ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অরুণ কুমার বিশ্বাস

প্রোপোজাল

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

প্রোপোজাল

লোকটাকে দেখে সত্যি অবাক হতে হয়। সবকিছু ঠিকঠাক, তবু কোথাও যেন কিছু নেই। বা ঘুরিয়ে বললে, সে অতি সাধারণের মাঝেও একটু অন্যরকম। খলিল সাহেব ব্যস্ত মানুষ। তাকে পাঁচ রকমের কাজ নিয়ে ভাবতে হয়। মিরপুর সনি সিনেমা হলের সামনে যাত্রীছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে একবার মাত্র তার দিকে তাকালো। মনে মনে হয়তো বলল, উদ্ভট! তারপর চোখ ফিরিয়ে নেয় খলিল। ভরা বর্ষায় টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। হাতে ছাতা একটা আছে বটে, তবে তা ‘লিডিস’ প্রকৃতির। এতে মাথা ঢাকতে গেলে পেছন উদলা, আর দেহের পেছন দিকটা আড়াল করতে গেলে মাথা দিব্যি ভিজে যায়। বিরস মুখে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে খলিল। তাকে মতিঝিল যেতে হবে- নতুন এক ক্লায়েন্ট ওয়েট করছে। সময়মতো পৌঁছতে না পারলে কাজটা নির্ঘাত ফস্কে যাবে। এমনিতে বাজার মন্দা, তারপর যদি হাতের লক্ষ্মী নিজের ইচ্ছেয় পায়ে ঠেলে, সে বড় আপসোসের কথা হবে! বাস আসছে না, রাস্তায় হেব্বি জ্যাম। উসখুস করে খলিল। বারবার ঘড়ি দেখে। মোবাইল ফোনের বদৌলতে ঘড়ির গুরুত্ব এখন তলানিতে ঠেকেছে। ওটা স্র্রেফ স্টাইল। কাজের কিছু না। পরনে তার সাদা ফিনফিনে শার্ট। বুকপকেট থেকে সহাস্যে উঁকি দিচ্ছে পাঁচশত টাকার একখানা নোট। খলিল নিজের অবস্থান ও আর্থিক সংগতি বোঝানোর জন্য ইচ্ছে করেই একাজ করে। জামার পকেটে রাখা নোটখানা তার স্টেট্যাস সিম্বল। উদ্ভট লোকটা তখনও খলিলের পাশে দাঁড়িয়ে। খিলাল দিয়ে দাঁতের বদলে সে কান খোঁচায়। ছি, কী নোংরা! খলিল ঘেন্নায় মুখবিকৃত করে। তার বেশবাসে দারিদ্র্য দোল খায়। বেশ বোঝা যায় এর বাড়িতে নিত্য হাঁড়ি চড়ে না। গায়ে রঙচটা হলুদ জামা। মানে এক সময় হয়তো হরিদ্রাভা গোছের কিছু ছিল, এখন হাল্কা ইট রঙ। কলারের দিকে ফেঁসো উঠে গেছে। মানে জামাটা সে অনেকদিন ধরে ব্যবহার করে আসছে। নি¤œাঙ্গে ছাইরঙ প্যান্ট, কোমরটা (লোকের না, প্যান্টের) এত সরু যে ওটা বড্ড ঢলেঢলে। খুলে যায় আর কি! খলিলের অবশ্য এর ব্যাপারে কোন রকম আগ্রহ ছিল না, সে ভাবে বাস কেন আসছে না। তাকে অন টাইম মতিঝিল পৌঁছতে হবে। এনি হাউ! কিন্তু চাইলেও খলিল নির্বিকার থাকতে পারে না। ‘উদ্ভট লোকটা’ মাড়ির সাথে জিভ ঠেকিয়ে পাখির ঠোঁটের মতো বানায় এবং মনের আনন্দে চিঁউ চিঁউ গোছের শব্দ করে। বিরক্তিকর! খলিল ফিরে তাকায়। লোকটার চেহারাটা এবার তার ঠিকঠাক চোখে পড়ে। আঃ! দাড়ির কী ছিরি দেখো! মন ফস্কে বলে ফেলে খলিল। স্যার কিছু বললেন? পাখিঠোঁট লোকের মুখে বুলি ফোটে। সে মিচকে হাসে। এই সেরেছে! মনে মনে সতর্ক হয় খলিল। সে জানে, এই জাতীয় লোকেরা বড্ড নোজি মানে গায়েপড়া স্বভাবের হয়! খেয়েবসে কোন কাজ নেই কি না। ভাই কিছু বলছেন ? স্পষ্ট শুদ্ধ উচ্চারণে চোখ নাচায় সে। মানে তার আলাপে আপত্তি নেই, বরং আগ্রহী। খলিল চোখ নামিয়ে নেয়, অ্যাভয়েড করে। তার খুব তাড়া। মতিঝিল যেতে হবে। উহুঁ, বাস কেন আসছে না! সে ব্যস্ততার ভাব দেখায়। ফলে ইচ্ছে থাকলেও লোকটা খলিলের সাথে ঘনিষ্ঠ হবার খুব একটা ফুসরত পায় না। এড়াতে চাইলে কে কাকে ধরতে পারে বলুন! পাখিঠোঁট লোকটার দাড়ির ব্যাপারে মনে মনে ভীষণ কৌতূহলী হয় মাঝারি মাপের ইনডেন্ট ব্যবসায়ী খলিল মিয়া। খলিল খেয়াল করে, সে সত্যি ঠোঁটকাটা, ডাক্তারি পরিভাষায় বলে ক্লেফ্ট লিফ, মানে জন্মগতভাবে যাদের ঠোঁট কেটে দাঁত বেরিয়ে থাকে। সবচে দ্রষ্টব্য, তার থুতনিতে দাড়িগুচ্ছ। নূরানি দাড়ি নয়, মাঝারিও নয়। যদি বলি ছাগুলে দাড়ি তাহলে নির্ঘাত ছাগল-সমাজ মনে কষ্ট পাবে, চাই কি মনের দুঃখে পাগলও হয়ে যেতে পারে। তবে কি ফ্রেঞ্চ কাট! মোটেও না। ফরাসিরা আবুলের মতো এত্ত বড় দাড়ি রাখে না। আসলে এরকম দাড়ি খলিল আগে দেখেনি। এবং অনেকক্ষণ অপাঙ্গে তাকিয়ে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, এই বিশেষ দাড়িগুচ্ছই ওর চেহারায় ‘উদ্ভট’ ভাব এনে দিয়েছে। কৃতিত্বটা তার পোশাক বা চেহারার নয়, দাড়ির। খানিক বাদে বাস এসে গেল। অমনি হৈ হৈ করে অপেক্ষমাণ যাত্রীসাধারণ বাসের দিকে ছুটলো। বলতে নেই, এই উত্তুঙ্গ মিছিলের শিরোভাগে ছোটে আমাদের খলিল। কারণ তার তাড়াটা একটু বেশি। মতিঝিল যেতে হবে। জ্যামের রাস্তায় অনেকটা পথ। তখনও বৃষ্টি, টিপটিপ, ছিরছির। বাস মোটামুটি ভরা ছিল। কিন্তু খলিল কোনমতে একটা সিট ম্যানেজ করলো। ছেলেবেলায় সে ভাল মোড়গ লড়াই খেলতো। তার সুফল পাচ্ছে এখন। ঢাকা শহরে যেসব বাস লোকাল রুটে চলাচল করে তাতে চলতে গেলে টুকটাক গুঁতোগুঁতির স্বভাব থাকা ভাল। গলাটা সরেস হলে আরো ভাল। অন্যকে দাবড়ে গুঁতিয়ে আসন বাগানো যায়। আশ্চর্য! খলিলের পাশে সেই লোক, ফ্রেঞ্চকাটের চেয়ে বড়, কিন্তু ছাগুলে দাড়ির চেয়ে একটু ছোট দাড়ি! কিভাবে! এখানে তা অন্য কেউ ছিল! তার মানে এরা দলবেঁধে উঠেছে! মলমপার্টি নয় তো! সত্যি সত্যি খানিক সিঁটিয়ে গেল ইনডেন্ট ব্যবসায়ী খলিল মিয়া। বাস চলতে শুরু করেছে। মোড় ঘুরে এখন দারুস সালাম রোডে পড়েছে। এখনও অনেকটা পথ- ছাগুলের সাথে বসে মোটেও আরাম পায় না খলিল। উসখুস করে। যেন নতুন কেনা জুতো, তাও আবার সাইজে ছোট, তাই পরে ম্যারাথন দৌড়াচ্ছে। সহযাত্রীর চেহারাসুরত হাবভাব দেখে খলিল মোটামুটি নিশ্চিত হয়, ব্যাটা মলমপার্টির সদস্য। না হলে পকেটমার। বা ছিনতাইকারী। বাসে উঠে টার্গেট সিলেক্ট করে, মোবাইলে স্যাঙাতদের জানায়। তারপর মওকা বুঝে আগে থেকে অপেক্ষমাণ কোন স্টপেজে মাল টার্গেটের ঝেড়ে নিয়ে সটকে পড়ে। এমন কাহিনী পত্রপত্রিকার কল্যাণে এখন হামেশাই শোনা যায়। খলিল সাদাসিধে মানুষ। মনের কথা গোপন করতে পারে না। আচমকা বলে বসলো, মলমপার্টি? লাভ নাই, আমি টাকাঅলা নই। বড্ড শুখা মাল। খলিলের কথা শুনে নড়েচড়ে বসে লোকটা। সন্দিগ্ধ চোখে তাকায়। কেনই বা তাকাবে না, সে তো উদর্ুু বা ইংরেজিতে কিছু বলেনি। খাঁটি বাংলা বোঝার ক্ষমতা তার আছে। খলিল ভাবলো, লোকটা এবার খেপবে, আর যদি কমন পড়ে তাহলে কোন অছিলায় পালাবে। কিন্তু মজার ব্যাপার, এর কোনটাই সে করেনি। বরং তাকে চমকে দিয়ে দরাজ হেসে বলল, বুঝতে পেরেছি ভাইসাব, শুরু থেকেই আমাকে আপনি সন্দ করেছেন। আমি বকর, ভাল নাম বক্কার আলী, টুকটাক কাজ করি। তবে আপনি যা ভেবেছেন, মলমের ব্যবসা না। খেটে খাই, লোক ঠকাই না। আপনি আমাকে নির্দ্বিধায় বিশ^াস করতে পারেন। বকরের কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে খলিল। এত সুন্দর বাংলা উচ্চারণ অনেকদিন সে শোনেনি। প্রমিত বাংলার চল তো এখন উঠেই গেছে। কি লিখিত, বা কি কথ্য। উল্টাপাল্টা ভাষায় সো কলড নাট্যকার- লেখকেরা কলম হাঁকাচ্ছেন! যেন ভাষাটা তার বাপের তালুকদারি! কোন মানে হয়! খলিলের বিরক্তিভাবটা খনিক কমলো। বকর হয়তো ততটা খারাপ নয়, যতটা সে ভেবেছে। আসলে মানুষের বাইরেটা দেখে সব সময় ভেতর আন্দাজ করা যায় না। সমীচীনও নয়। বাস শ্যামলী ক্রস করতেই বকর তার বিদ্যের ঝাঁপি উল্টো করে ধরলো। একের পর এক সে জ্ঞান জাহির করছে। শুরুতেই নারী-পুরুষ সমানাধিকার প্রসঙ্গ। স্র্রষ্টাই নারীকে খাটো করে রেখেছেন, আমরা কী করবো বলুন! মগজে কম, দেহের অস্থিতেও, তবে সমানে চোপা চালাতে জানে, না কি বলেন! হে হে গোছের একটু হাসে বকর। দৃষ্টিকটু না হলেও যথেষ্ট শ্রুতিকটু। আশেপাশের লোক তাকিয়ে দেখছে। হয়তো ভাবে, প-িত লোকটাকে সরকার মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কেন বানায়নি! কলেজগেটে বাস থামতেই প্যাসেঞ্জার অনর্গল ঠেলে উঠতে থাকে। একজন মধ্যবয়সী মহিলাকে টপকে এক ছোকরা হাত বাড়িয়ে দেয়- সিট দখল, নাকি তার উদ্দেশ্য অসৎ ছিল ঠিক বোঝা গেল না। ওটুকু চোখ এড়ায়নি বকর আলীর। বলল, দেখলেন, আজকালকার পোলাপান কত অসভ্য। মায়ের বয়সী মহিলাকেও রেয়াত করে না। আধবুড়ো মহিলার শরীরে এমন কী আছে যে হামলে পড়তে হবে। খলিল পেশায় খাটো হতে পারে, তবে রুচিবোধ আছে। বকরের বাজে ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটা তাকে বিদ্ধ করলো এবং সংগত কারণেই সে আলাপে সংযুক্ত হল না। সে খেয়াল করলো, নারীসংক্রান্ত আলোচনায় বকর বিশেষ উৎসাহবোধ করে। তাদের পোশাক আশাক নিয়ে বক্তব্য বিস্তৃত করলো। বকরের মতে, কিছু কিছু ড্রেস ছেলেছোকরাদের উত্তেজিত করে। মেয়েদের এসব পরিহার করা উচিত। অন্তত তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে। অত্যন্ত আপত্তিকর কথা। ভেটো দিতে চাইলো খলিল। কিন্তু দিল না, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, মতিঝিলের মক্কেল এখনও আছে কি নেই তাই নিয়ে চিন্তিত খলিল। বরং বকরকে তার অতি নি¤œরুচির মানুষ বলে মনে হল। যে কিনা তার পোশাকের মতোই মলিন ও দাড়ির মতো বেয়াক্কেলে। আসলে ড্রেস নয়, সমস্যা হল কিছু কিছু লোকের অভিরুচিতে। তলোয়ার দেখলেই বানরের যদি আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে জাগে তবে তো সে মরবেই। ওই জাতীয় পুরুষকে বরং খোঁজা করে দেবার ওষুধ থাকলে বেশ হত। ফার্মগেটে মস্ত জ্যাম লেগে আছে। বাসের চালক ইঞ্জিন বন্ধ করে মনের আনন্দে শসা খাচ্ছে। সাথে বেনসন। খলিল তত বুঝমান নয়, কিন্তু তারপরও সে বুঝে উঠতে পারে না, সামান্য একজন বাসচালক কি করে বারোটাকা দামের বেনসন খায়। দিনে অন্তত দশটা। তার ঘরে কি বউ-বাচ্চা নেই! বা শসার সাথে বেনসনের কী রকম কেমিস্ট্রি যে দুটো একসাথে খেতে হয়! ওদিকে হেলপার সমানে চেঁচাচ্ছে, হারাংগেট, হারানগেট, নামেন। দুটো দুরকম কথা। খলিল শুরুতে কনফিউজড ছিল, জায়গাটা আসলে কোথায়! পরে অবশ্য দিশা পেল। লোকাল বাস কেন্দ্রিক এক রকম ভাষা গড়ে উঠেছে। একে ঠিক বাংলা বলা যায় কি না তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হতে পারে। ফার্মগেট যখন হারানগেট হয় মানে গেট হারিয়ে যায়, তখন একটু ধন্ধে পড়তে হয় বৈকি। কেননা, ইদানিং বিভিন্ন পেশা ও বয়সের মানুষ সমানে হারাচ্ছে। গুমের ভয়ে পাবলিকের ঘুম হারাম হবার জোগাড়। বিশেষত মসনদের বাইরে থাকলে গুমের সম্ভাবনা তার ষোলআনা। অথচ এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কোন মাথাব্যথা নেই। তারা দিব্যি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। সমানে বকে যাচ্ছে বকর আলী। ঘরের বউ নিয়ে একদফা লেকচার শেষ করেছে। তার মতে, বউদের খুব বেশি আসকারা দিতে নেই। তাহলেই পেয়ে বসবে। একা রাখাটাও কোন কাজের কথা নয়। জানেন তো, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। দেবর বা বন্ধুজাতীয় ছেলেছোকরাদের বাসায় যত কম নেয়া যায় ততই মঙ্গল। সৃষ্টির শুরুর দিকের কথার অবতারণা করে বকর। বিবি হাওয়াই তো আদমকে উস্কানি দিয়েছিল নিষিদ্ধ জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে। তার কথার বটমলাইন হল নারীজাতি বড্ড আনাড়ি। এদের উপর বেশি ভরসা করতে নেই। তাতে ধনেপ্রাণে মারা পড়বেন। খলিল মনে মনে হাসে। এ ব্যাপারে তার বউ জমিলার সাথে বকরের ভারি মিল। জমিলা প্রায়ই বলে, ব্যস্ত থাকবা বুঝলা, তাতে যন্ত্রপাতি ভাল থাকবো। আবার যত্রতত্র উঁকি দিবার টাইম পাবা না। তোমার চরিত্রখান ইনটেক (সম্ভবত ইনট্যাক্ট বা অক্ষত) থাকবে। আমারও রোগ-বালাইয়ের ভয় থাকবে না। টুকটাক হা হু করে যাচ্ছে খলিল। খুব একটা ইন্টেরেস্ট নিচ্ছে না। একটা ব্যাপার কিছুতেই সে বুঝে উঠতে পারে না- লোকটার মতলব কী! তলে তলে সে কী ভাঁজছে! আজকের জামানায় বিনা কারণে কেউ মেলা বকর বকর করে না। টাকায় কেনা ক্যালরি, মিছে খরচ কেন করবে! রহস্য বটে! পেছনের দিকে কী নিয়ে ছোটখাটো কাজিয়া বাঁধার জোগাড়। ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে কে কার ঘাড়ের উপর পড়ে যাচ্ছে যেন! পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে! এক সোমত্ত যুবতীর কাঁধে মাথা রাখতে চায় অচেনা পুরুষ। যে কিনা আবার বেশ বয়স্ক। এই বয়সের পুরুষের চরিত্রের আবার কোন গাছপাথর নেই। এ পক্ষের দাবি- ঢুলুনিটা আসলে ভড়ং। কৌশলে মেয়েছেলের বুকে মাথা রাখতে চায়! কী জঘন্য! কী কুৎসিৎ! মেয়েছেলে তাও ভাল। মেয়েমানুষ বলেনি! তাহলে আবার অন্য হুজ্জত শুরু হত। বাংলাভাষায় রঙঢঙের শেষ নেই। সামান্য মেয়েছেলে আর মেয়েমানুষ শব্দদুটোর মাঝে কত তফাৎ! ঘটনার অভিনবত্বে তাড়িত হয়ে পেছনে তেড়ে যায় খলিলের সহযাত্রী বকর আলী। নড়েচড়ে বসে খলিল। দেখি বকর এবার কোন্ ক্ষুরে মাথা কামায় মানে কোন্ পক্ষে যায়! আশ্চর্য ব্যাপার, বকর কিন্তু বিলক্ষণ মেয়েটার পক্ষে ঝা-া তুলে ধরে। তার জোর বক্তব্য, বাসে উঠে ঘুমানো ভব্যতার মধ্যে পড়ে না। তাও আবার পিনোন্নত পয়োধরবিশিষ্ট আপাতসুন্দরী মেয়ের পাশে বসে! এ রীতিমতো অন্যায়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বকরের শব্দচয়নে মুন্সিয়ানা খলিলকে অতিশয় মুগ্ধ করে। ভদ্রলোক সত্যি বেশ জানাশোনা। বকর সম্বন্ধে তার ভাবনা বদলায়, উল্টো সমীহের ভাব জাগে। কেউ কেউ অবশ্য বলল, ব্যাটা নিশ্চয়ই ছিঁচকে চোর। রাতভর জেগেছে, তাই চোখ মেলে রাখতে পারেনি। তাকে ঘুমোতে দেয়া দরকার। বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী এটা মৌলিক মানবিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। এ সুযোগ থেকে তাকে বঞ্চিত করাটা ন্যায়সংগত নয়। খলিল ভাবলো, এ নিশ্চয়ই বিশিষ্ট উকিল না হয়ে যায় না, বা কোন সংবিধান বিশেষজ্ঞ। তবে এটা ভেবে খানিক বিমর্ষ হল যে, এমন বিশিষ্ট লোকেরাও আজকাল লোকাল বাসে চাপে! তার মানে দেশ যতই উন্নয়নের জোয়ারে ভাসুক, বা মাথাপিছু আয় বাড়লেও তাতে বিশেষ কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। আমরা যে তিমিরে ছিলাম, এখনও সেই তিমিরেই ভেতরে পড়ে আছি। নো প্রগ্রেস। বরং কিছু মানুষের মাথা কাতলা মাছের মতো আরো বিশাল হয়েছে। তাদের খাই বেড়েছে এবং বেড়েই চলেছে। এমনই হয়- ধনীরা আরো ধনী, গরিবেরা ক্রমশ প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। যাই হোক, নারীটির হস্তক্ষেপে ঘটনার শেষতক সুরাহা হয়। ঘুম অতি জরুরি। ভালো থাকতে চাইলে আসুন সবাই মিলে ঘুমিয়ে থাকি। দেশের অন্যায় অনাচার কিচ্ছু দেখতে হবে না। রায় হল- লোকটা সত্যি ঘুমোচ্ছিল, ইভটিজিংয়ের অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া গেল। গাড়ি গড়াচ্ছে, শাহবাগ ক্রস করে মৎস্যভবন মোড়। খলিলের সহযাত্রী বকরের বকাবাজি থেমেছে, তবে উসখুস কমেনি। সে বোধ হয় কিছু বলতে চায় খলিলকে। এক ফাঁকে খলিল জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা ভাই বকর, আপনার পেশা কি, মানে কী কাজ করেন ? মোক্ষম প্রশ্ন। উত্তর দিতে হিমশিম খায় বকর। যে কাজ করে, তা হয়তো জনারণ্যে বলার মতো নয়। না, মানে এই কিছু একটা ...! অসমাপ্তই থেকে যায় তার বক্তব্য। তাকে সাহস দেবার জন্যই হয়তো খলিল দুম করে বলে, লজ্জা পাবেন না, আমিও আসলে তেমন কেউকেটা কেউ নই। সামান্য ইন্ডেন্টের দালাল। ও তাই, আপনার সাথে কিন্তু আমার দারুণ মিল। বকর স্মিত হেসে বলল। আমার অনুমান তবে কিছু ভুল হয়নি। কিছু মনে করবেন না ভাই, আপনাকে একটা কথা বলার ছিল। কিসের অনুমান ? কী কথা ? খলিল অবাক হয়। বলতে পারেন একটা প্রোপোজাল। আপনার জন্যই। এবার দরাজ হাসে বকর। বড়শিতে মাছ বিঁধলে যেমন আনন্দ হয়। আশাতীত। উৎসুক চোখে তাকায় খলিল মিয়া। মতিঝিলে অপেক্ষমাণ মক্কেলের কথা সে আপাতত ভুলে গেছে। বকর আর সময় নেয় না, বাস লাস্ট স্টপেজে ঢুকলো বলে। বলল, আমার কাছে ঢের জিনিস আছে। হাই ক্লাস, রসালো, যেমন চান তেমন। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি সব পাবেন। এই কথা বলে বকর আর দাঁড়ায় না। একখানা ভিজিটিং কার্ড গোছের কিছু ধরিয়ে দিয়ে টুক করে নেমে পড়ে। যেতে যেতে বলে, দরকার লাগলে আওয়াজ দিবেন। ওখানে আমার কন্ট্যাক্ট নম্বর আছে। চলি। তড়িতাহত খলিল স্তম্ভিত হতেও ভুলে যায়। এটা সে কী বলল! কেনই বা তার মনে হল, খলিল উপোসি, এসব তার দরকার! মানুষের চেহারায় কি কিছু লেখা থাকে! নাকি পাঁচশত টাকার নোটটাই এসবের মূলে! সহসাই হেসে ফেলে খলিল। ভারি অদ্ভুত লোক তো। আমরা দুজনেই দালাল- সে মেয়েছেলের, আর আমি মাল সাপ্লাইয়ের। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের মতো স্ত্রী জমিলার কথা একবার মনে পড়ে। জমিলা জানলে কী ভাববে! স্বামীকে আরো বেশি ব্যস্ত রাখা উচিত! নইলে যত্রতত্র ঢুকে পড়বে! এসব অনর্থক চিন্তা নিয়েই বাস থেকে নেমে পড়লো খলিল। বকরের দেয়া কার্ডখানা নেড়েচেড়ে দেখে, কিন্তু ছুড়ে ফেলে না। কে জানে, জীবনে কখন কী প্রয়োজন হয়!
×