ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

১৫ আগস্টের নির্মম শোকগাথা

ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার

প্রকাশিত: ০১:৪৪, ১৫ আগস্ট ২০২৩

১৫ আগস্টের নির্মম শোকগাথা

বঙ্গবন্ধুর

আমি বিয়ে করেছিলাম ১৯৬৫ সালে। বিয়ের পর পাঁচ-সাত বছর আমাদের বিবাহিত জীবন মোটামুটি সুখেরই ছিল। কিন্তু এরপর ওই সম্পর্ক আর তেমন সুখের রইল না। দোষটার ৮০ শতাংশের জন্য আমিই ছিলাম দায়ী। ১৯৭২-’৭৩ সাল থেকে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। ওই সময় আমি ছিলাম বাংলাদেশ বিমানের এবং ২৭ অ্যারোপ্লেনের ক্যাপ্টেন। ডমেস্টিক  ফ্লাইট করতাম। তারপর আড্ডা দিতাম, তেজগাঁও বিমানবন্দরের ক্রুরুমে।
বিমানবন্দরের ক্রুরুমে তাসের জুয়ার আসর বসত সকাল দশটা-সাড়ে দশটা থেকে। ফ্লাইট করার জন্য সকাল বেলায় বাসা থেকে বেরিয়ে যেতাম। তারপর বসতাম জুয়ার আড্ডায়। খাবার আসত বিমানবন্দরের রেস্তরাঁ থেকে। রেস্তরাঁর পাশেই ছিল একটা মদের দোকান। বিকেল বেলায় শুরু হতো খানা-পিনা, জুয়ার আড্ডা এবং একই সঙ্গে মদ্যপান।
আমার ধূমপান এবং মদ্যপানের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। মদ্যপ অবস্থায় বাসায় ফিরতাম রাত বারোটায়। বাসায় এসে ঘুমিয়ে যেতাম। আমার স্ত্রীকে আমি সময় দিতাম না। আমার তখন দুটি সন্তান ছিল। তাদেরও সময় দিতাম না।
আমার ও স্ত্রীর মধ্যকার তিক্ত সম্পর্কের মূলে ছিল তাকে সময় না দেওয়া। অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্য আমার চরিত্রের প্রতি তার সন্দেহ প্রবণতা বা ঈর্ষাপরায়ণতা দিন দিন বাড়তে লাগল। ভালোবাসা যত তীব্র হয়, ঈর্ষাপরায়ণতাও নাকি ততটা বেশি হয়।
আমার স্ত্রীর ঈর্ষাপরায়ণতার একটি উদাহরণ দিচ্ছি-
১৯৭২-’৭৩ সালে আমার বাসা ছিল এলিফ্যান্ট রোডের একটি দোতলা ভবনে। রাস্তার উল্টো দিকে পশ্চিম পাশে ছিল একজন মুক্তিযুদ্ধে শহীদের স্ত্রীর বাসা। তিনি ছিলেন খুব সুন্দরী। আমি যদি পশ্চিম পাশের বাসার দিকে তাকাতাম তবে আমার স্ত্রী খুব রেগে যেত। অর্থাৎ পশ্চিম দিকে তাকানো আমার জন্য নিষিদ্ধ ছিল। আমার ওই স্ত্রী ১৯৯০ সালে মারা যায়। কিন্তু পশ্চিম দিকে না তাকানোর অভ্যাসটা এখনো আমার রয়ে গেছে।
॥ দুই ॥
আমার শ্বশুর দেশ বিভাগের আগে কলকাতায় একটি চাকরি করতেন এবং মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন। বঙ্গবন্ধুও তখন মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন। আমার শ্বশুরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার শ্বশুর খুলনার বি কে হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন এবং একই সঙ্গে শান্তি কমিটির একজন সদস্যও ছিলেন। পাকবাহিনীর সহায়তায় তিনি খুলনা শহরে একটি হিন্দুবাড়ি দখল করেছিলেন। ১৬ ডিসেম্বরের আগেই তিনি যখন বুঝলেন পাকবাহিনী পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন তিনি খুলনা থেকে পালিয়ে এসে আমার ঢাকার বাসায় আশ্রয় নিলেন। 
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে ফিরে আসার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর গুণগান করে এবং স্বাধীনতার পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ লিখলেন। এরপর একদিন সুযোগ বুঝে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বললেন-দেখুন, আমি খুলনায় গেলে, আপনার আওয়ামীপন্থিরা আমাকে শান্তি কমিটিতে থাকার জন্য মেরে ফেলবে। আমি বৃদ্ধ বয়সে কোথায় যাব?
বঙ্গবন্ধু তাকে সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার পদে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। তার অধীনে দুজন সাইন্টিফিক অফিসারও দিলেন। সায়েন্স ল্যাবরেটরির ভেতরে নিরাপদে থাকার জন্য তাকে কোয়ার্টারও দেওয়া হলো। বিষয়টাকে আমি বলব, এটা বঙ্গবন্ধুর বিশেষ ক্ষমা এবং তাঁর মহত্ত্ব প্রকাশের একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

॥ তিন ॥
১৫ আগস্ট। সকাল বেলায় আমার ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু যাওয়ার ফ্লাইট ছিল। আমার স্ত্রী এক কাপ চা করে নিয়ে এসে দিল। আমি ইউনিফর্ম পরে তৈরি। এমন সময় নিচতলা থেকে আমার বাড়িওয়ালা এসে আমার ঘরের দরজা ধাক্কা দিতে শুরু করলেন। দরজা খুলে দিতেই তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, বঙ্গবন্ধুকে খুন করা হয়েছে। মেজর ডালিম নামের একজন আর্মি অফিসার বাংলাদেশ বেতারে ভাষণ দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সব বিস্তারিত জানতে পারলাম। শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। শেখ ফজলুল হক মণিকে এবং তাঁর পরিবারের অনেককেই হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বোনের স্বামী সেরনিয়াবাতের পরিবারেরও অনেককে হত্যা করা হয়েছে।
সবকিছু শুনে আর কিছু চিন্তা করতে পারছিলাম না। বাসা থেকে কোথাও বের হলাম না। আমার বড় ছেলে অঞ্জন এবং বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেল দুজনে ছিল খুব ভালো বন্ধু। ওরা এক সঙ্গে ইউনিভার্সিটি ল্যাব স্কুলে পড়ত। অঞ্জন বারবার প্রশ্ন করল, বাবা, রাসেলকে নিশ্চয়ই ওরা হত্যা করেনি। ওকে কি বলে সান্ত¡না দেব তা আমার জানা ছিল না।
আমার বাসার টেলিফোনটা সারাক্ষণ বাজত। আজ একটিবারের জন্যও টেলিফোনটা বাজল না। কেউ আমার বাসায় এলো না। সবাই জানত, আমি বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠ। তাই সবাই আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখাটা নিরাপদ মনে করছিল।

॥ চার ॥
দেশ স্বাধীনতার পর স্ত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা খুব খারাপ হয়ে যায়। এ কথা আগেই উল্লেখ করেছি। আর সম্পর্কটা খারাপ হওয়ার জন্য যে আমিই দায়ী এ কথা আমি বুঝতে পারতাম না। নিজের দোষটা কেউ দেখতে পায় না। স্ত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে আমরা ডিভোর্স করারও চিন্তা করেছিলাম। পারছিলাম না, কারণ তখন আমাদের দুটি সন্তান ছিল।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে পেতে আমি এবং আমার স্ত্রী আমাদের সন্তানদ্বয়কে নিয়ে শোয়ার ঘরে চুপচাপ বসেছিলাম। আমরা দুপুরের খাওয়া-দাওয়াও করলাম না।
বিকেল হয়ে গেল। এমন সময় আমার শ্বশুর এলেন। দেখলাম তার বদনখানা খুশিতে টগবগ করছিল। তিনি আমাদের বিছানার কাছে একখানা চেয়ার টেনে বসলেন। আমাদের বিমর্ষ ভাবটা পর্যন্ত খেয়াল করলেন না। তিনি শুধু বললেন, হারামজাদা একটা বদমায়েস ছিল। আমাদেরকে ভারতের গোলাম করে রেখে গিয়েছে।
আমার এবং স্ত্রীর বুঝতে অসুবিধা হলো না, শ্বশুর মহাশয় কাকে উদ্দেশ্য করে ‘হারামজাদা-বদমায়েস’ বলছে!
আমার স্ত্রী হঠাৎ করে ক্ষেপে গেল। সে তার পিতাকে বলল, এখনই আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যাও।
আমার স্ত্রীর বলা এমন স্পষ্ট কথা শুনে তার পিতা যেন নিজ কর্ণদ্বয়কে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আমার স্ত্রী দ্বিতীয়বার আবার বলল, তুমি আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যাও। এবার তিনি কোনো কথা না বলে, আমাদের বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমার স্ত্রী বাসার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। শত হলেও নিজের পিতা! তাই নিজ পিতাকে অমনভাবে বাসা থেকে বের করে দিয়ে সে খুব দুঃখ পেয়েছিল। আমরা একে অপরকে সান্ত¡না দেওয়ার জন্য জড়িয়ে ধরে নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম। এতদিন আমাদের দুজনার সম্পর্কের মাঝে যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল, সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের আনুগত্য, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার জোরে সেই তিক্ততা ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গেল মুহূর্তে।
 লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, পাইলট ’৭১ এ কিলোফ্লাইট 

×