ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

দেশপ্রেমিক মানুষের সান্নিধ্যে...

শফী আহমেদ

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ২৮ আগস্ট ২০২৩

দেশপ্রেমিক মানুষের সান্নিধ্যে...

দেশের প্রয়োজনে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়েই জনকণ্ঠ সম্পাদকের সঙ্গে পরিচয়

দেশের প্রয়োজনে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়েই জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদের সঙ্গে পরিচয়। আমরা তখন স্বৈরাচার সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করছি। ছাত্রদল নেতা খায়রুল কবীর খোকনের মাধ্যমে তিনি একদিন নিজ কার্যালয়ে আমাদের চায়ের আমন্ত্রণ জানান। তখনো জনকণ্ঠ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ হয়নি। গ্লোব মশার কয়েল, গ্লোব কোম্পানি নামে পরিচিত। তিনি তখন এর প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পরিচয় পর্বের পর আমাদের সঙ্গে তাঁর একটি আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এরপর প্রায়শই দুপুরের ভাত খাওয়ার সময় আমাদের অফিসে আমন্ত্রণ জানাতেন। তাঁর কার্যালয়ের পাশেই ‘ঘরোয়া’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। সেখানের খিচুড়ি ঢাকার প্রসিদ্ধ খাবারের তালিকায়। আমরা একসঙ্গে খেতাম এবং আন্দোলন সম্পর্কে মতবিনিময় করতাম। তিনি আন্দোলনের ব্যাপারে আমাদের নানা পরামর্শ ও উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি নানাভাবে সহযোগিতা করতেন।
এর মধ্যে দেশের ছাত্র সমাজ সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে এককেন্দ্রে নিয়ে আসে। দেশের ২২টি ছাত্র সংগঠন ও ডাকসু মিলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠিত হয়। আন্তরিকতা থেকে তিনি অনেকটা আমাদের অভিভাবকের মতো হয়ে ওঠেন। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যে যাতে বিরোধপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি না হয় এবং আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি সেদিকে দৃষ্টি রাখতেন এবং আমাদেরকে নানা পরামর্শ দিয়ে তিনি সহযোগিতা করতেন।  
ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় সরকারকে আমাদের পক্ষ থেকে কী পরামর্শ দেয়া যায়, তা বলে দিতেন আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। এর পর পরই তিনি দৈনিক জনকণ্ঠ প্রকাশের উদ্যোগ নেন।
পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বিস্তারিত তুলে ধরেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা। জানান, নতুন ধারণা নিয়ে আসা প্রকাশিত কাগজটি একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকে সকল বিভাগীয় শহর থেকে প্রকাশ করতে চান তিনি। এতে কাগজের কাটতি বাড়বে। দ্রুত পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ার সম্ভাবনার পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরেছিলেন। আমরা তাঁকে সহযোগিতার আশ^াস দেই। জনকণ্ঠ প্রকাশের পর সম্পাদক হিসেবে তিনি আবারো আমাকে ডেকে ৯০-এর ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পত্রিকায় লিখতে বলেন। তখন জনকণ্ঠে চতুরঙ্গ পাতার দায়িত্বে থাকা সাংবাদিক এখলাস ভাইকে দায়িত্ব দিলেন আমার লেখা ধারাবাহিকভাবে ছাপানোর জন্য।

১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ পর্যন্ত লেখা জনকণ্ঠে ছাপা হলো। সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ আশ^াস দিয়েছিলেন আমার লেখাগুলো তিনি বই আকারে প্রকাশ করবেন। এ ব্যাপারে তাঁর সদিচ্ছার কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু দৈনিক জনকণ্ঠে লাগা আগুনে সবকিছু পুড়ে যাওয়ায় সেই বইটি আর প্রকাশ করা হয়নি।
দেশের স্বার্থে আন্দোলন সংগ্রামের কারণে জনকণ্ঠ সম্পাদক আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। অনেকদিন পর গুলশানের একটি মার্কেটে কাকতালীয়ভাবেই তাঁর সঙ্গে দেখা। আমি শীতের জন্য একটি সোয়েটার কিনতে গিয়েছিলাম। তিনিও সেই দোকানে গিয়ে আমার হাতে থাকা সোয়েটারটি পছন্দ করেন। এই রঙের একটি পোশাকই ছিল। একজন রুচিবান ও নিরহঙ্কার মানুষ হিসেবে তিনি আমাকে পোশাকটি নিয়ে যেতে বলেন। সোয়েটারটি নিয়ে যেতে কোনোভাবেই আমার মন সায় দিচ্ছিল না। এক পর্যায়ে আমি জোর করেই তাকে দিয়ে দেই এবং পোশাকটি পরার অনুরোধ করি। তিনি হাসিমুখে বিদায় নেন। 
পরবর্তীতে ১/১১ সময় গ্রেফতার হন জনকণ্ঠ সম্পাদক। শুনে কষ্ট পেলাম। ছাড়া পেয়ে তিনি আবারো আমাকে ডাকেন। ব্যবসাবাণিজ্যের নানা সমস্যা ও সংকট নিয়ে আলাচনা করেন। আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করারও স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। নানা কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। একজন দেশপ্রেমিক, সাহসী, অসাম্প্রদায়িক ও আলোকিত মানুষ হিসেবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে তিনি আমাদের অন্তর থেকে সহযোগিতা করেছেন। সাহস জুগিয়েছেন। খবর নিয়েছেন। আগামী ২৯ আগস্ট জন্মদিনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত সকল দেশপ্রেমিক সংগ্রামী যোদ্ধার পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের অন্যতম সংগঠক 

×