
সম্পাদকীয়
সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অধঃপতন যে কত গভীরে বিস্তৃত হয়েছে, এর একটি ন্যক্কারজনক ও নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর কদমতলীর রায়েরবাগে। শনিবার দুপুরে অকুস্থলে মাদকাসক্ত বখাটেদের কিল-ঘুষিতে জীবন দিতে হয়েছে আব্দুর রহিম খান নামের ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধকে। নিহত বৃদ্ধের ছেলে রাকিবুল ইসলামের অভিযোগ, রায়েরবাগ মেরাজনগর সি ব্লকে তাদের নিজস্ব বাড়ি। বাড়ির সামনে ফাঁকা মাঠে প্রতিদিন কয়েক যুবক নিয়মিত আড্ডা দেয়। অভিযুক্ত যুবকরা মাদকাসক্ত। মাঠে বসেই নিয়মিত মাদকসেবনসহ হৈ-হল্লা করে, ক্রিকেট খেলে। ঘটনার দিন উচ্ছৃঙ্খল যুবকরা ক্রিকেট খেলছিল এবং অকারণে চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল।
এক পর্যায়ে বখাটেদের খেলার বল বাড়ির জানালায় আঘাত করে। তখন বৃদ্ধের পুত্র চেঁচামেচি করতে বারণসহ অন্য কোথাও গিয়ে খেলার অনুরোধ জানায়। ফলে, বখাটেরা ক্ষিপ্ত হয়ে রাকিবুল ইসলামকে বেধড়ক মারধর শুরু করে। এ সময় তার বাবা বাসা থেকে বেরিয়ে বাধা দিলে বেপরোয়া বখাটেরা চড়াও হয় বৃদ্ধের ওপর। তিনজন যুবক বৃদ্ধের বুকে ক্রমাগত কিল-ঘুষি মারতে থাকলে এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বখাটেদের নাম-পরিচয় উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট থানায় জানিয়েছে বৃদ্ধের পুত্র। পুলিশ কি করে সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে প্রশ্ন হলো, সমাজ কি এতই উচ্ছন্নে গেছে যে, অন্যায়-অপরাধ করলেও সংশ্লিষ্ট কাউকে কিছুই বলা যাবে না। তদুপরি অসদাচরণের প্রতিবাদ করলে অসহায় নিরপরাধ বৃদ্ধের মতো জীবন দিতে হবে!
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি, স্মার্টফোন, ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক এ সবের প্রধান কারণ হতে পারে। মুহূর্তের মধ্যে হাতের মুঠোয় সারা দুনিয়া চলে আসায় এর প্রতি তীব্র ঝোঁক ও আসক্তি বেড়েছে তরুণদের। ক্রমাগত তারা ঝুঁকে পড়ছে মাদকাসক্তিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে, ভায়োলেন্স বা সহিংতায়। জড়িয়ে পড়ছে খুন-খারাবি, দলাদলি, অপকর্ম, অপরাধ সর্বোপরি ধর্ষণ কার্যক্রমে। করোনা অতিমারিতে গৃহবন্দি থাকায় তা বেড়েছে বহুগুণ। এসবের নেতিবাচক অপব্যবহারেই সামাজিক অবক্ষয়, অসঙ্গতি ও অধঃপতনের অন্যতম কারণ। ইদানীং রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বেপরোয়া কর্যক্রম ও অপরাধ অনেক বেড়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও ভাবিয়ে তুলছে বিষয়টি। অভিভাবকরাও স্বভাবতই উদ্বিগ্ন, আতঙ্কিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কি জানি, যদি নিজের সন্তানটিও কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে পড়ে অপরাধী দলের সঙ্গে! এটি একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশের জন্য আদৌ শুভ লক্ষণ নয়।
এসব নাকি নগরায়ণের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে গড়ে উঠেছে গ্রামেও। এরা রাজপথ দাপিয়ে বেড়ায় হোন্ডায়, সমবয়সী মেয়েদের সকাল-বিকেল উত্ত্যক্ত করে, ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দেয়, মোবাইলে অশ্লীল ছবি ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করে, খেলার মাঠে হামলা চালায় প্রতিপক্ষের ওপর, সর্বোপরি ছিনতাই-চাঁদাবাজি-মাদক তো আছেই। এসব অপরাধমূলক কর্মকা-ের জন্য শুধু মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ফেসবুক, ইন্টারনেট ইত্যাদিকে দোষ দেওয়া যাবে না। শুধু থানা-পুলিশ দিয়েও হবে না। এক্ষেত্রে সবিশেষ গুরুদায়িত্ব রয়েছে সমাজ, পরিবার ও অভিভাবকদের, বিশেষ করে মা-বাবা, ভাইবোনের। যথাযথ ভালোবাসা ও শিক্ষা দিয়ে সন্তানদের বোঝালে বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারে তরুণ প্রজন্ম।