলছে আমাকে,
রোকোনালী তোর আশা হলো না পূরণ
রইলো না স্বর্ণেগড়া তোর জিন্দাবাদ
লুট করা লোহার সিন্দুকে মাতুলকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে
ঘরের বাইরে পা রাখতে না রাখতেই হঠাৎ
শুনি মাতুলের কঠিন আদেশ।
আজকেই তুই
করবি উদ্ধার আমার লুণ্ঠিত জিন্দাবাদ।
****হতচ্ছাড়া
জাফর ওয়াজেদ
হাতের মুঠোয় চলে আসা বিশ্বের মাঝখানে
আমরা ক’জন নবীন যুবা খ্যাতি যাদের হাতটানে
টানতে টানতে খসিয়ে দেই কলকব্জা যন্ত্রের
থাকনা ফারাক যতই তত্ত্বজ্ঞান ও মন্ত্রের
আমরা তবু হাঁক দিয়ে যাই, ডাক দিয়ে যাই
যেতে যেতে পাথুরে পথ দেখি চড়াই উৎরাই।
বন্ধুর পথ বন্ধুর আকাশ যতই ডাকুক
আমরা ক’জন ফাঁকতালে খুঁজি মোহসুখ
সুখের আছে নিয়মনীতি মনে মনে জপে
আকাশ বাতাস মাটিতে মিলায় শীতাতপে
আমরা তখন গাও গেরামে ঘুরি ফিরি
গাছ গাছালির ফাঁক ফোকরে খুঁজি সিঁড়ি
সিঁড়ির গোড়ায় সাপের বাসা ফণা তোলে
বিষের ভাঙ মারবে ছুড়ে উপহারে না ভোলে।
জল জঙ্গলে আমরা ক’জন শুকনো পাতার ধ্বনি
সুরের ধারায় ভেসে বেড়ায় মণিমুক্তোর খনি
খনির ভেতর অন্ধকার আলোর রেখা নেই
আমরা ক’জন এসব দেখে হারাই পথের খেই।
****খসড়া
আলমগীর রেজা চৌধুরী
কবিতা বুবুর বিয়ে হয়েছিল শৈশবে-
অপরিণত কনে সেজে স্বামীর সংসারে ভালো থাকেনি।
সংসার নির্মাণের কুশীলব যারা
তারাও সংসার বৈরাগী।
মনোমুগ্ধকর জলরঙের ল্যান্ডস্কেপে চোখ রেখে
কোনো মনুষ্যকুলের দেখা পায়নি
হতশ্রী, মলিন, হাহাকার গ্রাস করেছে বিষণ্ন-সন্ধ্যা ।
যৌবন পুরুষ তোমাকে খুঁজেই দেখেনি;
অনাঘ্রাতা, অধরা নারীর বিশল্যকরণী তাবিজ।
কবিতা বুবু বার বার ফিরে আসে
মমতায় বলে, ‘তোর কাব্যলক্ষ্মী বাড়ি ফিরেছে?’
আমি বলি, ‘এইতো কবিতা লিখবো।’
***কিছু বলার থাকে না
সরকার মাসুদ
উইপোকা সুড়ঙ্গ বেয়ে প্রিয় বইয়ের পাতালে নেমে গেলে
আমার কিছু বলার থাকে না, দেয়ালের সরস ফাটল
বীজ হয়ে উঠেছে বট ওই চারা ধীরে ধীরে শেকড় ছড়ালো
আমার ভেতর কিছু বলতে পারিনি, দুঃখভেদি স্পিডে
ঝাঁকড়া চুলের ছেলে উড়ে চলেছে নতুন মোটরসাইকেলে
পেছনে তার সখী পেছনে ফিতার মতো উড়ছে আঁচল
বলো কখনো কি টু শব্দ করেছি? আমি নিজেকে ওইভাবে
গড়েছি নীরবতাপ্রিয় লোক, আকাশের ছেঁড়া ঘুড়ি আর
আকাশের ভাসমান লাল সুতা ঘুড়িহারা বালকের
লাটাই-লাট্টুর কথা ভুলিনি কখনো, নদীর পারে ঝান্ডা হাতে
ছেলেরা ছুটছে নৌকা পেলে তারা আর ফিরবে না তখন
আমার কিছু বলার থাকে না বিকালে রিটায়ার্ড বুড়োদের
ছড়ির আশপাশে প্রজাপতিদের দৌড়ঝাঁপ সিকিসন্ধ্যাবেলা
কালি ঝুলিমাখা চাঁদ হাসে নির্লজ্জ গণিকার মতো আমার
তন্দ্রার ভেতর এগিয়ে আসে নখ-দন্ত-থাবা কথা বলতে
পারি না, বাড়ির দেয়ালের ওপর খুনির মতো উঠে বসে
ছাই রং বিড়াল তার কালো-হলুদ দৃষ্টির ভেতর গজিয়ে
ওঠে লোভ আর বিস্ময় চেয়ে চেয়ে দেখি কিছু বলার থাকে না।
****মেঘেরা ঘুমিয়ে আছে নদীর ওপারে
কাজলেন্দু দে
মনোলীন- ব্যক্তিগত
রাস্তার দু’পাশে যত গাছ আছে-
পুরনো দালানকোঠা
ডাস্টবিন
পুকুর ও গলিখুঁজি-এই সব পার হয়ে
আমার কবিতা
সুন্দরের নিটোল করবী ছুঁয়ে
প্রতিদিন
অসীমের পানে উড়ে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে আমি টের পাই
ভেজানো দরজা খুলে দৃশ্যপটে প্রবেশ করছে একটি রক্তাক্ত দিন আর
খুনির গায়ের গন্ধমাখা তেসস্ক্রিয় মিথের আঙ্গুল
দেশে দেশে যুদ্ধ আর সন্ত্রাসের নতুন আখ্যান লিখছে।
ভ্যাম্যমাণ এই সব দিনে
চওড়া কাঁধের নিচে বিকেলের ক্ষতচিহ্ন
ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
লবণ, পাথর আর ধূলির রাজত্বে
গ্রীষ্মের গোধূলি নামে
জলের আঙ্গুলগুলো পৃথিবীকে ছুঁয়ে যায়
তবু বসন্ত আসে না।
আজকাল এভাবেই দিন কাটে। সুটকেস ভর্তি বিষাদ
হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখি,
বহুদূরে
মেঘেরা ঘুমিয়ে আছে নদীর ওপারে ॥