
মোঃ মামুন রশীদ, সিলেট থেকে ॥ লাক্কাতুরা চা বাগানের চারপাশ সবুজের সমারোহ। ছোটখাটো পাহাড়ী টিলাগুলোতেও সবুজের আধিক্য। সুনসান নীরবতার মাঝেই দর্শকদের উল্লাসধ্বনি আর ২২ গজের পিচে ব্যাট-বলের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটীয় উন্মাদনা ২০১৪ টি২০ বিশ^কাপ থেকে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম নামে। তবে সবুজ ঘাসের এ গালিচায় সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়াম গড়ে ওঠে ২০০৭ সালে। দেশের একমাত্র স্টেডিয়াম যেখানে আছে দর্শকদের জন্য গ্রীন গ্যালারি! সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাটির টিলায় শুয়ে-বসে ‘রৌদ্র¯œান’ করতে করতে খেলা উপভোগের সুযোগ। মাঠের ভেতরে, গ্যালারিতে এবং বাইরে নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের লীলাভূমি হয়ে ওঠা এই স্টেডিয়ামের লাগোয়া অংশেই এখন গড়ে উঠেছে একই নামে গ্রাউন্ড-২, যার মনলোভা সৌন্দর্য ছাপিয়ে গেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পাওয়া মূল ভেন্যুটিকেও। প্রথমে একাডেমি গ্রাউন্ড, পরবর্তীতে আউটার স্টেডিয়াম হলেও সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম গ্রাউন্ড-২ নামেই এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এটিকে গড়ে তুলছে। সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গড়া এই মাঠটির সিংহভাগ গ্যালারির পাহাড়ী টিলার ‘গ্রীন গ্যালারি’। বিসিবির পরিকল্পনা এটিকে পূর্ণাঙ্গ ক্রীড়া কমপ্লেক্সে রূপ দেয়ার। নিঃসন্দেহে এটি হতে যাচ্ছে দেশের ক্রিকেট অবকাঠামোর ক্ষেক্রে একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত।
নিউজিল্যান্ডের মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে এ বছর জানুয়ারির শুরুতেই ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। পাহাড়-পর্বতের মাঝে শুয়ে থাকা এই সবুজ গালিচার মাঠ দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন বিসিবি পরিচালক ও সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম লাগোয়া বিশাল খোলা জায়গাটায় ছিল ময়লার স্তূপ আর কটু গন্ধে ভরা। সেটিকেই মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের মতো রূপ দেয়ার কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। ৮.৭ একর জায়গাটা পাওয়া গেছে নামমাত্র ১ হাজার ১ টাকা মূল্যে। ক্রীড়াপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালে আউটার স্টেডিয়াম হিসেবে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। অবশেষে ২৮ কোটি টাকা খরচায় ২০২১ সালে ক্রিকেট খেলার উপযোগী করে গড়ে তোলা হয় এটিকে। একাডেমি গ্রাউন্ড নামে জাতীয় ক্রিকেট লীগ (এনসিএল) ও বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগের (বিসিএল) বেশ কিছু ম্যাচও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন এটিকে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম গ্রাউন্ড-২ নাম দেয়া হয়েছে। মাঠটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আনতে আরও উন্নয়নের কাজ পরিকল্পনায় আছে। ইতোমধ্যেই মাঠটিতে আছে সব মিলিয়ে ১৭টি উইকেট। এর মধ্যে মাঠের মাঝে ৯টি এবং শুধুমাত্র অনুশীলনের জন্য দুই পাশে ৪টি করে ৮টি উইকেট তৈরি করা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আনা মাটি দিয়ে। আর ঘাসের চারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে এনে লাগানো হয়েছে। পানি নিষ্কাষণ ব্যবস্থাও উন্নতমানের সুবিধা সংবিলত করা হয়েছে। এই গ্রাউন্ড-২ প্রবেশের মুখেই করা হয়েছে আরও ৬টি অনুশীলন উইকেট।
একপাশে জনবসতি, আবাসিক ভবন মাঠটি ঘেঁষেই, সেখানে ভূমি অধিগ্রহণ করে সাধারণ গ্যালারি করার পরিকল্পনা রয়েছে। আর দুই পাশের বিশাল অংশজুড়ে সবুজে ছাওয়া টিলার গ্রীন গ্যালারি, দুয়েকটি গাছও আছে। আরও গাছ লাগানো হবে। অন্য পাশে মূল স্টেডিয়ামের সঙ্গে লোহার ব্রিজে সংযুক্ত করা খেলোয়াড়দের জন্য ৪টি উন্নতমানের ড্রেসিং রুম। আইস বাথ নেয়াসহ অন্যান্য উন্নত সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এখানে। ক্রিকেটারদের ডাইনিং রুম ছাড়াও সাংবাদিক, আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারি ও ম্যাচ অফিসিয়ালদের জন্য আছে উন্নতমানের সুবিশাল কক্ষ। ভিআইপি ও বিসিবির আমন্ত্রিত বিশেষ অতিথিদের জন্য হসপিটালিটি বক্সও আছে। ফ্লাড লাইটও বসানো হবে। আরও করা হবে একাডেমি ভবন ও ৩০-৪০ জনের আবাসন সুবিধা নিয়ে ডরমিটরি, যাতে বিভাগীয় এবং বিসিবির আঞ্চলিক ক্রিকেটাররা এখানে থেকে অনুশীলনের সুবিধা পান। সে জন্য গ্রীন গ্যালারির পেছনে আরও ৩ একর জায়গা নেয়ার কাজও এগিয়েছে অনেকখানি। জায়গাটি পেয়ে গেলেই ইনডোর প্র্যাকটিস ফ্যাসিলিটিসহ অত্যাধুনিক জিমনেসিয়াম, সুইমিং পুল, মাটি, টার্ফ ও সিমেন্টের ৯টি উইকেট করা হবে যাতে করে ৩ ধাপে একদিনে সর্বোচ্চ ১২০ ক্রিকেটার পূর্ণ অনুশীলনের সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। এ ছাড়া একটি ক্রিকেট যাদুঘরও করার পরিকল্পনা রয়েছে। এসব কিছু হলেই বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও অত্যাধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা সংবলিত একটি ক্রিকেট কমপ্লেক্স হয়ে উঠবে সিলেটের এই দুটি স্টেডিয়াম। আর এমন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার স্বপ্ন দেশের সব ক্রিকেটারদের। আর এমনটা গড়ার চিন্তা বিসিবিরও অনেক আগে থেকেই। এই দুই স্টেডিয়ামের পুরো কর্মকা- নিয়ে নাদেল বলেছেন, ‘এই মাঠ তৈরির সময় বাংলাদেশের বাস্তবতায় যতটুকু সম্ভব, মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের মতো করেই গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি আমরা। আমাদের পরিকল্পনা হলো, একটি ক্রিকেট কমপ্লেক্স হিসেবে সিলেটকে গড়ে তোলা। বিসিবি তো সিলেটে একাডেমি গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে।’ ‘হোম অব ক্রিকেট’ খ্যাত মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম, চট্টগ্রামের সাগরিকায় জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে এখনও গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। সিলেট স্টেডিয়াম হতে পারে দেশের বাকি ভেন্যুগুলোর জন্য বড় উদাহরণ।