
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
একটি দেশ, একটি মানচিত্র, একটি ভূ-খণ্ড যার নেতৃত্বে আমরা পেয়েছিলাম তাঁর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি অবিসংবাদিত নেতা, তিনি আপোসহীন নেতা। তিনি বাঙালি জাতির-জাতির পিতা, তিনি জাতির জনক, তিনি স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি স্বাধীনতার ঘোষক। তিনি একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের অভ্যুদয়ের কারিগর। পৃথিবীর ভূ-খ-ে যার নাম ‘বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত।
যাঁর অকুতোভয় সাহস আর সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নেতৃত্বদানের কারণে আমরা পেয়েছিলাম আজকের এই বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশ একদিনের ফসল নয়। দীর্ঘ তেইশ বছরের আন্দোলন, সংগ্রামে তিল তিল করে গড়ে ওঠা ফসল। যাঁর বজ্রকণ্ঠের জ্বালাময়ী অভিভাষণে গর্জে উঠেছিল সংগ্রামী বাঙালি জাতি। যাঁর তেজোঃদীপ্ত বক্তৃতামালা স্বাধীনতান্মুখ বাংলা ভাষাভাষী বাঙালির মনে চেতনার বীজ বুনে ছিল। যে ভাষণ শুনে পূর্ববঙ্গের মানুষ ফুঁসে উঠেছিল। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিল।
পশ্চিমপাকিস্তানি, শাসন, শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে যিনি পূর্বপাকিস্তানের জনমানুষের পক্ষে কথা বলেছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি পশ্চিমপাকিস্তানি নির্যাতন, নিপীড়ন আর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হয়ে বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অবদান বাঙালির ইতিহাসে অবিস্মরণীয়।
বাঙালির মুক্তিসনদ ছয়দফার ইস্তেহারে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল পূর্ববাংলার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। এই ছয় দফার প্রেক্ষাপটে ১৯৬৯-এর শুরু হয় গণআন্দোলন। যে আন্দোলনে পূর্বপাকিস্তানজুড়ে শুরু হয় গণবিক্ষোভ। গণজোয়ার সৃষ্টি হয় বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে। তাদের এক দফা এক দাবি ছিল পূর্বপাকিস্তানের স্বাধীনতা চাই। স্বাধীনতার দাবিতে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের সাড়ে সাতকোটি বাঙালি সোচ্চার কণ্ঠে জেগে উঠেছিল, মিছিল মিটিং, জনসভা আর গণবিক্ষোভে। যার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
পূর্ববাংলার মানুষের দাবি আর আন্দোলন চলতে চলতে চলে আসে ১৯৭০-এর নির্বাচন। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমগ্র পাকিস্তানে নির্বাচনের আয়োজন করে। পাকিস্তান সরকার ভেবেছিল নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তানের নেতা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ পরাজিত হবে। আর তখন বঙ্গবন্ধুর তর্জন-গর্জন একেবারে থেমে যাবে। কিন্তু ফল হলো উল্টো। পাকিস্তানের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিমপাকিস্তানের ভুট্টো-ইয়াহিয়া গং বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা দেবে না বলে তালবাহানা শুরু করেন। অবশেষে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
এমন ঘোষণায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার দিশা না পেয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপোসরফা অধিবেশনের কথা বলে গোপনে গোপনে অস্ত্র আর সৈন্য আমদানি করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতের আঁধারে একযোগে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিক নামের ঘাতকরা আপামর বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইনের তথ্য অনুযায়ী শুধু ঢাকা শহরেই নির্মমভাবে ওই রাতে হত্যা করা হয় ৭০০০ মানুষকে এবং বন্দি করা হয় ৩০০০ মানুষকে। যাদের পরবর্তীতে হত্যা করা হয়। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে বন্দি হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সকল নেতাকর্মীর মাঝে ছড়িয়ে দেন। অবশেষে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির কাক্সিক্ষত বিজয় অর্জন হয় এবং দেশ স্বাধীন হয়।
দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত, যুদ্ধবিধ্বস্ত জন্মভূমি বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন। তারপর দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি দেশটাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে ঢেলে সাজানোর প্রয়াসে যা যা করণীয় সবই করেছিলেন। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ যেখানে, কেমন করে ভালো থাকবেন-বেঁচে থাকবেন সেখানে!’ বঙ্গবন্ধুর বেলায়ও ঠিক সেটাই ঘটল। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কাছের মানুষ যিনি, ভালোমন্দ রান্না হলে বঙ্গবন্ধু যাকে না দিয়ে খেতেন না।
সেই খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে এবং বঙ্গবন্ধু যাদের সৈনিক পদে প্রমোশন দিয়ে, অনেক বিশ্বাস করে দেশের সেনা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগ করে ছিলেন। তাদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। বিশ্বাসঘাতকতার এমন নিদর্শন বোধ হয় পৃথিবীর ইতিহাসে একটাও খুঁজে পাওয়া যায় না। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার ভোর রাতে (৪.৩০ মিনিট) তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যায় শিশু থেকে শুরু করে বাড়ির কাজের লোক পর্যন্ত কেউ রেহাই পায়নি। এখানে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে যে, ক্ষমতা দখলের জন্য শুধু দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে মারবেন। কিন্তু সপরিবারে কেন মারলেন? খুনি বা ঘাতক চক্রের একটাই উদ্দেশ্য ছিল।
বঙ্গবন্ধুর কোনো উত্তরসূরি যেন বাংলার মাটিতে জীবিত না থাকে। তাহলে তারা পরবর্তীতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আবার তাদের আদর্শের পুনঃরুত্থান ঘটাবে। কিন্তু ঘাতক চক্রের বিধি বাম যে, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শী শ্রেষ্ঠতম দুই সন্তান শেখ হাসিনা (বর্তমান বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থানের কারণে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। যাঁদের নেতৃত্বে আজকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার দৃশ্যপট বাস্তবায়ন হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপায়ণ অতিক্রম করে স্মার্ট বাংলাদেশের পরিক্রমা শুরু হয়েছে।
সেই কালরাতে ৩২ নম্বর ধানম-ির বাড়িতে ঘাতকদের হাতে-বঙ্গবন্ধু, তাঁর স্ত্রী, তিনপুত্র, দুই পুত্রবধূ নিকট আত্মীয়সহ ২৬ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। যার মধ্যে ৩ জন শিশু ছিল। যাদের হত্যা করা হয়েছিল-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ আবু নাসের, বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শেখ কামাল, সুলতানা কামাল খুকী, শেখ জামাল, পারভীন জামাল রোজী, শেখ রাসেল, শেখ ফজলুল হক মনি, বেগম আরজুমনি, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, বেবী সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, নইমখান রিন্টু, পোটকা (গৃহভৃত্য), লক্ষ্মীর মা (গৃহভৃত্য), সিদ্দিকুর রহমান (পুলিশ কর্মকর্তা), সামছুল হক (পুলিশ কর্মকর্তা), কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ (নবনিযুক্ত ডিজি এফআই প্রধান)।
এ ছাড়া মর্টার ও গোলার আঘাতে নিহত হন-রাজিয়া বেগম, নাসিমা, হাবিবুর রহমান, আনোয়ারা বেগম, ময়ফুল বিবি, সাবেরা বেগম, আবদুল্লাহ, রফিকুল, সাফিয়া খাতুন, শাহাবুদ্দিন, কাশেদা, আমিনউদ্দিন, হনুফা বিবি। আহত হন ৫ জন। বেগম আবদুর রব সেরনিয়াবাত, বেগম আবুল হাসনাত, বিউটি সেরনিয়াবাত, আবুল খায়ের আবদুল্লাহ, হেনা সেরনিয়াবাত।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নির্মমতার ইতিহাস বোধহয় আর কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। স্বদেশী হানাদার আর শত্রুর কবলে একটি জাতির জনককে হত্যার কাহিনী ইতিহাসে বড়ই বেমানান। যাঁর নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলো । তাঁকে চিরতরে নিঃশ্বেষ করতে এমন হৃদয়বিদারক নিষ্ঠুর হত্যাকা- যা এই বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছিল। যে হত্যাকা-ে ছোট্ট শিশুও রেহাই পায়নি। যে নির্মমতার ইতিহাস, ইতিহাসের পাতা থেকে মুছবে না কোনোদিন।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক