
.
কুমিল্লা-২ (হোমনা-মেঘনা) আসনটি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ২৫০নং আসন। জেলার সর্বোত্তরে মেঘনা নদীর কোল ঘেষে ঢাকার নিকটবর্তী দুইটি উপজেলায় বিন্যস্ত এ আসনটি একটি পৌরসভা ও ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। গত জুন মাসে আসন পুনর্বিন্যাস (হোমনা-তিতাস থেকে হোমনা-মেঘনা) করা হয়েছে।
বর্তমানে এই আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য হলেন হোমনার বাসিন্দা নিটল-নিলয় গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ উইমেন্স চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সেলিমা আহমাদ মেরী। এর আগে এই আসনটি বরাবরই ছিল বিএনপির দখলে। কিন্তু বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও এ আসনের টানা পাঁচবারের এমপি এম কে আনোয়ার ২০১৭ সালের অক্টোবরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে আসনটিতে বিএনপির প্রার্থী সংকট দেখা দেয়। এ অবস্থায় ২০১৮ সালের নির্বাচনে এখান থেকে বিএনপির প্রার্থী হন দাউদকান্দির ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় ২০১৮ সালের সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেলিমা আহমাদ মেরী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে হারিয়ে এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ দলীয় বর্তমান সংসদ সদস্য সেলিমা আহমাদ মেরী এই আসন থেকে এবারও দলের মনোনয়ন চাইবেন। সে লক্ষ্যে তিনি আসনের দুটি উপজেলায় বিগত সময়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- তুলে ধরে সভা-সমাবেশ করছেন। এখানে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বিধা-বিভক্তি থাকলেও নির্বাচন সামনে রেখে সকল ভেদাভেদ ভুলে জয়ের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখতে দলকে চাঙ্গা করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
এর আগে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় সেখানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির (এরশাদ) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আমির হোসেন ভূঁইয়া এমপি হন। তবে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রয়াত এম কে আনোয়ারের এ আসনে বিএনপি যোগ্য প্রার্থী সংকটে ভুগলেও এবার আওয়ামী লীগে রয়েছে একাধিক প্রার্থী। বিগত সময়ে (হোমনা-তিতাস) এই আসনের তিতাস উপজেলায় (বর্তমানে কুমিল্লা-১ আসনের সঙ্গে সংযুক্ত উপজেলা) বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে।
সংসদ সদস্য সেলিমা আহমাদ মেরী বলেন, দলে কোনো গ্রুপিং নেই। আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মজিদকে সঙ্গে নিয়ে সবাই একসঙ্গে দলের কর্মকা- পরিচালনাসহ এলাকার উন্নয়নে কাজ করছি।
অনুসন্ধানকালে সূত্রগুলো জানায়, এই আসনে রয়েছে আওয়ামী লীগের দ্বিধা-বিভক্তি। আসনের হোমনা উপজেলায় কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও স্থানীয় এমপি সেলিমা আহমাদ মেরী এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ আবদুল মজিদের মধ্যে রাজনীতিক বিরোধের বিষয়টিও বেশ আলোচিত। প্রতিপক্ষের হামলায় একসময় আহতও হয়েছিলেন অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ। এখানে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধেও আইসিটি অ্যাক্টে মামলা হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
এছাড়াও তিতাস উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী, উপজেলা চেয়ারম্যান পারভেজ হোসেন সরকারের নেতৃত্বে রয়েছে এমপির প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের পৃথক আরও একটি গ্রুপ। বর্তমানে আসন পুনর্বিন্যাসের কারণে তিতাস উপজেলাটি কুমিল্লা-১ আসনের সঙ্গে যুক্ত হলেও তিতাস উপজেলার গ্রুপিং রাজনীতির প্রভাব থেকে নতুন করে বিন্যস্ত কুমিল্লা-২ আসনটি কোনোভাবেই মুক্ত নয়।
প্রসঙ্গক্রমে তিতাস উপজেলা পরিষদের দ্বিতীয় মেয়াদে চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এমপি সেলিমা আহম্মাদ মেরীর এক সময়ে ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত পারভেজ হোসেন সরকার বলেন, বিগত সময় এ আসনের দুটি উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় আসনটি আওয়ামী লীগের ঘরে আসলেও এবার সে অবস্থা নেই। এখানে প্রার্থী পরিবর্তন না হলে দলের নিশ্চিত ভরাডুবির আশঙ্কা রয়েছে।
এখানে আওয়ামী লীগ থেকে হোমনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ দলের ত্যাগী ও নিবেদিত নেতা বলে এলাকায় তার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। অধ্যক্ষ মজিদের অনুসারীরা জানান, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মুরাদনগর আসনের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম সরকার এ আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন। পরে এখানে দলের হাল ধরেন আবদুল মজিদ এবং তিনি নবম সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বিএনপির এম কে আনোয়ারের কাছে পরাজিত হন।
দশম সংসদ নির্বাচনে প্রথমে অধ্যক্ষ মজিদকে দলের মনোনয়ন দেওয়া হলেও পরে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির (এরশাদ) আমির হোসেন ভূঁইয়াকে মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এখানে অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ আবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। সেই লক্ষ্যে তিনি আসনের দুটি উপজেলায় চষে বেড়াচ্ছেন। একইসঙ্গে দলের নেতাকর্মী ও ভোটারদের সংগঠিত করতে মাঠে-ময়দানে কাজ করছেন।
স্থানীয়রা জানায়, এখানে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মকান্ডে বর্তমানে বেশ সক্রিয় অধ্যক্ষ মজিদ। তিনি তার অনুসারী নেতা-কর্মীদের নিয়ে নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন জাতীয় দিবস ছাড়াও দলের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে শো-ডাউনসহ সভা-সমাবেশ, গণসংযোগ ও প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। তার মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে বেশ আশাবাদী তার সমর্থক নেতা-কর্মীরা।
এ বিষয়ে অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ বলেন, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ রাজনীতি ও অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য এ আসনে দল ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী ও ভোটারদের সংগঠিত করতে দীর্ঘদিন ধরে নিবেদিতভাবে কাজ করে আসছি। এতে আমাকে অনেক বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। আশা করি এবার দল আমাকে মূল্যায়ন করলে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আসনটি ধরে রাখতে সক্ষম হবো।
এদিকে নতুন করে বিন্যস্ত এ আসনের মেঘনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মেঘনা উপজেলা প্রতিষ্ঠার রুপকার হিসেবে পরিচিত মো. শফিকুল আলম এবারও দলীয় মনোনয়ন চাইবেন এবং সেই লক্ষ্যে তিনি এলাকায় দলের নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করছেন। তিনি বলেন, মেঘনা উপজেলাটি প্রতিষ্ঠার পেছনে স্থানীয়ভাবে যথেষ্ট ভূমিকা ছিল আমার। মেঘনা উপজেলায় আওয়ামী লীগে কোনো গ্রুপিং কিংবা কোন্দল নেই। আমার নেতৃত্বে দল ও দলের নেতাকর্মীরা এখানে সুসংগঠিত। দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেয় অবশ্যই এ আসনটি আবারও আওয়ামী লীগের ঘরে উঠবে।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, বিগত সময় ভোটের রাজনীতিতে মেঘনা উপজেলার সংঘবদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-ভোটারদের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পথ সুগম করেছে। এখনো এ উপজেলায় নেতা-কর্মীরা পূর্বের ন্যায় দলের সভাপতি মো. শফিকুল আলমের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ।
স্থানীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ জোটগতভাবে নির্বাচন করলে এ আসনের মেঘনা উপজেলার সাতানী গ্রামের বাসিন্দা হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ও ইসলামী ঐক্যজোটের যুগ্ম-মহাসচিব আলতাফ হোসেন মনোনয়ন চাইতে পারেন। এছাড়া ইসলামী আন্দোলনের জেলা সভাপতি কাজী রফিকুল ইসলাম ও ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিক আহমেদ খান প্রার্থী হতে পারেন।
এদিকে, কুমিল্লার এ আসনটি মূলত বিএনপির প্রয়াত নেতা এম কে আনোয়ারের নামেই ব্যাপক পরিচিতি ছিল। ২০১৭ সালে তার মৃত্যুর পর এই আসনে ব্যাপক নেতাকর্মী ও সমর্থক থাকলেও এ পর্যন্ত এখানে এম কে আনোয়ারের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মতো বিএনপির কোনো নেতা বা প্রার্থী গড়ে উঠেনি। ফলে প্রার্থী সংকটের কারণে ২০১৮ সালের নির্বাচনে কুমিল্লা-১ আসনের বাসিন্দা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ওই আসনের পাশাপাশি কুমিল্লা-২ আসনটিতেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।
আসন্ন সংসদ নির্বাচনেও বিএনপিতে এ আসনে প্রার্থী সংকট বিরাজমান থাকায় জাতীয়ভাবে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কিংবা তার ছেলে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মারুফ হোসেন এই আসনে প্রার্থী হতে পারেন বলে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে।
এ বিষয়ে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। তবে দল যদি নির্বাচনে অংশ নেয় আমি গতবারের মতো এবারও কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-তিতাস) আসন ছাড়াও কুমিল্লা-২ (হোমনা-মেঘনা) আসনের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক পিএস-২ আবদুল মতিনও মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, এ আসনের দুটি উপজেলার মধ্যে হোমনায় একটি পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়নে মোট ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৯২ হাজার ১৩৩ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ১ হাজার ৩ জন ও নারী ভোটার ৯১ হাজার ১৩০ জন। এছাড়া আসনের মেঘনা উপজেলায় ৮টি ইউনিয়নে মোট ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৪৬ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬০ হাজার ১৯৭ জন ও নারী ভোটার ৫৪ হাজার ৪৪৯ জন।