
মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ
বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সেকেলে সংবাদপত্র ব্যবস্থা সংস্কার করে আধুনিক সংবাদপত্রের গোড়াপত্তনে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেই সঙ্গে সংবাদপত্রের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে তাঁর ভূমিকা যুগ যুগ ধরে এ দেশের মানুষ মনে রাখবে।
বাংলাদেশের আধুনিক সংবাদপত্রের জনক বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকউল্লাহ খান মাসুদের আজ মঙ্গলবার ৭২তম জন্মবার্ষিকী। নীতির প্রশ্নে আপোসহীন, সত্য প্রকাশে দ্বিধাহীন এই মুক্তিযোদ্ধা সম্পাদক ১৯৫১ সালের ২৯ আগস্ট তিনি ভারতের বর্তমান মিজোরাম প্রদেশের লাংলী জেলার ডিমাগিরি নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ দবির উদ্দিন খান চাকরি করতেন ভারতীয় বন বিভাগে। চাকরি সূত্রে তিনি সপরিবারে থাকতেন ওখানে।
আতিকউল্লাহ খান মাসুদের প্রথম এবং প্রধান পরিচয় বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করা। স্বাধীনতা যুদ্ধে ২নং সেক্টরে কমান্ডার হিসেবে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেন এবং অনেক বড় বড় অপারেশনে অংশ নেন। যুদ্ধকালে সব দুঃসাহসিক কর্মকা-ের কারণে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্পে মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ একজন প্রবাদপ্রতিম পুরুষ। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সবসময় নিজেকে এবং তার প্রকাশিত সংবাদপত্রকে নিয়োজিত করে গেছেন। নীতির প্রশ্নে আপোসহীন এবং ন্যায়ের প্রশ্নে অবিচল থাকাÑ এই কর্মবীর তার সারা জীবনের কাজ দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। তাই তো তিনি বাংলাদেশের নির্ভীক সাংবাদিকতার এক পথিকৃৎ।
প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা দেশে ১৯৯৩ সালে তিনি পাঁচটি স্থান থেকে একটি জাতীয় দৈনিক প্রকাশ করে সংবাদপত্র শিল্পে এক বিপ্লব সাধন করেন। তার দেখানো পথেই আজ দেশের সংবাদপত্র শিল্প উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে। তাঁর জীবনের সবচেয়ে সফল সংযোজন হচ্ছে ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ প্রকাশ। দেশে তখনো বাংলা ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অন্তরে ধারণ করে এমন পত্রিকা তেমন একটা ছিল না। দৈনিক জনকণ্ঠই প্রথম বাংলাদেশের আত্মপরিচয়কে তুলে ধরতে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেছে।
শুধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অন্তরে ধারণই নয়, আতিকউল্লাহ খান মাসুদই দেশে প্রথম প্রযুক্তিভিত্তিক পত্রিকা বের করার কথা চিন্তা করেন। প্রযুক্তিতে ৩২৪ বছর পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য এটি ছিল এক অনন্য অগ্রযাত্রা। কারণ, তখনো দেশে অনলাইন ইন্টারনেটের যুগ শুরু হয়নি। ফলে নেটওয়ার্ক তৈরি করে দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তথ্য স্থানান্তর করা ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। সেই অকল্পনীয় কাজটি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলেন জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা।
১৯৯৩ সালে বর্তমান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সহযোগিতায় মেকিন্টোস কম্পিউটারের রিমোট এক্সেস প্রযুক্তির মাধ্যমে কম্পিউটারের দূরবর্তী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে পাঁচটি স্থানে মুদ্রণ যন্ত্র স্থাপন করে ৫ জায়গা থেকে দৈনিক জনকণ্ঠ ছাপার ব্যবস্থা করেন। যা সেই সময় ছিল চরম দুঃসাহসের কাজ। সেই সাহসী কাজটিই বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে করে দেখিয়েছিলেন আতিকউল্লাহ খান মাসুদ।
দেশের স্বাধীনতার মূল নীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যখন বিপন্ন, বিপন্ন যখন দেশ ও জাতির স্বার্থ, তখন তিনি ভাবেন কিছু একটা করা দরকার। সেই ক্রান্তিলগ্নে তিনি সাহসের সঙ্গে প্রকাশ করেন মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠস্বর হিসেবে দৈনিক জনকণ্ঠ। এর মধ্য দিয়েই তার সেই অপূর্ণতা পূরণ হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তিনি যে চেতনাকে হৃদয়ে লালন করেন, সেই চেতনার বিকাশ ঘটান তার প্রকাশিত দৈনিক জনকণ্ঠের মাধ্যমে।
জনকণ্ঠ প্রকাশের আগে দৈনিক পত্রিকাগুলো ঢাকায় মুদ্রিত হয়ে সারাদেশে পরিবহনের মাধ্যমে সরবরাহ হতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দিনের পত্রিকা দিনে পাওয়া যেত না। আতিকউল্লাহ খান মাসুদই সেই অর্গলটা ভেঙে একসঙ্গে দেশের পাঁচ জায়গা যথাÑ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া এবং সিলেট থেকে পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। দৈনিক জনকণ্ঠের আগে কেউ ভাবতেও পারেনি এমনটি হতে পারে। জনকণ্ঠই প্রথম প্রমাণ করে একটি পুরো পত্রিকা ডিজিটাল পদ্ধতিতে দেশের ৫ স্থানে প্রেরণ করে হুবহু একই কপি বা রূপান্তরিত-সম্পাদিত পত্রিকা প্রকাশ করা যায়। আতিকউল্লাহ খান মাসুদই প্রথম প্রমাণ করেন ভবিষ্যতে পত্রিকার ডিজিটাল যাত্রা অনিবার্য।
ডিজিটাল পদ্ধতিতে দৈনিক জনকণ্ঠ প্রকাশ করতে গিয়ে জনাব মাসুদ প্রথাগত পত্রিকার খোলনলচেই বদলে ফেলেন। সাংবাদিকতায় আনেন নতুন মাত্রা। সংবাদকর্মীদের প্রথাগত নিউজ প্রিন্টে শিস কলম দিয়ে লেখার অভ্যাসটাকে কম্পিউটার জানা ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানুষে রূপান্তর করেন।
দৈনিক জনকণ্ঠ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে অবলম্বন করে জীবনব্যাপী তিনি এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের পর বাংলাদেশ যখন তার নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল, ঠিক তখনই তার হাত ধরে এ দেশের সাংবাদিকতা এক নতুন মোড় নিয়েছে। তিনি সংবাদপত্রকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগী হয়েছেন।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রে শুধু প্রযুক্তিগত বিপ্লবই নয়, বৈচিত্র্যও নিয়ে আসেন এই সম্পাদক। সৃজনশীলতার নতুন নতুন স্বাক্ষর রাখেন দৈনিক জনকণ্ঠের পত্রিকার পাতায়। তার প্রদর্শিত পথে দৈনিক জনকণ্ঠ এখনো সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। এসব সৃজনশীলতা আজ দেশের সংবাদপত্রের এক মূল্যবান সম্পদ।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যাপারে তিনি কখনো আপোস করেননি। মৌলবাদ, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িকতা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো কর্মকা-ে নিরপেক্ষ কোনো অবস্থানও গ্রহণ করেননি। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এ সবের বিরুদ্ধেই অবস্থান করেছেন।
প্রতিটি ক্রান্তিকালেই তাঁর জনকণ্ঠ পত্রিকা বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে, নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্য ও অঙ্গীকার। জনকণ্ঠ বরাবরের মতো সেই সব ক্রান্তিলগ্নে সোচ্চার থেকে পাঠকের ওই প্রত্যাশা শতভাগ পূরণ করেছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থের পক্ষে আতিকউল্লাহ খান মাসুদের অবস্থান ছিল প্রশ্নাতীত। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল অনমনীয় দৃষ্টান্ত।
আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, মুক্তিবুদ্ধির পক্ষের একজন কাজ পাগল মানুষ। তার অধীনে কর্মরত সাংবাদিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিনি দারুণভাবে ভালোবাসতেন। সাহসী সাংবাদিকতায় তিনি সব সময় সাংবাদিকদের সমর্থন দিয়ে যেতেন। যে কোনো বিপদে আপদে তিনি তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে রক্ষা করতেন। এটি ছিল তার চরিত্রের একটি বিশেষ দিক। যে কারণে তার পত্রিকায় কাজ শেখা
সাংবাদিকরা আজ দেশের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে যাচ্ছেন।
জন্মদিন পালনে তিনি বরাবরই ছিলেন আনাগ্রহী। তবে অফিসের সাংবাদিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে প্রতি বছরই ঘরোয়াভাবে পালন করা হতো জন্মদিন। তিনি তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অংশগ্রহণ করতেন। আতিকউল্লাহ খান মাসুদ সব সময় সাংবাদিক-কর্মচারীদের সঙ্গে মিশতেন। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন।
সফল তরুণ শিল্পপতিদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত হন। ১৯৭৮ সালে তিনি সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে জাপানের কারিগরি সহযোগিতায় গ্লোব ইনসেকটিসাইডস লি. নামে দেশের প্রথম মশার কয়েল প্রস্তুতকারী শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ধোঁয়াবিহীন মশা নিবারক গ্লোব ম্যাট ও তেলাপোকা ধ্বংসকারক গ্লোব অ্যারোসল এই দুটি পণ্য উক্ত কারখানায় উৎপাদন শুর করা হয়। ১৯৯০ সালে গণচীনের কারিগরি সহযোগিতায় গ্লোব মেটাল কমপ্লেক্স লিমিটেড নামে আরও একটি ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৯৩ সালে একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সফল শিল্পপতি হিসেবে তার জীবনের সবচেয়ে সফল সংযোজন দেশের অন্যতম এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ প্রকাশ করেন। জনাব মাসুদ ১৯৯৭ সালে ডেইরি ও কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য গ্লোব খামার প্রকল্প নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৯৯৮ সালে দেশের গৃহায়ন সমস্যা বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত নাগরিকদের জন্য গৃহায়ন সমস্যা সমাধানকল্পে গ্লোব কনস্ট্রাকশন লিমিটেড নামে আরও একটি গৃহ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০০ সালে তার উপরোক্ত সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সমন্বয়কারী হিসেবে গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
জন্মলগ্ন থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সপক্ষে সাহসী ভূমিকার কারণে ‘ওয়ান ইলেভেনের’ শুরুতেই তিনি গ্রেপ্তার হন। তৎকালীন সরকার ৪২টি মিথ্যা মামলা ৪৫ কোটি টাকা জরিমানা এবং ৪৮ বছর কারাদ- প্রদান করে দীর্ঘ ২২ মাস ১২ দিন তাকে কারান্তরীণ রাখে। গণতন্ত্র ফিরে এলে ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
জনাব মাসুদ আজীবন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের অনুসারী আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির একজন বাতিঘর। সংবাদপত্র প্রকাশনার জগতে তিনি দিয়েছেন নতুন মাত্রা। সাম্প্রদায়িকতা ও অপশক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার এই মহান মুক্তিযোদ্ধা নতুন প্রজন্মের সংগঠক ও উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
উল্লেখ্য, হঠাৎ করেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ২০২১ সালের ২২ মার্চ ভোরে ইন্তেকাল করেন।