
বিএনপির ভাবনা শুধুই নির্বাচন
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ এখনো ঠিক না হলেও ভোটের প্রস্তুতি জোরদার করবে বিএনপি। চলমান ঈদের ছুটিতে নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় থাকবেন নেতারা। এলাকাবাসীর সঙ্গে গণসংযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টা করবেন দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থীরা। সেই সঙ্গে দ্রুত নির্বাচনের বিষয়ে জনমত বৃদ্ধি করে সরকারকে চাপে রাখবে।
সূত্র জানায়, দীর্ঘ ১৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দল বিএনপি এখন নির্বাচন ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে তেমন ভাবছে না। তাই নির্বাচনমুখী রাজনীতি নিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকার কৌশল নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ঈদের লম্বা ছুটিতে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি এবার কেন্দ্রীয় নেতারাও নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় অবস্থান করবেন। দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় নেতাকর্মীরা জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে সরব থাকবেন।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট হলে বিএনপিই নির্বাচিত হবে এমন আত্মবিশ্বাস নিয়েই দলটির নেতাকর্মীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। সেই সঙ্গে ভেতরে ভেতরে দলের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করার কাজও চলছে। আর দলের প্রার্থী হতে পারলেই সহজে বিজয় লাভ করা যাবে এমন আশাবাদ থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীরাও পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বিরামহীন দৌড়ঝাঁপ করছেন। এবার ঈদের ছুটিতে নিজ নিজ এলাকায় তারা আরও বেশি বেশি সক্রিয় থাকবেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান জনকণ্ঠকে জানান, আসন্ন ঈদে দলের নেতারা নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় অবস্থান করবেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নেবেন। এ বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা না হলেও আমরা প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছি। প্রতিবারের মতো আমি এবারও ঈদের ছুটিতে নরসিংদীতে আমার নিজ সংসদীয় এলাকায় অবস্থান করব।
ডিসেম্বরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে বিএনপি বারবার দাবি জানালেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিউত্তরে এ বছর ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন করার কথা জানান। তবে বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, এমন অস্পষ্ট বক্তব্যে তারা আশাবাদী হতে পারছেন না। তবে জুলাই সনদের কাজ শেষ হওয়ার পর নির্বাচনের রোডম্যাপ পাওয়া যেতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
অন্তর্বর্তী সরকার এখনো রোডম্যাপ ঘোষণা না করলেও বিএনপি চায় ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন। এ জন্য শুধু নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করে নির্বাচনের পর অন্যান্য সংস্কারের দাবি জানায় দলটি। তারা অবিলম্বে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায়। তা না হলে রাজপথে আন্দোলনের প্রচ্ছন্ন হুমকীও দিয়ে রেখেছে সরকারকে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা ডিসেম্বরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন চাই। তাই আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছি। আসন্ন ঈদে আমরা নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় অবস্থান করে নির্বাচনের প্রস্তুতি আরও জোরদার করব। আগের মতো এবারও আমি ঈদে চট্টগ্রামে অবস্থান করে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণসংযোগ করব।
এদিকে এখনো নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করায় বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে তারা এখন সরকারের সমালোচনায় সোচ্চার। তাদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তাই বিএনপির পক্ষ থেকে অতি দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি করা হয়। দ্রুত নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংস্কার কাজ শেষ করে সরকারের সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা উচিত বলে তারা ধারাবাহিকভাবে বলে আসছেন।
অবশ্য নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক না হলেও সারাদেশের বিএনপি নেতাকর্মীরা ঘরে বসে নেই। প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের পাশাপাশি দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ভোটের মাঠ অনুকূলে রাখতে সক্রিয়। কেন্দ্র থেকে দলের সিনিয়র নেতারা প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলা সফরে গিয়ে সভা-সমাবেশ করে দলের অবস্থান আরও মজবুত করার চেষ্টা করছেন। এ পরিস্থিতি তৃণমূল পর্যায়ে দলের নেতাকর্মীরা এখন অধিক সক্রিয় হয়েছেন।
প্রায় ১৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দল বিএনপির নেতাকর্মীরা ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই নির্বাচনের দাবিতে সোচ্ছার। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার নিয়ে তোড়জোড় শুরু করলেও ভোটের আগে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া আর কোনো সংস্কার চায় না বিএনপি। তারা চায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে রাষ্ট্র মেরামতের জন্য অন্য সংস্কারগুলো করতে। নির্বাচনের পর বিএনপির দেওয়া ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের আলোকে প্রয়োজনে আরও কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে রাষ্ট্র সংস্কার করতে চায় তারা। তাই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। তারা ডিসেম্বরে নির্বাচনের বিষয়ে এখনো অটল রয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দাবি করছেন। এ ছাড়া বিএনপির পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েক দফা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি জানানো হয়। এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারও এখন চাপের মুখে। তাই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করলেও জুলাই সনদ করতে সরকার এখন ব্যস্ত সময় কাটোচ্ছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।
সূত্র জানায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ৩০০ সংসদীয় আসনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে বিএনপি। তবে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হলে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি চূড়ান্ত করবে। তাই আসন্ন ঈদের ছুটিতে সব সংসদীয় এলাকায়ই দলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনী প্রস্তুতি জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপি হাইকমান্ড।
বিএনপি হাইকমান্ড থেকে আগেই জানিয়ে রাখা হয়েছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হলে তারা জাতীয় সরকার গঠন করবে। এ জন্য সংসদ নির্বাচনে সমমনা দলগুলোকে কিছু আসন ছাড়ার আগাম ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবকে লক্ষ্মীপুর-৪ আসন, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বগুড়া-২ আসন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিকে ঢাকা-১২, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূরকে পটুয়াখালী-৩, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানকে ঝিনাইদহ-২, জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদাকে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন, গণফোরাম সভাপতি মোস্তফা মোহসিন মন্টুকে কেরানীগঞ্জ অথবা পুরানো ঢাকার ১টি আসন, এলডিপির (একাংশ) সভাপতি শাহাদাত হোসেন সেলিমকে লক্ষ্মীপুর-১ আসন। এ ছাড়াও কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন এলডিপির আরেক অংশ বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করলে চট্টগ্রামের একটি ও কুমিল্লার ১টিসহ এ দলটিকে ক’টি আসন ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ছাড়াও বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থকে ভোলা অথবা ঢাকার একটি আসন ছাড়া হতে পারে। তবে আসন ছাড়ার বিষয়ে এখন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না হওয়ায় ৩০০ সংসদীয় আসনেই বিএনপি নেতাকর্মীদের নির্বাচনী প্রস্তুতি চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে দলের পক্ষ থেকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা জনকণ্ঠকে জানান, দলের হাইকমান্ড থেকে আসন্ন ঈদে সবাইকে নিজ নিজ এলাকায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করতে বলা হয়েছে। এই নির্দেশনা পেয়ে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এবার ঈদের ছুটিতে নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করে নির্বাচনের মাঠ দলের জন্য অনুকূলে রাখার চেষ্টা করবেন। সেই সঙ্গে দ্রুত নির্বাচনের জন্য জনমত বৃদ্ধি করবেন। এর মাধ্যমে সরকারকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য চাপ অব্যাহত রাখা হবে।