ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ নুরুজ্জামান

একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত হেরাথ

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ২০ এপ্রিল ২০১৬

একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত হেরাথ

তুমুল প্রতিভাবান, তুখোড় পারফর্মার হয়েও কেবল ‘ভাগ্যের ফেরে’ শ্রীলঙ্কার হয়ে নিয়মিত খেলার সুযোগ পাননি! লঙ্কান ক্রিকেটে তার জন্মটা যে হয়েছিল বড় ভুল সময়ে। অনেকে হয়ত আঁচ করতে পেরেছেন। দুরন্ত এক বিশ্বমানের স্পিনার হয়েও ক্যারিয়ারজুড়ে মুত্তিয়া মুরলিধরনের ছায়ায় ঢাকা পড়ে ছিলেন রঙ্গনা হেরাথ। অস্ট্রেলিয়ায় যেমন গ্রেট শেন ওয়ার্নে ঢাকা পড়েছিলেন স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল। মুরলির অভিষেক ১৯৯২-১৯৯৩ মৌসুমে, আর টেস্ট দিয়ে হেরাথের আগমন ১৯৯৯-এ। অর্থাৎ মুরলিধরন যখন জীবনের সেরা সময়ে। লঙ্কান গ্রেট অবসর নেন ২০১০ সালে। তার মানে ক্যারিয়ারের প্রথম দশ বছরেরও বেশি সময় হেরাথকে মুরলির সঙ্গে লড়তে হয়েছে! তবে মুরলিধরন অবসরে যাওয়ার পর এই পাঁচ বছরে বল হাতে দ্বীপ দেশটিকে প্রায় একাই টেনে তুলেছেন ‘ভাগ্যবিড়ম্বিত’ হেরাথ। ইঙ্গিতটা আগেই দিয়েছিলেন। বয়স হয়েছে, সংক্ষিপ্ত পরিসরের ক্রিকেট ছেড়ে তাই কেবল টেস্ট চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন রঙ্গনা হেরাথ। এবার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটা দিয়ে দিলেন শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞ এই বোলার । ওয়ানডে-টি২০, অর্থাৎ রঙিন পোশাকের ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন ৩৮ বছর বয়সী বাঁ-হাতি অর্থোডক্স স্পিনার। ‘আগামী আট মাসের মধ্যে আমাদের অন্তত বারোটার মতো টেস্ট ম্যাচ খেলতে হবে। আমার মনে হলো ছোট ফরমেটের ক্রিকেট থেকে সরে যাওয়ার এটাই সঠিক সময়। তাতে পরবর্তী বিশ্বকাপের আগে তরুণ খেলোয়াড়দের গড়ে ওঠার সুযোগ থাকবে। আমারও চাপ কমবে, টেস্টে আরও ভাল করে মনোযোগ দিতে পারব।’ সপ্তাহের শুরুতে রঙিন পোশাকের ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে বলেন হেরাথ। বয়স চল্লিশের দোরগোড়ায়, কিন্তু হেরাথ বল হাতে নিলে সেটি কে বিশ্বাস করবে! এখনও নিপুণ, দারুণ বৈচিত্র্যময়। ফ্লাইট-গতির সমন্বয়ে যে কোন ব্যাটসম্যানের জন্য হুমকি। রঙিন পোশাকে কোন ব্যাটসম্যানকে আর হেরাথের মুখোমুখি হতে হবে না। সাদা পোশাকে চালিয়ে যাবেন আরও কিছুদিন। লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডও (এসএলসি) তার এ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে, ‘শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে হেরাথের অবদান অনেক। আমরা তার সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। আশা করি সে তার পছন্দের ভার্সনে (টেস্টে) দেশের সেবা করে যাবে।’ লম্বা স্পেলে টানা বল করার ক্ষমতা হেরাথকে টেস্টে আরও প্রয়োজনীয় করে তুলেছে। ক্যারিয়ারের শেষ সময়টায় এখন আভিজাত্যের সাদা পোশাকে মনোনিবেশ করতে পারবেন। টি২০ বিশ্বকাপে আগে অবসরের নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে হেরাথ বলেছিলেন, ‘আমার যা বয়স তাতে ১০-১৫ বছর আগের মতো পারফর্ম করা সম্ভব নয়। এ সময়ে অনেকবার ইনজুরির সঙ্গে লড়তে হয়েছে। চল্লিশের কাছাকাছি গিয়ে আপনি ফিটনেসের নিশ্চয়তা দিতে পারেন না। ক্যারিয়ারজুড়ে সবসময় দলকে শতভাগ দেয়ার চেষ্টা করেছি। বোঝা হয়ে ওঠার আগেই সরে যেতে চাই।’ তখন তিনি আরও বলেছিলেন, ‘চেষ্টা থাকবে বেশি বেশি টেস্ট ম্যাচ খেলার এবং দলের জন্য নিজের সেরাটা বিলিয়ে দেয়ার।’ ভারতে অনুষ্ঠিত গেল টি২০ বিশ্বকাপে খেলেছেন হেরাথ। ২০১১ থেকে মাত্র ১৭ টি২০তে নিয়েছেন ১৮ উইকেট। সেরা ৩ রান দিয়ে ৫ উইকেট! নিজের সফলতার পেছনের কথা জানাতে গিয়ে হেরাথ বলেন, ‘আমি যেখানেই যাই না কেন, কোন কিছুই পরিবর্তন করি না। ব্যাটসম্যানকে বল বাতাসে ভাসিয়ে খেলতে প্রলুব্ধ করি এবং তার উইকেটটি নিয়ে নিই। আমি কন্ডিশন বুঝতে চেষ্টা করি। আমার নিজের প্রতি আস্থা রয়েছে। সে কারণে যে কোন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারি।’ ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কার টি২০ বিশ্বকাপজয়ী দলের সবচেয়ে সফল বোলার ছিলেন হেরাথ। সেমিফাইনালে তার ঘূর্ণিতে দিশাহারা হয়েছিল নিউজিল্যান্ড। ৩ রান দিয়ে ৫ উইকেট নিয়ে ব্ল্যাক-ক্যাপসদের একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন। আর দলকে তুলে নিয়েছিলেন টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে। শিরোপা নির্ধারণী ফাইনালে ভারতের বিপক্ষেও দারুণ বল করেছিলেন তিনি। ওই ম্যাচের মধ্য দিয়ে টি২০ থেকে বিদায় নেন দুই গ্রেট ব্যাটসম্যান মাহেলা জয়াবর্ধনে ও কুমার সাঙ্গাকারা। তাকে ইনজুরির সঙ্গেও লড়তে হয়েছে। ২০১১ সালে হাঁটুতে অস্ত্রোপচার করান হেরাথ। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘অপারেশনের প্রায় চার বছর হতে চলল। কিন্তু আমি এখনও হাঁটুতে ব্যথা অনুভব করি। কখনো বোলিংয়ের সময় ব্যথাটা বেড়ে যায়! তাই তুমুল প্রতিযোগিতার এই সময়ে ওয়ানডে ও টি২০তে ক্যারিয়ার দীর্ঘ করতে চাই না।’ গত বছর অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপে সর্বশেষ ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। ২০০৪ থেকে ৭১ ম্যাচে শিকার ৭৪ উইকেট। সেরা ২০ রানে ৪ উইকেট। এছাড়া ৬৭ টেস্টে ঘূর্ণিজাদুতে ঝুলিতে পুরেছেন ২৯৭ উইকেট। মনে রাখতে হবে, সেটি ওই মুরলির অনুপস্থিতির সুযোগে এবং অবসরের পরে! ইনিংসে সেরা ৯/১২৭, ম্যাচে ১৪/১৮৪। ৫ উইকেট নিয়েছেন ২৩ বার। ছোট্ট ফরমেটে নিজের সুখস্মৃতি রোমান্থন করে হেরাথ বলেন, ‘টি২০তে দুটি স্পেলের কথা আমার বিশেষভাবে মনে পড়বে। ২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩/৫, এবং ঘরের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩/২০। ওয়ানডেতে ৫ উইকেট পাইনি, ২০১৩ সালে ভারতের বিপক্ষে ২০ রান দিয়ে ৪ উইকেট নেয়ার স্মৃতিও ভোলার নয়।’ মাহেলা-সাঙ্গার বিদায় হারে হারে টের পাচ্ছে লঙ্কানরা। গত মৌসুমে ঘরের মাটিতে পাকিস্তান ও ভারতের কাছে হেরেছে টানা দুটি টেস্ট সিরিজে। এশিয়া কাপ ও সর্বশেষ টি২০ বিশ্বকাপেও ভরাডুবি এ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসদের। এবার ওয়ানডে-টি২০কে বিদায় বললেন নির্ভরযোগ্য হেরাথ। ভাগ্যবিড়ম্বিত এ বোলার টেস্ট ছাড়ার পর দ্বীপদেশটির ক্রিকেটের যে কী অবস্থা হবে, সেটি ভেবে অনেকেই চিন্তিত।
×