
শেখ মুজিবুর রহমান
পরিবারের সবাইকে হারিয়ে বেঁচে রইলেন শেখ হাসিনা। আঁধার পথের যাত্রী হিসেবে রয়ে গেলেন আদরের ছোট বোন শেখ রেহানা। সর্বহারা দুবোন- কে কাকে দেয় সান্ত¦না। ছোট বোনের কথা ভেবে কান্না লুকিয়ে, চাপা কান্না বুকে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার অভিনয় করে গেলেন তিনি। বুকে পাথর চাপা দিয়ে শোককে শক্তিতে রূপান্তরের অনন্ত চেষ্টা। সময় ছিল বড় নিষ্ঠুর! যে দেশের জন্য তাঁদের এত ত্যাগ সে দেশ তাদের নিষিদ্ধ হলো। মা, বাবা, ভাই-ভাবি আত্মীয় স্বজনসহ পরিবারের সকল সদস্যকে হারালেও প্রিয়জনের কবরের পার্শ্বে গিয়ে তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করার অধিকারও তাদের ছিল না। একদিন নয় দুদিন নয়, সপ্তাহ নয় মাস নয়, বছর নয় অর্ধযুগ বাবা-মা-ভাইদের কবরের পাশে যেতে পারেননি তারা।
স্বর্গীয় সুখের পূর্ণতা নিয়ে শান্তির সুবাতাস বয়ে যেত যে বাড়িতে সেটি পরিণত হলো মৃত্যুপুরীতে; সেখানে হয়ে গেলো তারা অপাঙতেয়। রাজনৈতিক মিছিল স্লোগানের স্রোত প্রতিনিয়ত আঁচড়ে পড়তো বত্রিশ নম্বরের যে বাড়ির দেওয়ালে তা উর্দি পরা কিছু খেক শেয়ালের দখলে চলে গেল। রাজনৈতিক নেতৃবর্গ, কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিবৃন্দ, খবর সন্ধানী সাংবাদিক আর সাধারণ মানুষের আনাগোনায় মুখরিত ছোট্ট অথচ আট কোটি মানুষের আশ্রয়ের ঠিকানা ধানমণ্ডির সেই বাড়িটি জোরপূর্বক দখল করে দখলদাররা। যে বাড়িটির দেওয়ালজুড়ে বাবা-মা-ভাই-ভাবির অজ¯্র স্মৃতির সেই বাড়িটি আজ তাদের নয়। মা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের তিল তিল করে গড়া আটপৌরে বাড়িটি ভারী অস্ত্র হাতে সতর্ক পাহারারত সৈনিকের দখলে।
বাবার ভালোবাসা আর মায়ের আদরে গড়া সুখের সৌধে শুধুই বেদনার আহাজারি। চার দেয়ালে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত মুজিবের বজ্র কণ্ঠ, শেখ রাসেলের ভয়ার্ত আর্তনাত-আমি মায়ের কাছে যাব, আদরের ছোট্ট সে ভাই- যে ছিল দুই বোনের খেলার পুতুল- সারাঘরময় সে ভাইয়ের ছুটোছুটির শব্দ কান পেতে শোনার অধিকার তাদের নেই। চারদিকে রক্তের দাগ। যে রক্তের প্রতিটি কণায় মিশে আছে নিজের অস্তিত্বের স্মৃতি-সেখানে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে প্রিয়জনদের অস্তিত্ব অনুভব করার অনুমতি নেই তাদের। সেই বাড়িতে সকলের স্মৃতি স্মরণ করে চিৎকার করে কান্না করে খানিকটা হালকা হওয়ার অধিকারটুকুও তারা পায়নি।
চোখের জল তাদের শুকিয়ে যায়, শোকের অনুভূতিগুলো ভোতা হয়ে যায়। সব ভুলে পিতার অস্তিত্বের শপথ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামে রত হন তিনি। সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে, ঝড়ঝাঞ্ঝা মাথায় নিয়ে অর্ধযুগের অ্যাসাইলাম থেকে ফিরে এলেন এই বাংলায়। শোককে শক্তিতে রূপান্তরের শপথে বলীয়ান হয়ে হাল ধরলেন নৌকার।
প্রতিবছর আগস্ট আসে দুঃসহ স্মৃতি হয়ে। রাসেলের নিষ্পাপ মুখ, মায়ের স্নেহের পরশ, কামাল আর জামালের মলিন মুখ, বাবার হাস্যেজ্জ্বল চেহারা কী বারতা নিয়ে আসে ধানম-ির বত্রিশ নম্বরে? লাখো জনতা ধানম-িতে যায় শ্রদ্ধা জানাতে। শপথে বলীয়ান হতে। তিনি যান বাবার অস্তিত্বের উপস্থিতি অনুভব করতে। পিতা মুজিব যে শক্তির বলে বাঙালির রাজনৈতিক মুক্তি এনে দিয়েছিল- শেখ হাসিনা সেই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বাবার অসম্পূর্ণ কাজ বাঙালির মুক্তির শপথ নেন প্রতিবছর।
শেখ মুজিবকে হত্যা করেছিল যে ঘাতকদল তারা এখনো হত্যার পরোয়ানা নিয়ে শেখ হাসিনাকে অনুসরণ করে চলেছেন। দৃশ্যমান হামলা হয়েছে উনিশবার। কিন্তু অদৃশ্য ঘাতকের দল সদা ধাবমান তার পেছনে। এ ঘাতক শেখ হাসিনাকে হত্যা করে পঁচাত্তরের অসম্পূর্ণ কিলিং মিশন সমাপ্ত করতে চান। আর শেখ হাসিনা চান সীমিত এ জীবনে বাবার অসম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করতে। শূর আর অশূরের লড়াই চলমান। এ লড়াই দৃশ্যমান।
রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা রাজনীতির সৌন্দর্য। একদল জিতবে- সে দল যাবে ক্ষমতায়। যে দল অপেক্ষাকৃত কম আসন পাবেন সে যাবে বিরোধী দলে। এখানে সে সংস্কৃতি অনুপস্থিত। সাধারণত সুষ্ঠু রাজনীতিতে বিরোধী দলও সরকারি দলের ভালো কাজের স্বীকৃতি দেয়। এখানে হচ্ছে উল্টো। শেখ হাসিনা যখন পদ্মা সেতু করতে গেলেন তাতে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের অপ্রচারের ফলে সেতুর অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেল। নিজেদের টাকায় যখন কাজ শুরু হলো তখন প্রচারণা শুরু হলো- সেতুর কাজ ইহ জনমে শেষ হবে না। যখন কাজ হয়ে গেল তখন বলা হলো এ সেতুতে গাড়ি উঠলে ভেঙ্গে পড়বে। যখন গাড়ি চলা শুরু হলো তখন বলা হচ্ছে দুর্নীতি হয়েছে।
এভাবে বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, প্রযুক্তি, শিক্ষা, কৃষি, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধন হলো, তখন দুর্নীতিতে সব শেষ হয়ে গেল বলে জিগির তোলা হচ্ছে। অথচ এর সুফল ভোগ করছে সবাই। কিন্তু একেবারে নির্জলা অপপ্রচারগুলো কেন হচ্ছে? মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগ করে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দেশের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টির জন্য ডলার খরচ করে আন্তর্জাতিক দালাল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সেনাবাহিনীর বিদেশে মিশনে যাওয়া বন্ধ করতে নানা অপতৎপরতা ক্রমশ: প্রকাশ্য। এসব কেন হচ্ছে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।
ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নীল নকশা বাস্তবায়নের আগে এসব অপপ্রচারের পন্থা অবলম্বন করে এটা ঐতিহাসিক সত্য। আমেরিকা ইরাক আক্রমণের আগে সেখানে জীবাণু অস্ত্রের উপস্থিতির কথা বলেছিল। অথচ আক্রমণের পর দেখা গেল কিছুই নেই। মাঝখানে প্রাচীন সভ্যতার এক সমৃদ্ধ অঞ্চল ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এমন অনেক নজির রয়েছে। স্বাধীনতার পর ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যখন দেশ পুনঃগঠন করে উন্নয়নের মহাসড়কে প্রবেশ করালেন তখন নানা অপপ্রচার শুরু হয়েছিল। নানা গুজব ছড়িয়ে শেখ মুজিব সম্পর্কে মানুষের মনে চিড় ধরানোর অপতৎপরতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ কোন বলয়ের দিকে ঝুকছে সেসব অপ্রপ্রচারও ছিল। অথচ শেখ মুজিব ছিলেন জোট নিরপেক্ষ নীতির পক্ষে। পাকিস্তান শাসনামলেই তিনি সেন্টো সিয়াটোবিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীরা ভেতরে বাহিরে সমানভাবে সক্রিয় ছিল। গুজব ছড়ানো হয়েছিল- ধানমণ্ডির বাড়িতে নাকি টাকা-পয়সা সোনা-দানায় পরিপূর্ণ ছিল। অথচ ধানম-ির বাড়িতে অতি সাদামাটা কিছু গৃহস্থালীর সামগ্রী ছাড়া কিছুই ছিল না তা বঙ্গবন্ধু মিউজিয়ামে গেলে বোঝা যায়। শেখ কামালের মত সংস্কৃতি পাগল নির্মোহ একজন মানুষের বিরুদ্ধে অনেক গাল-গল্প বজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আর কান পাতলা বাঙালি জাতি নাকি এসব কথা বিশ্বাস করতেও শুরু করেছিল। কিন্তু সব শেষ হয়ে যখন সত্য প্রকাশিত হলো তখন হা হুতাশ করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। বরং শুরুতেই বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া উচিত ছিল।
ষড়যন্ত্রকারীরা ভালোভাবেই জানে শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্বের ধারের কাছে যাওয়ার মতো রাজনৈতিক বিকল্প এদেশে নেই। শত্রুরাও শেখ হাসিনার সততা, নিষ্ঠা আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে পারে না। বর্তমান বিশ্ব শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। খ্যাত হন এশিয়ার আইরন লেডি হিসেবে। এদেশের মানুষের কাছেও তার গ্রহণযোগ্যতা আকাশচুম্বি। শেখ হাসিনার নেত্বত্বে থাকা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বহীন রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার পথে বড় বাধা। সে কারণে তাঁকে আর তাঁর দলকে খাটো করা জন্য নানা অপপ্রচার চলছে। এমন কী একটি দলের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে জনসভায় দাঁড়িয়ে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনার গড়া ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা নিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ভার্চুয়াল অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। শত্রুর চোখে ধুলা দিয়ে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প যখন শেষ হচ্ছে তখন আর কিছু না পেয়ে এসব উন্নয়ন বিরোধী হেট ক্যাম্পেইন করা হচ্ছে। এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এসব গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। একটা কথা মনে রাখা দরকার শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাও যদি ১৫ আগস্টের বলী হতেন বাংলাদেশ কোনো না কোনোভাবে পাকিস্তানের আদর্শে ফিরে যেতো। হয়তো কনফেডারেশন হতো তাদের সঙ্গে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ব্যর্থ হতো। একটা বিষয় লক্ষণীয়, ১৯৭৫ সালে এক ধরনের ডান-বামের মিলন ঘটেছিল। বর্তমান পরিস্থিতি জনসমর্থনহীন সেসব গলাবাজ দল সম্পর্কে সতর্কতা প্রয়োজন।
আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক জনসভায় বলে থাকেন ১৯৭৫ আর ২০২৩ এক নয়। রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে এটি হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু নিরাপত্তার মাপকাঠিতে কোনো কিছুকেই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বড় ক্ষতি বয়ে আনে। ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা সাধরণত উন্নয়নের জোয়ারে প্রশান্ত মনে ভেসে বেড়ায়, রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে দূরে থাকে। অনেকে ব্যস্ত থাকে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটায়। অথচ তারা ভুলে যায় উন্নয়নের জোয়ারে কিছু আবর্জনাও ভেসে আসে। রাজনৈতিক সফলতার মূল ভিত্তি হলো সাংগঠনিক ঐক্য আর নেতৃত্বের দৃঢ়তা। অথচ স্বার্থের দ্বন্দ্বে ক্ষমতাসীনরা থাকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল অবস্থানে। সুযোগ সন্ধানীদের ভিড়ে ত্যাগী নেতাকর্মীরা হারিয়ে যায় অথবা আত্মমর্যাদা নিয়ে কিংবা অভিমানে দূরে সরে যায়। আর এসব সুযোগই গ্রহণ করে ষড়যন্ত্রকারীরা।
লেখক : অধ্যাপক, প্রাধ্যক্ষ
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়