ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

প্রভাত ফেরীতে মুজিব

সেলিনা হোসেন

প্রকাশিত: ০১:৩০, ১৫ আগস্ট ২০২৩

প্রভাত ফেরীতে মুজিব

একুশের প্রভাত ফেরীতে যাওয়ার জন্য বের হয়েছেন মুজিব

একুশের প্রভাত ফেরীতে যাওয়ার জন্য বের হয়েছেন মুজিব। সূর্যের হালকা আলো চারদিকে ছড়িয়ে আছে। লেকের ওপরে আবছা কুয়াশা। এক মুহূর্ত লেকের সামনে দাঁড়ান। বুকের ভেতরে শহীদদের চেহারা প্রতিবাদী চেতনায় ফুটে থাকে। যে কয়জন শহীদ হয়েছেন তাঁদের স্মরণে তাঁর হাতে সে কয়টা লাল গোলাপ। রাস্তার মাথার দিকে তাকিয়ে দেখেন ফুল নিয়ে পথযাত্রায় নেমেছেম ানুষ। তাঁর রাজনীতির কর্মীরা অনেকে তাঁর সঙ্গে পথে শামিল হবে। অনেকে শহীদ মিনারের সামনে তাঁর জন্য অপেক্ষা করবে। হাতের গোলাপ নাকে ধরে নিজেকে বলেন, তোমাদের স্মরণে বুকের ভেতর রক্ত গোলাপ ফোটে সোনার ছেলেরা। তোমরা মাতৃভাষার জন্য আমাদের ইতিহাস সৃষ্টি করেছ। তোমরা অমর, তোমরা অমর।
রাস্তার মাথায় এলে দেখতে পান কবি সুফিয়া কামাল দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি একুশের ভোরে শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দেন। মুজিব তাঁর কাছে গেলে সুফিয়া কামাল বলেন, তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি ভাই। তোমার সঙ্গে পায়ে হেঁটে যেতে পারলে গর্ব হয়। 
আহারে, আমার আপাটা এরকম করে হেঁটে যাবে? আপনি হেঁটে যাবেন না। আপনি রিকশায় যান। আমরা হেঁটে যাই। 
না ভাই, আমি হেঁটে যেতে পারব। তোমাদের সঙ্গে হাঁটলে আমার কষ্ট হয় না। তুমি থাকলে তো আমি রিকশায় উঠবইনা। চলো যাই। তোমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। 
মুজিব হাসতে হাসতে বলে, ‘ও আমার দেশে রমাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’আপা আপনি কবি। আন্দোলনে সক্রিয় থাকেন। দেশের জন্য আপনার চিন্তা অনেক গভীর। আপনার কবিতাপড়ে আমি মুগ্ধ হই। 
চলো, চলো। 
আমরা রোদ ওঠার আগেই পৌঁছে যাব শহীদ মিনারে। 
মিছিলের আরও অনেকেই একসঙ্গে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিকই। আমাদের ফুলের তোড়ার গায়ে রোদ লাগবে না। ফুল শুকিয়ে যাবেনা। 
সুফিয়া কামাল জোরে জোরে বলেন, আমরা কখনো শুকনো ফুল শহীদ মিনারে দেবনা। আমরা কখনো দেইনি। আমাদের তরতাজা ফুলের সৌরভ শহীদের রক্তে মিশে যাবে। 
তখন ভেসে আসে গানআমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারিআমি কি ভুলিতে পারি
গানের বাণী-সুরে ভরে যায় প্রভাত ফেরী। সূর্যের আলো বাড়ছে, এখনো তেমন রোদ ছড়ায়নি। মুজিব সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইতে থাকেন। ততক্ষণে সবাই নীলক্ষেতে চলেএসেছে। পায়ে হেঁটে গেলে আর বেশি দূর নয়। একজন ছেলে কাছে এসে বলে, মুজিব ভাই মওলানা ভাসানী যাচ্ছেন। আপনি এগিয়ে গেলে ওনার সঙ্গে দেখা হবে। 
না, আমার আপাকে ছেড়ে আমি তাড়াতাড়ি হাঁটব না। আপা পিছিয়ে পড়তে পারেন। 
সুফিয়া কামাল মুখ ঘুরিয়ে বলেন, একুশের প্রভাত ফেরী আমার প্রাণের টান। আমরা দুইজনে ধানম-ির বত্রিশ নম্বর রাস্তা থেকে রওনা করি। আমাদের ঠিকানা যেমন কাছাকাছি, তেমন চিন্তা-চেতনার দিকও একই রকম।
ঠিক বলেছেন আপা। আপনি কবি-রাজনীতিবিদ। আর আমি রাজনীতিবিদ-কবি। 
পাশের দু’একজন হাসতে হাসতে বলে, এখন থেকে আমরা আপনাকে মুজিব ভাই না ডেকে, কবি ভাই ডাকব। 
তা হবে না, আমার রাজনীতি আগে। আর সুফিয়া কামাল আপার কবিতা আগে। যেখানে রাজনীতির সংগ্রাম সেখানে তিনি সামনে গিয়ে দাঁড়ান। ঠিক বলেছি আপা? 
একদম ঠিক। মানুষের অধিকারের প্রশ্নে আমি পিছিয়ে থাকতে চাই না। রাজপথে মিছিলে-মিটিংয়ে অংশ নিয়ে প্রতিবাদ করতে চাই। 
আপনারা আমাদের আলোর পথের মানুষ। আপনাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করব কবি আপা। চলেন এগোই। 
হাঁটতে শুরু করে সবাই। বিশ^বিদ্যালয় এলাকা পার হওয়ার আগেই বাবুপুরা বস্তির একটি দশ বছরের ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে মুজিবের পা জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে ডাকে, মুজিব ভাই, মুজিব ভাই। 
কি রে সোনারা কি হয়েছে? 
আমরা আপনার সঙ্গে শহীদ মিনারে যাব। 
চল, চল, আয় আমার সঙ্গে। 
আমার হাতে ফুল নাই। শহীদ মিনারে তো আজকে ফুল ছাড়া যাওয়া যাবে না। 
মুজিব একটি গোলাপ দিয়ে বলে, নে এটা নে। 
একটা নেব না, সব দ্যান। 
তখন পেছন থেকে আরও কয়েক জন এসে জড়ো হয়। চেঁচিয়ে বলে, আমাদেরকেও ফুল দেন। 
তোরা সবাই গাছের ফুল নিয়ে আসিসনি কেন? 
আপনিতো আমাদের কাছে বটগাছ। আমরা বটগাছ থেকে ফুল নেব। 
আশোপাশে হেঁটে যাওয়া দলের কর্মীরা তালি দেয়। বলে, শাবাশ, শাবাশ। মুজিব ভাই ওদেরকে একটি করে গোলাপ দিয়ে দেন। আপনাকে আমাদের আনা বড় ফুলের তোড়া দিচ্ছি। 
মুজিব শিশুদের হাতে একটি করে গোলাপ দিলে ওরা দৌড়াতে শুরু করে। বলতে থাকে, আমাদের শহীদরা, আমাদের শহীদরা। ফুলের মালা গলায় পর। 
সুফিয়া কামাল অবাক হয়ে বলে, এই শিশুরাও এতকিছু জানে। 
মাতৃভাষার জন্য জীবন দানকারী শহীদদের কথা তো ওদের জানতে হবে কবি আপা। 
এসব কিছু তোমার অবদান মুজিব। মুজিব দেশবাসীকে নিজেদের ইতিহাস জানিয়ে তৈরি করছ। তোমার রাজনীতি ভিন্ন মাত্রার। তোমার মতো দেশপ্রেমিক হয় না। আমিও তোমার কথায় অনুপ্রাণিত হই। আজকে শিশুদের কাছে এসব শুনে মনে হলো ওরাও তৈরি হচ্ছে। তুমি ওদের প্রাণের মুজিব ভাই। 
মুজিব হাসিমুখে মাথা নাড়ে। আর কোনো কথা হয় না। মিছিল বিশ^বিদ্যালয় এলাকা ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায়। মুজিব ভাবে, সুফিয়া কামালের কারণে আজকের প্রভাত ফেরী অন্য রকম হলো। সুফিয়া কামাল ভাবে, রাজনীতিতে মুজিবের কোনো তুলনা হয় না। তার ত্যাগের কোনো সীমা নেই। তার নিষ্ঠার কোনো পরিসীমা নেই। মানুষের জন্য মমতা আর আত্মার একটা টান আছে। তার মতো একজন মানুষ সারাবিশে^ আমি দেখতে পাচ্ছি না। তার পলায়নী মনোবৃত্তি নেই। যেখানে সংকট, যেখানে সংগ্রাম, যেখানে সংঘাত দেখেছে, সে এসে আগে দাঁড়িয়েছে। মরণকে ভয় করেনি। এসব ভেবে সুফিয়া কামাল ঠিক করে বাড়ি ফিরে এই কথাগুলো লিখে রাখতে হবে। ‘আমার দেখা মুজিব’ নামে আমি একটি লেখা লিখব। আমার এই চিন্তা হারিয়ে যেতে দেব না। যে ছোটরা দৌড়ে এসে ওর পা জড়িয়ে ধরে ওরা এই লেখা পড়লে গভীরভাযে চিনবে মুজিবকে। সামনে আরও সুদিন আছে আমাদের। মুজিবের হাত ধরে সেইসব দিন আমাদের সামনে নতুন দিনের সূচনা করবে। 
সবাই শহীদ মিনারের কাছাকাছি এসে যায়। শুনতে পায় একুশের সঙ্গীতআমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারিআমি কি ভুলিতে পারি
সুফিয়া কামাল নিজেও গুনগুন করে গাইতে থাকে। 
আপা আসেন একসঙ্গে গান গাই। এই তোমরা সবাই আমাদের সঙ্গে গাও। শুরু হয় একুশের গান। গান শেষে ফুলের বড় তোড়া সামনে নিয়ে মুজিব বলে, আপা ধরেন। আমি আর আপনি এক সঙ্গে ফুল দেব। 
দুজনে ফুল নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে শহীদ মিনারের সামনে রাখে। দলের কর্মীরা সেøাগান দিতে থাকে একুশের স্মৃতি অমর হোক
একুশের শহীদদের লাল সালাম। 
দুজনে নেমে আসে শহীদ মিনারের উপর থেকে। 
আপা, আপনাকে একটা রিকশায় তুলে দেই। 
হ্যাঁ, দাও। আমি চলে যাই। তুমিতো থাকবে। 
হ্যাঁ, আমি থাকব। 
আমি একা একা এই শহরে হাঁটব না। মিছিল হলে আমার সাহস বাড়ে। শহীদ মিনারে আমি সবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে একজন সাহসী মানুষ হয়ে যাই। 
এজন্যই তো আপনি কবি আপাগো। আজকে বিকালে আপনি আমার বাড়িতে আসবেন। রেণু আপনার কথা খুব বলে। 
আমি জানি রেণু আমাকে খুব ভালোবাসে। ওর মতো মেয়ে হয় না। এত শান্ত, ধীর, স্থির। 
আমাদের জন্য দোয়া করবেন আপা। 
তুমি বিকালে আমার বাসায় এসো। পিঠা খাওয়াব। 
আশপাশের ছেলেমেয়েরা হাসতে হাসতে বলে, মুজিব হাত তুলে ওদের কথা থামায়। রিকশাওয়ালাকে বলে, এ্যাই যাও, এগোও। ঠিকঠাক মতো আপাকে বাড়ি পৌঁছে দিও। 
তুমি আসবে না বিকালে? 
এখন কিছু বলতে পারছি না। সামনে অনেক কাজ। কখন বাড়ি ফিরব জানি না। 
আচ্ছা, যাই। সময় পেলে এসো। না আসলে বুঝব সময় পাওনি। 
রিকশা চলে যায়। 
মুজিব শহীদ মিনারের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজের পার্টির তরফ থেকে ফুল দেয়া হয়। ছোট ছোট ছেলেরা দৌড় দিয়ে উঠে যায় উপরে। ফুল দিয়ে নেমে আসে। ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। 
মুজিবের হাত ধরে বলে, আজকে আমাদের বাড়িতে যেতে হবে। 
এই ভাগ তোরা। 
দলের ছেলেরা ওদের তাড়া দেয়।
না, আমরা ভাগব না। আমরা মুজিব ভাইকে নিয়ে যাব। 
মুজিব ভাই তোদের বস্তিতে যাবে না। 
তাহলে আমরা কোথায় থাকব? আমাদেরকে কে দালানে রাখবে? 
মুজিব দলের ছেলেদের ধমক দিয়ে বলে, এই তোরা থাম। বস্তিতে ছেয়ে আছে ঢাকা শহর। ওদের জন্য কি তোরা দালান বানাতে পারবি? শুধু শুধু ওদের মন খারাপ করে দিচ্ছিস কেন? এই তোরা ওই পাশে গিয়ে দাঁড়া। আমি যাব তোদের সঙ্গে। 
হুররে। মুজিব ভাই, মুজিব ভাই। 
ছেলেরা দৌড়ে শহীদ মিনারের এক পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফুলের বিতান থেকে একটা একটা ফুল ছিঁড়ে হাতে নেয়। 
মুজিব মওলানা ভাসানীর সঙ্গে কথা বলেন। রাজনীতির নানা দিক বিভিন্ন সূত্রে কথায় আসে। এক পর্যায়ে ভাসানী বলেন, তোমার নেতৃত্ব বাঙালির সামনে ফুটে উঠেছে মুজিব। যেখানেই যাই অনেকেই তোমার কথা বলে। সাধারণ মানুষের মাঝে তোমার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি।
মুজিব বলে, আমি ঠিক করেছি আমি স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলব। আমাদের পূর্ববঙ্গকে শোষণ করা ওদের চলবে না। বাঙালির সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের পাট বিক্রি করে পুরো অর্থ ওরা নিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে লাগাচ্ছে। যথেষ্ট করেছে। আর মানব না।
ভালোই বলেছ। শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে শপথ নেওয়া হলো। আজকে যাই। আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে। 
হ্যাঁ হবে, অবশ্যই হবে। 
হাসিমুখে চলে যান মওলানা ভাসানী। শহীদ মিনার থেকে লোকজন চলে যাচ্ছে। ফুল দেওয়ার পর্ব শেষ। বেলা বেড়েছে। চার দিকে রোদ ঝকঝক করছে। মুজিব শিশুদের দিকে এগিয়ে যান। ওরা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। হাতের ফুলগুলো তাঁর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে, আমাদের তো ফুল কিনার টাকা নেই। এই ফুল কয়টা আপনার জন্য রেখেছি। আপনি বসেন আমরা আপনাকে ফুল দেব। 
বসতে হবে না আমার হাতে দে। 
সিরাজ বলে, না বসতে হবে। বসলে আমরা মাথায় দিব। ফুল দিয়ে মাথা ভরে দেব। 
বাব্বা তোরা এতকিছু ভেবেছিস। 
বসেন, বসেন মুজিব ভাই। রব হাততালি দিতে থাকে। চার পাশের নেতা-কর্মীরা হাসতে থাকে। 
ঠিক আছে তোদের অনুরোধ রাখছি। 
মুজিব বসেন। ছেলেরা চার দিকে দাঁড়িয়ে মাথায় ফুল রেখে দেয়। 
আমি দাঁড়ালে তো ফুলগুলো পড়ে যাবে। তখন কি করবি তোরা?
আমরা সব ফুল তুলে নেব। বাড়ি নিয়ে যাব। আমাদের মায়েদেরকে ফুল দিয়ে বলব আপনাকে ফুল দিতে। মায়েদের  তো ফুল কিনার টাকা নেই। 
এদের তো অনেক বুদ্ধি। 
মুজিব হাসতে হাসতে উঠে পড়েন। জসীম বলে, আমরা একদিন বস্তির ঘর ফুল দিয়ে সাজাব। মাকে বলব, খিচুড়ি আর চিংড়ি মাছরান্না করতে। আপনি খাবেন তো মুজিব ভাই? 
আমি তোদেরকে খাইয়ে দেব। তোদের পেট পুরো ঢোল হয়ে যাবে। 
ঠিক, ঠিক। আমরা সবাই ঢোল হব। মুজিব ভাইয়ের মিটিংয়ে আমরা সবাই ঢোল বাজাব। 
মুজিব হাসতে হাসতে বলেন, ছেলেগুলো খুব উচ্ছ্বল। 
মুজিব ভাই চলেন বাবুপুরা বস্তিতে। 
আমি কিন্তু একটু দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসব। আমাকে বসতে বলবি না তোরা। 
আমাদের ঘরে তো চেয়ার নেই। আমরাতো বসতে দিতে পারব না। 
আমি বসব না, আমার সময় নেই। তাড়াতাড়ি চল। 
সিরাজ ফুলগুলো নান্টুকে দিয়ে বলে, তুই ফুলগুলো নিয়ে দৌড় দিয়ে চলে যা। মায়েদের বলবি ফুলহাতে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। মুজিব ভাইয়ের দুই হাত ভরে মায়েরা ফুল দেবে। 
মুজিব হাঁটতে শুরু করলে দলের কর্মীরাও পিছু নেয়। ওরা বলে, আমরা ভেতরে ঢুকব না। রেল লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকব। মুজিব ভাইকে নিয়ে ফিরব। 
ছুটে আসছে ট্রেন। কর্মীরা পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। মুজিব ছোটদের সঙ্গে বস্তিতে ঢোকেন। ছেলেরা তাঁকে ঘিরে নৃত্যের ভঙ্গিতে এগোচ্ছে। মুজিব দূর থেকে দেখতে পান কয়েক জননারী ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে এগিয়ে গেলে নারীরা ফুলগুলো তাঁর হাতে না দিয়ে পায়ের কাছে রাখেন। তারপর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। 
মুজিব মাথার ওপর হাত রেখে বলেন, উঠেন মায়েরা। ছোটরা ফুলগুলো হাতে তুলে নেয়। বলে, এগুলো শহীদ মিনারের ফুল। 
ঠিক বলেছিস সোনারা। তোদেরকে দোয়া করি। তোরা ভালো থাকিস। 
একজন মা বলে, আপনার জন্য এই মোড়াটা রেখেছি। এখানে একটু বসেন। 
না, আমি আর বসব না। আমি যাই। 
আপনার জন্য কয়েকটা পিঠা রেখেছি। খাবেন না? 
আজকে আমাকে সুফিয়া কামাল আপা পিঠা খাওয়াবেন। এই পিঠাগুলো আপনারা খান। ছেলেদেরকে খেতে দেন। 
চার পাশে নারী-পুরুষের ভিড় জমে গেছে। সবাই মিলে স্লোগান দিচ্ছেমুজিব ভাই, মুজিব ভাই। জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ। 
বাবুপুরা বস্তির মানুষেরা চারদিক থেকে ছুটে আসে। সেøাগান থেমে যায়। বয়সী মানুষেরা বলে, মুজিব ভাই আপনি আমাদের জন্য বক্তৃতা করেন। আপনার বক্তৃতা শুনলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। 
আপনারা জানেন আজকে একুশে ফেব্রুয়ারি। 
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা জানি আজকে শহীদ দিবস। 
তাহলে চলেন সবাই মিলে সেøাগান দেই। মুজিব হাত তুলে বলেন, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না শহীদ দিবস অমর হোক। 
বস্তি জুড়ে স্লোগানের ঢেউ বয়ে যায়। নারী-পুরুষ-শিশুদের কন্ঠে স্লোগানের শব্দ বাবুপরা বস্তি ছাড়িয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের এলাকার দিকে ছড়িয়ে যায়। মুজিব হাত নেড়ে হাঁটতে শুরু করলে সবাই স্লোগান দিতে দিতে পেছনে আসে। 
নীলক্ষেতের কাছে এলে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্ররা ওদের সঙ্গে যুক্ত হয়। ওদের স্লোগান থামলে বলে, এবার আপনারা এই স্লোগান দেন। 
বলেন, বলেন। নতুন স্লোগান বলেন।
[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশছেলেরা সমবেত কন্ঠে স্লোগান দেয়, শেখ মুজিব এসেছেবাঙালি জেগেছে।
সমবেত কন্ঠে ধ্বনিত হয় সেøাগান শেখ মুজিব এসেছেবাঙালি জেগেছে।
মুখর হয়ে ওঠে এলাকা। চারদিক থেকে বেরিয়ে আসে অনেক মানুষ। সবাই মিলে সেøাগান দিতে থাকে। 

 লেখক : কথাসাহিত্যক, সভাপতি বাংলা একাডেমি

×