ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

ইতিহাসের আলোয় স্বাধীনতাপূর্ব দু’দশক

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১৯ মে ২০১৭

ইতিহাসের আলোয় স্বাধীনতাপূর্ব দু’দশক

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস অসংখ্য মানুষের ত্যাগ, সংগ্রাম ও সাধনার ইতিহাস। যে জাতি চিরকাল পরজাতির অধীন ছিল, যে জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি হাজার বছরেওÑ সে জাতির স্বাধীনতা অর্জনের মূলমন্ত্র নিশ্চয়ই একদিনে গড়ে ওঠেনি। সূর্যসেন, প্রীতিলতাদের হাত ধরে সালাম-বরকতের আত্মত্যাগ স্বাধীনতা ও বাঙালীর আত্মসচেতনতার প্রতিচ্ছবিকে কালের রেখায় আরও স্পষ্ট করে। বায়ান্ন থেকে সময় যতই গড়িয়েছে, ততই তীব্র অনুভূত হয়েছে একটি স্বাধীন দেশের কথা। ‘ছয় দফা’ এমন অনুভূতির জোরালো প্রকাশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনের আন্দোলনগুলো এবং এ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী কৃতী মানুষগুলোকে উপন্যাসের ফ্রেমে ফেলেছেন কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল। শুধু নায়ক নয়, সাতচল্লিশ পরবর্তী সময় ও সময়ের খলনায়কদের চরিত্রও চিত্রিত হয়েছে ‘অগ্নিকন্যা’ উপন্যাসে। এখানে অগ্নিকন্যা নামটি যে প্রতীকী সে কথা লেখক গ্রন্থের ভূমিকাতেই জানিয়েছেন। উপন্যাসের সময়কাল নির্বাচনে ঔপন্যাসিক প্রাজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। কেননা ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সময়টুকু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রস্তুতিমূলক সময়। মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিব, তাজউঈন আহমদ প্রমুখের বহুবিধ কার্যক্রম উপন্যাসের আদলে ঐতিহাসিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। যার ফলে উপন্যাসটি পাঠে পাঠক একই সঙ্গে যেমন উত্তাল সময়কে উপলব্ধি করতে পারবেন, তেমনি অনুভব করতে পারবেন দেশপ্রেমিক নেতাকর্মী, ছাত্র-সাধারণ মানুষের অবদানের কথা। অগ্নিকন্যা উপন্যাসটির প্রথম খ- এটি। আরও দুটি খ- বের করার ইচ্ছা লেখকের। উপন্যাসটি শুরু হয় শিশু মতিয়াকে চিত্রণের মধ্য দিয়ে। পুলিশ অফিসার মহিউদ্দিনের মেয়ে মতিয়া ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ সেøøাগান শুনে সেটি আত্মস্থ করতে থাকে। মতিয়ার বেড়ে ওঠা, রাজনীতি সচেতন হওয়ার সমান্তরালে লেখক বলে যেতে থাকেন হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, ফজলুল হক, শেখ মুজিব, তাজউঈন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খাজা নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রমুখের ভূমিকার কথা। এই চরিত্রগুলো নিজ নিজ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াতে উপন্যাসটি প্রাণ পেয়েছে। যার ফলে উপন্যাসটি একই সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানুষের আত্মত্যাগ ও আত্ম অধিকারের রাজনীতির কথা এবং লিয়াকত আলী খানদের ভোগ ও কূটকৌশলী রাজনীতি চর্চার কথা উন্মোচিত করতে সমর্থ হয়েছে। এ কারণেই পাকিস্তান সংগ্রামের অন্যতম সেনাপতি লিয়াকত আলী খান বলতে পারেন, ‘সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব হিন্দুস্তানের লেলিয়ে দেয়া পাগলা কুত্তা!’ কারণ তার অপরাধ, ‘তিনি মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যকার দাঙ্গা থামাতে ভারতবর্ষ এবং পূর্ব বাংলার সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’ আবার সেই লিয়াকত আলী খান যখন আততায়ীর হাতে নিহত হন তখন পাকিস্তানের আরেক নেতা খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রতিক্রিয়া লেখক দেখিয়েছেন এভাবেÑ ‘স্যার, লিয়াকত আলী খানের মৃত্যু সংবাদের পর পরই আরেকটি খবর পেলাম। সেই খবরটি পেয়ে ভাবলাম, দুঃসংবাদটি না দিয়ে সুসংবাদটিই দিই। Ñ সেটা কী? Ñআপনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। হঠাৎ খাজা নাজিমউদ্দিনের চেহারা অন্য রকম হয়ে গেল। নাজিমুদ্দিন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী! খুশিতে তার চেহারাটা ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল।’ যে খাজা সাহেব লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর খবর শুনে একটু আগে কাঁদছিলেন, তিনিই একটু পরে তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খবর শুনে নেতার মৃত্যুশোক ভুলে গেলেন! এটাই ছিল পাকিস্তানী শাসকদের প্রকৃত চেহারা। তারা ক্ষমতার রাজনীতি করতেন, সাধারণ মানুষের নয়, বাঙালীদের জন্য তো আরও আগে নয়। সময়ের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসটির দিকবদল ঘটেছে। পূর্ববঙ্গের অনেক নেতা শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। অনেক নেতা দলবদল করেছেন। যে মতিয়াকে উপন্যাসের শুরুতে দেখানো হয়েছে শিশুÑ সময়ের বদলে সেও হয়ে উঠেছে রাজনীতি সচেতন মানুষ। এ উপন্যাসের বিশিষ্টতাÑ একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কে লেখক সাবলীলভাবে ক্যানভাসে আঁকতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতিটি চরিত্রকে তিনি পৃথক পৃথক এবং শেষ পর্যন্ত সম্মিলিতভাবে এঁকেছেন। যার ফলে প্রতিটি চরিত্রই নিজস্ব আলো ছড়াতে সক্ষম হয়েছে। আরেকটি কথা বলতে হয়, এ উপন্যাসে আবুল মনসুর আহমেদ ও ইত্তেহাদ পত্রিকার ভূমিকার কথা যথার্থভাবে রয়েছে। কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গের কথা ওইভাবে উঠে আসেনি। যেটা অন্য বিষয়ের মতো প্রয়োজনীয়ভাবেই উঠে আসতে পারত। লেখক আগামী পর্বে এই বিষয়টিতে দৃষ্টি রাখবেন বলেই আমার বিশ্বাস।
×