ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

টরন্টোর চিঠি

যৌক্তিক সমালোচনা আবশ্যক

শামীম আহমেদ

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ১৩ জুন ২০২৩

যৌক্তিক সমালোচনা আবশ্যক

অনেক ঘটনা বেশ অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে গেল

অনেক ঘটনা বেশ অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে গেল। সেক্রেটারি ব্লিনকেনের ভিসা সংক্রান্ত বিবৃতির পর প্রধানমন্ত্রী প্রায় সপ্তাহখানেক পর তাঁর বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি যা বলেছেন তার সারমর্ম হলো পৃথিবীতে আরও অনেক দেশ, মহাদেশ আছে যাওয়ার মতো, আমেরিকায় যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। তবে এই বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী না দিয়ে সরকারের অন্য কেউ দিলে ভালো হতো কিনা সেই আলোচনা করা যায়। যেহেতু এই বক্তব্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট দেননি, সেই ক্ষেত্রে উত্তর দেওয়ার দায়ও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নয়। প্রধানমন্ত্রী উত্তর দেওয়াতে আমেরিকার ভিসানীতি আদতে বেশ গুরুত্ব পেয়ে গেল।

সেক্রেটারি ব্লিনকেনের বক্তব্যের পর গত কিছুদিন ধরে দেশের মানুষ নানা জিনিস নিয়ে পেরেশান আছে। এর মধ্যে যে জিনিস দুটো তাদের সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে সেগুলো হচ্ছে ১) বিদ্যুৎ বিভ্রাট ২) টিন নাম্বার থাকলেই ২০০০ টাকা কর দেওয়ার আলোচিত বিধান। বিদ্যুতের ভোগান্তি গত বছর শুরু হলেও তখন ইউক্রেন যুদ্ধের বিবেচনায় বিষয়টি মানুষ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছে। কিন্তু যুদ্ধের পর গত এক বছরে বিষয়টির সুরাহা করার জন্য অনেক দীর্ঘ সময় পেলেও কেন তা সরকার করল না তা মানুষকে বিক্ষুব্ধ করছে। দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি, ট্রাফিক জ্যাম, দুর্নীতি, অন্যায় অবিচার ইত্যাদিতে ভারাক্রান্ত মানুষ এই ভয়াবহ দাবদাহে বিদ্যুৎ বিভ্রাট সংক্রান্ত অজুহাত শুনতে অপারগ।

অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে সাদা চোখে বলতে পারি বৈদেশিক মুদ্রার যে চাহিদার তুলনায় জোগান কম, সেটির একটা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে জ্বালানি কেনায় অক্ষমতা ও বিদ্যুৎ বিভ্রাট। কয়েকদিন আগে ফোনে কথা হচ্ছিল আম্মা-আব্বার সঙ্গে, দেশে। তাদের বলছিলাম যে, কয়েক যুগ আগে দেশে রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয়ের মাধ্যমে ডলারের যে জোগান ছিল, তার সঙ্গে উন্নয়ন ব্যয়ের একটা সামঞ্জস্য ছিল। অর্থাৎ উন্নয়ন কার্যক্রম যেহেতু সীমিত ছিল তাই আয়কৃত ডলার দিয়ে মোটামুটি অর্থনীতি চালানো যেত। কিন্তু ২০০৮ এর পর থেকে দেশে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাপক বেড়েছে। ফলে, উন্নয়ন ব্যয়ও বেড়েছে বহুগুন। যদিও রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সের মাধ্যমে ডলার দেশে ঢুকছে অনেক বেশি, কিন্তু সেটা উন্নয়ন কাজের ব্যাপক পরিধির তুলনায় অপ্রতুল। ফলে, ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট ও বিদ্যুৎ বিভ্রাট। সরকার যদি এত উন্নয়ন প্রকল্প হাতে না নিত, তাহলে ডলার সংকট তৈরি হতো না এবং সরকারও মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাটে থাকত। 
কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটেনি। তারা ঝুঁকি নিয়ে হলেও উন্নয়ন করতে চেয়েছে। ফলে,ডলার সংকটেও পড়েছে। তবে এ কথা বলতে পারি সরকার চাইলে আরও অনেকদিন খুবই নির্মোহভাবে বিদ্যুতে রেশনিং না করেই চালাতে পারত। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে আমাদের শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানের মতো বিপর্যয়ে পড়তে হতো। সেটা অনুধাবন করে এখন থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এতে করে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু সরকারের অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা কমেছে। আমার ধারণা, বিষয়গুলো মানুষ আরও সহজভাবে নিত যদি দেশে দুর্নীতি এত বেশি, এত প্রকট না হতো।

সরকারের নানা পর্যায়ে দুর্নীতিবাজ কর্মচারী, কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্য, ব্যাংকিং খাতে নৈরাজ্য, দেশে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশ পাড়ি দেওয়া, এসব ঘটনায় মানুষ সরকারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। খুব সহজ একটা উদাহরণ দিই। দেশের ফুটবলের অবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু বাফুফের সভাপতি হিসেবে এককালের নামকরা ফুটবলার সালাহউদ্দিন যুগের পর যুগ যেন তার পদ আঁকড়ে আছেন। শত ব্যর্থতার পরেও তাকে পদ ছাড়তে হচ্ছে না। সরকারের আমলা-মন্ত্রীরা সংকট মোকাবিলায় কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না, তবুও পদ আঁকড়ে রাখছেন কোনো চ্যালেঞ্জ ছাড়াই। মন্ত্রিপরিষদে বহুকাল কোনো পরিবর্তন নেই।

দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে, বাজেট ঘাটতি দেখা দিলেই নতুন নতুন করের ক্ষেত্রে উন্মোচন মানুষকে এই ইঙ্গিত দেয় যে, দুর্নীতি, অন্যায়ের ফলশ্রুতিতে যে কোনো দায়ের ভার বহন করতে হবে সাধারণ মানুষকে। আওয়ামী লীগ যে কোনো পরিস্থিতিতে বিএনপি-জামায়াতের চেয়ে ভালো সেটি আমরা জানি, কিন্তু দেশের অর্ধেক ভোটার যাদের বয়স ১৮, যারা জন্মের পর থেকে বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখেনি, তাদের কাছে এসব ব্যাখ্যা ধোপে টিকবে না। 
আমরা যখন বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানের জন্য একের পর এক রেন্টাল প্রজেক্টে গিয়েছি, তখন এই বিষয়গুলো এসেছিল। তখন যারা আপত্তি করেছিলেন, তাদের আমরা সমালোচনা করলেও আজ তাদের আপত্তির কারণ স্পষ্ট হচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার ‘Quick Enhancement of Electricity and Energy Supply (Special Provision) Act’ নামে একটি আইন করে, যার মাধ্যমে কোনো টেন্ডার ছাড়াই সরকার যে কোনো সময় যে কোনো বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। এই নতুন আইনটি ‘কুইক রেন্টাল’ নামে বহুল প্রচলিত। সাময়িকভাবে এর সুফল জনগণ ভোগ করেছে, দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল, লোডশেডিং কি সেটিই মানুষ এক সময় ভুলতে শুরু করে। কিন্তু তার ব্যাপক মূল্যও দেশকে পরিশোধ করতে হয়েছে।

এটি বলা হয়ে থাকে যে বাংলাদেশকে বাজারমূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ভারতের কাছে। এছাড়াও চুক্তির আওতায় বহু কুইক রেন্টাল ইউনিট প্রয়োজন ছাড়াই বসে থেকেছে, কিন্তু ভাড়া গুনতে হয়েছে বাংলাদেশকে। ঠিক একইভাবে সম্প্রতি ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি আত্মঘাতী বলে মনে হচ্ছে। নাম উল্লেখ করতে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে শুনেছি তারা এই প্রকল্পের বিষয়ে আপত্তি জানালে তাদের চুপ করে দেওয়া হয়।

সংবাদমাধ্যম মারফত জানা গিয়েছে যেখানে কয়লার আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য ছিল প্রতিটন আড়াই’শ মার্কিন ডলার, সেখানে বাংলাদেশ তাদের কাছে টনপ্রতি কয়লা ৪০০ মার্কিন ডলারে কেনার চুক্তি করেছে এবং এই চুক্তিতে কয়লার সর্বোচ্চ মূল্যের বিষয়ে কিছু বলা নেই। ফলে, আদানি গ্রুপ ভবিষ্যতে ইচ্ছেমতো কয়লার দাম নির্ধারণ করতে পারবে। এখানে বলে রাখা ভালো, বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা সাধারণত দীর্ঘমেয়াদের কয়লা কেনে এবং ফলশ্রুতিতে কম মূল্যে কয়লা পেয়ে থাকে। যেমন- আমাদের পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমরা প্রতিটন কয়লা ২২০ মার্কিন ডলারে কিনে থাকি। 
উল্লেখ্য, আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তির বিষয়টি এত কম আলোচিত হয়েছে যে, এ সম্পর্কে জানতে পারি ভারতীয় সংসদে কংগ্রেস প্রধান রাহুল গান্ধীর বক্তব্য থেকে। তিনি সংসদে আদানি গ্রুপের প্রধান আদানির সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির বন্ধুত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, যে কোনো জাদুবলে মোদি অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার পর পর সেখানকার মাইনিং প্রজেক্টে কাজ করার জন্য ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক আদানিকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেয়! রাহুল গান্ধী এটিও প্রশ্ন করেন কোন্ জাদুবলে মোদি বাংলাদেশ সফরে আসার পরপরই বাংলাদেশের পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ২৫ বছরের চুক্তি করে? রাহুল গান্ধীই কেবল নন, বাংলাদেশের সংসদে এই বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবর রহমান চুন্নু।

তিনি এই চুক্তি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানান এই তথ্য দিয়ে যে যেখানে আমাদের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিকিলোওয়াট/ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ১৩.৩৭ সেন্ট, এস আলমের খরচ ১৮.৩৯ সেন্ট, সেখানে আদানি গ্রুপের প্রাক্কলিত খরচ ধরা হয়েছে ২৪.১০ সেন্ট, কেন? সরকারের মুখপাত্ররা বলছে আমাদের এখানে কোনো উৎপাদন খরচ নেই, তাই আমরা বেশি দিচ্ছি। কিন্তু বেশি দিতে হলে আমরা নিজেরাই উৎপাদন করতাম, আমাদের নিজেদের establishment হতো। অন্যের establishment হবে, সেটার জন্য আমরা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় কেন করব? অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে নির্দ্বিধায় বলতে পারি বাংলাদেশে এত বড় আত্মঘাতী চুক্তি এর আগে কখনো হয়নি এবং এই চুক্তি অতি দ্রুত বাতিল না করলে কুইক রেন্টালের কারণে আজ যে আমরা ভুগছি, বহু বছর পর আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ কেনার জন্যও ভুগব। যারা ভাবছেন আপাতত আপদ বিদায় করি, ২০ বছর পরে তো আমি থাকব না, তারা দেশকে ভালোবাসেন না এবং আমরা তাদের সঙ্গে একমত হতে পারি না।   
দেশের ভালো যারা চাইবেন, যারা প্রকৃতভাবেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির পক্ষে আছেন, তাদের দায়িত্ব সরকারকে তাদের ভুল বিষয়ে সতর্ক করা। নতুবা ইতিহাসে সব লিপিবদ্ধ থাকে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের প্রতি আবেদন থাকবে, তারা যাতে সময় থাকতে যথাযথ পরামর্শক ও উপদেষ্টাদের বুদ্ধি-পরামর্শ আমলে নেন। স্তুতিকারকরা স্বাধীন বাংলাদেশের সকল সরকারের বিপর্যয়ের কারণ হয়েছে কোনো না কোনো সময়। 
৬ জুন ২০২৩
টরন্টো, কানাডা

×