ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংবাদপত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী

প্রকাশিত: ২১:০৪, ২১ মার্চ ২০২৩; আপডেট: ২৩:৫৭, ২১ মার্চ ২০২৩

সংবাদপত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

সাম্প্রদায়িকতা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে নিরপেক্ষ কোনো অবস্থানও গ্রহণ করেননি। তাঁর জীবন-দর্শন এবং কর্মকাণ্ডের মূলে ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের অপতৎপরতা, অবস্থান ও কর্মকাণ্ড তুলে আনেন ‘সেই রাজাকার’ কলামে। সেই কলাম বন্ধ করার জন্য জামায়াত-শিবির চক্র জনকণ্ঠের বিরুদ্ধে সারাদেশে মামলা করায়। কোনো কোনো এলাকায় রিপোর্টারদের হত্যার চেষ্টা করা হয়। পত্রিকা অফিসে শক্তিশালী বোমা রেখে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন অনমনীয় এবং অটল। আজ এ কথা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলা যায়- মানবতাবিরোধী মামলায় নিজামী-মুজাহিদ গংয়ের ফাঁসি কার্যকরের অন্যতম অনুঘটক ছিলেন আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

 

সময়টা ছিল গত শতকের নব্বই দশকের প্রথম ভাগ। ‘তুই রাজাকার, একাত্তরের ঘাতকেরা কে কোথায়?’- শীর্ষক একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় একটি পত্রিকায়। আর এর প্রতিক্রিয়ায় সমস্ত বাঙালি একাট্টা হয়ে গর্জে উঠেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের সেই অগ্নিগর্ভের সময়ের প্রেরণা, উন্মাদনায় উত্তাল ও একীভূত হয়েছিল। পত্রিকাটির নাম দৈনিক জনকণ্ঠ। 
বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকউল্লাহ খান মাসুদের সম্পাদনায় ১৯৯৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’। বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে আলোড়ন তুলে আতিকউল্লাহ খান মাসুদও ছিলেন তুমুল আলোচনায়। বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম আতিকউল্লাহ খান মাসুদ (১৯৫১- ২০২১)। ১৯৭৫ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বেপথু ধারা থেকে জাতিকে সঠিক পথের দিশার ব্রত নিয়ে প্রকাশিত আতিকউল্লাহ খান মাসুদের হাতে দেশের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’।

তিন দশকের দাপুটে সাংবাদিকতায় পত্রিকাটি এখন অন্যতম শীর্ষ দৈনিক। দৈনিক জনকণ্ঠের প্রকাশ কেন তাৎপর্যপূর্ণ ও বিপ্লবী তা মূল্যায়ন করতে গেলে সে সময় এবং এর পূর্বাপর অনুধাবন করা প্রয়োজন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর জিয়া-এরশাদের অপশাসনের মূল এজেন্ডা ছিল দেশকে নব্য পাকিস্তানকরণ। সদ্য স্বাধীন বিধ্বস্ত এই দেশটির প্রতি তাদের কোনো দরদ বা ভালোবাসা ছিল না কিঞ্চিৎ পরিমাণও। হত্যা, রক্তপাত, দমন, নিপীড়নের মাধ্যমে যে কোনো মূল্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করাই ছিল ইতিহাসের এই খলনায়কদ্বয়ের মূল এজেন্ডা।

তাই আমরা দেখলাম রাতারাতি নিয়ে আসা হলো উদ্ভট ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। বাংলাদেশ বেতার হয়ে গেল ‘রেডিও বাংলাদেশ’। রাজাকার কুলশিরোমণি গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দেওয়া হলো। পরবর্তীতে বদর বাহিনীর শীর্ষ নেতাদের দেখলাম মন্ত্রিত্বে। তাদের গাড়িতে উড়তে লাগল ৩০ লাখ শহীদের রক্তের দামে অর্জিত লাল-সবুজের পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত অর্জন ধুলোয় ভূলুণ্ঠিত। পুরো জাতির মধ্যে হতাশা। আর এই অমানিশার কালো দু-ধারী ক্ষুরধার তরবারির মতো মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে একাট্টা দৈনিক জনকণ্ঠের আবির্ভাব।

‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ হলো ক্ষণজন্মা পুরুষ আতিকউল্লাহ খান মাসুদের ‘ব্রেইন-চাইল্ড’। আগমনকালেই দৈনিক জনকণ্ঠ সংবাদপত্রের প্রচলিত ধারা পাল্টে দিল সর্বাত্মকভাবে। সে দশকে ঝকঝকে ছাপা, উন্নতমানের কাগজে বর্ণিল এই দৈনিক বাংলাদেশের জনগণের মন জয় করে নেয়। পত্রিকাটি একযোগে প্রকাশ হতে থাকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, সিলেট ও খুলনা শহরে যুগপৎ প্রিন্ট হয়ে, যেটি ছিল সেই সময় অভিনব ও অকল্পনীয়। আর এই মহাযজ্ঞের নেপথ্য নায়ক হলেন আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। 
কে এই আতিকউল্লাহ খান মাসুদ? তিনি বাংলাদেশে ডিজিটাল সংবাদপত্রের জনক, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫১ সালের ২৯ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার মেদিনীম-ল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ২ নং সেক্টরের অধীন মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানা কমান্ডারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। অংশ নেন ঝুঁকিপূর্ণ বড় বড় অপারেশনে। নীতির প্রশ্নে আপোসহীন, সত্য প্রকাশে দ্বিধাহীন এই মুক্তিযোদ্ধা, সম্পাদক ছিলেন তৎকালীন শিল্পপতিদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব।

তিনি গড়ে তোলেন বিভিন্ন শিল্প-কারখানা। তাঁর জীবনের সবচেয়ে সফল কর্মোদ্যোগ দেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ প্রকাশ। দেশে তখন বাংলা ভাষাভিত্তিক, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অন্তরে ধারণ করে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য তেমন কোনো পত্রিকা ছিল না। আতিকউল্লাহ খান মাসুদের দৈনিক জনকণ্ঠই প্রথম বাংলাদেশের আত্মপরিচয়কে তুলে ধরতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। 
ডিজিটাল পদ্ধতিতে দৈনিক জনকণ্ঠ প্রকাশ করতে গিয়ে জনাব মাসুদ প্রথাগত পত্রিকার খোলনলচেই বদলে ফেলেন। সাংবাদিকতায় আনেন নতুন মাত্রা। আতিকউল্লাহ খান মাসুদ মৌলবাদ, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িকতা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো কর্মকা-ে নিরপেক্ষ কোনো অবস্থানও গ্রহণ করেননি। তাঁর জীবন-দর্শন এবং কর্মকাণ্ডের মূলে ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের অপতৎপরতা, অবস্থান ও কর্মকা- তুলে আনেন ‘সেই রাজাকার’ কলামে।

সেই কলাম বন্ধ করার জন্য জামায়াত-শিবির চক্র জনকণ্ঠের বিরুদ্ধে সারাদেশে মামলা করায়। কোনো কোনো এলাকায় রিপোর্টারদের হত্যার চেষ্টা করা হয়। পত্রিকা অফিসে শক্তিশালী বোমা রেখে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন অনমনীয় এবং অটল। আজ এ কথা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলা যায়Ñ মানবতাবিরোধী মামলায় নিজামী-মুজাহিদ গংয়ের ফাঁসি কার্যকরের অন্যতম অনুঘটক ছিলেন আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনা করলেই সেটি জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রতীকী ফাঁসি কার্যকর এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে ফাঁসি কার্যকর ইত্যাদি স্মরণীয় অপরিমিত সাহসী কর্মকা-ের মুখপত্র ছিল আতিকউল্লাহ খান মাসুদের জনকণ্ঠ। এছাড়াও ‘ওয়ান ইলেভেনের’ শুরুতেই ২০০৭ সালে মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ২২ মাস ১২ দিন কারান্তরীণ ছিলেন।

এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়, কারান্তরীণ সময়ে আতিকউল্লাহ খান মাসুদের সঙ্গে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সম্পর্ক ও নৈকট্য স্থাপিত হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে আতিকউল্লাহ খানকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। 
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ক্ষণজন্মা পুরুষ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। প্রতিদিন কত পত্রিকাই তো প্রকাশিত হয়, আবার হারিয়েও যায়। কিন্তু জনকণ্ঠ এখনো স্বমহিমায়, সগৌরবে টিকে আছে। এই জনপদের প্রগতিশীল সংবাদপত্রের ঐতিহ্যিক ধারার অত্যতম প্রতিনিধি ও প্রতীক ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’।

ঔপনিবেশিক শাসনামলে দৈনিক আজাদ যেমন বাঙালি মুসলমানদের আত্মজাগরণের দ্বীপশিখা প্রজ্বালন ও ভাষা আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার দৈনিক ইত্তেফাক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তথা স্বাধীনতার বীজতলা তৈরিতে কার্যকর অবদান রেখেছে, তেমনি দৈনিক জনকণ্ঠ মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ও চেতনাকে সমুন্নত রাখতে সময়োচিত-সাহসী সংগ্রামে ছিল অকুতোভয় ও পরোয়াহীন। আর এক্ষেত্রে সর্বাত্মকভাবে নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছেন সময়ের সাহসী সন্তান আতিকউল্লাহ খান মাসুদ।

প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিরা তাঁদের জীবন ও কর্মের জন্য মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে ওঠেন। মৃত্যু তাঁদের মুছে দিতে পারে না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মৃত্যুঞ্জয় কবিতায় লিখেছেন- ‘তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড় নও। আমি মৃত্যুর চেয়ে বড় এই শেষ কথা বলে যাব আমি চলে।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমর সাহিত্য সৃষ্টিতে মৃত্যুকে জয় করে নিয়ে এখনো বিশ্বসভায় সমাদৃত। আর বাংলাদেশের সংবাদপত্র প্রকাশে নবধারা সৃষ্টি এবং ইতিবাচক সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনকণ্ঠের অগণিত পাঠকের মধ্যে আতিকউল্লাহ খান মাসুদ সাংবাদিক-প্রকাশক হয়ে অমর হয়ে থাকবেন।

লেখক : অধ্যাপক, সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

×