ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুষ্টের দমন-শিষ্টের লালনে অগ্রাধিকার

এ কে এম এ হামিদ

প্রকাশিত: ২৩:৫৫, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

দুষ্টের দমন-শিষ্টের লালনে অগ্রাধিকার

.

একটা জাতিরাষ্ট্র বিকাশ, উন্নয়ন সমৃদ্ধিতে জনসম্পৃক্ততা রাখে মুখ্য ভূমিকা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সংজ্ঞা সেটিই নির্দেশ করে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক গার্নারের মতবাদটি প্রণিধানযোগ্য। তার মতে, রাষ্ট্র হলো কম বা বেশি এমন একটি জনসমাজ, যারা একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, বাইরের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এবং যাদের একটি সুসংগঠিত সরকার আছে, যার প্রতি অধিকাংশ অধিবাসীই আনুগত্য পোষণ করে। এই মতবাদ বিশ্লেষণে রাষ্ট্রের চারটি মৌলিক উপাদান লক্ষ্য করা যায়, যেমন- জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখ-, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। এই রাষ্ট্র বিকাশ বা গোড়াপত্তনের জন্য প্রয়োজন জনঅনুভূতি ধারণে সক্ষম স্বপ্নদ্রষ্টা নেতা বা নেতৃত্ব। তবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিকাশ বা গোড়াপত্তনের ইতিহাস সভ্যতায় ব্যতিক্রম।

কেননা, ধর্মীয় বিভাজনে জন্ম নেওয়া পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র পত্তনের শুরুতেই বাঙালীদের সঙ্গে যে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়েছিল, তার বিপরীতে ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূচনা, নিয়মতান্ত্রিক স্বাধিকার আন্দোলনে ত্রিশ লাখ নরনারীর আত্মত্যাগের পর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। এর স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন বাঙালির ক্রমবর্ধমান ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো জনসমষ্টি। জনসমষ্টি ছাড়া রাষ্ট্রকে কল্পনা করা যায় না। বিষয়টি বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের গভীরতা দিয়ে অনুধাবন করেছিলেন। ঔপনিবেশিক পাকিস্তান শাসকদের নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে এটিই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
একটা পরাধীন জাতিকে বঙ্গবন্ধু কিভাবে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে এনে স্থায়ী পরিচয় দিয়েছেন, সেটা অবশ্যই বিশ্লেষণের দাবি রাখে। জনতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বপ্নকে একই বিন্দুতে নিয়ে এসে সফল বাস্তবায়নের যে নেতৃত্বের কারিশমা, সেটি গণমানুষের মধ্য থেকে বেড়ে ওঠা ব্যক্তি শেখ মুজিব কৈশোর থেকে ধারণ করতে পেরেছেন। যার বহির্প্রকাশ ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিরাজগঞ্জের এক জনসভায় বঙ্গবন্ধুর অভিব্যক্তি থেকে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, শাসনতন্ত্রে লিখে দিয়েছি যে, কোনোদিন আর শোষকরা বাংলার মানুষকে শোষণ করতে পারবে না। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি।’ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশের জনগণের যে আত্মিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, তা কোনোভাবেই বিভাজিত হয়নি। বঙ্গবন্ধু ও বাংলার জনগণের সম্পর্ক ছিল এক ও অভিন্ন। ডেভিড ফ্রস্টের ‘আপনার বড় দুর্বলতাটা কী’- এ প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশের মানুষকে বেশি ভালোবাসি।’ বঙ্গবন্ধুর চিন্তা চেতনায় ছিল দেশ ও জনগণের উন্নতি ও কল্যাণ।
১৯৭৫-এর মর্মান্তিক ঘটনার পর উল্টোপথে হাঁটা বাংলাদেশকেও জন্ম ইতিহাসের নিকট দায়বদ্ধ করতে তাঁর সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র কাঠামো নির্মাণের যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখতেন, সেটির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন বর্তমান বিশ্ব আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় কতটা সম্ভব, সেটার গভীরে না গিয়ে মোটাদাগে বলা যায়Ñ গত এক যুগেরও বেশি সময়ে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষের সামর্থ্য, মাথাপিছু গড় আয় ও আয়ু বেড়েছে, দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে, নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষি-শিল্প যোগাযোগ অবকাঠামোর মতো মৌলিক সেবাখাতে রাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব বেড়েছে বিস্ময়কর গতিতে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রসারিত হওয়ায় সুবিধা পেয়েছে অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী। জলবায়ু, জ্বালানি, মহাকাশবিজ্ঞান- নতুন প্রজন্মের উপযোগী একটি সুস্থ ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রত্যাশায় এসব অপ্রচলিত সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো উন্মেচিত হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ শেখ হাসিনার শাসনকালকে স্মরণীয় করে রাখবে চিরদিন।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু যে সুযোগ নিজ সাংগঠনিক প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তৈরি করেছিলেন, তা ইতিহাসের আলোকিত অধ্যায় নির্মাণে নির্ণায়ক ভূমিকা রেখেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে জনকল্যাণে ব্রতী হলেও নগণ্য সংখ্যক সহযোদ্ধার সাহচর্য পেয়েছেন। এরপরও ক্লান্তিহীন পথচলায় ক্ষণিকের জন্যও থমকে যাননি।
স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি এবং তাদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বর্তমান বাংলাদেশের এই যে বিস্ময়কর উন্নয়ন অগ্রগতি- এর নিরঙ্কুশ কৃতিত্ব ও দাবিদার জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর একক নেতৃত্বেই দেশ এগিয়ে চলেছে। এটি যেমন অহংকারের, তেমনি নানা কারণে আশঙ্কার জায়গাও তৈরি হচ্ছে। কেননা, বিস্ময়কর উন্নয়ন অগ্রগতির পরও কেন জানি মনে হচ্ছেÑ কোনো এক অদৃশ্য অস্পৃর্শের ছোঁয়ায় সরকারের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। আমরা রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিলেও জাতিগত মনন চেতনা উৎকর্ষসাধনে কিংবা জনস্বার্থসংশ্লিষ্টতার বিষয়গুলো অনাদরে এড়িয়ে যাচ্ছি। দার্শনিক সক্রেটিস যথার্থ বলেছিলেন, দেহের সৌন্দর্যের চাইতে চিন্তার সৌন্দর্য অধিকতর মোহময় এবং এর প্রভাব জাদুতুল্য। এই চিন্তার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য তিনি জ্ঞানচর্চাকে উজ্জীবিত করেছিলেন। সক্রেটিস বলেছেন, যতদিন লেখাপড়ার প্রতি আকর্ষণ থাকে, ততদিন মানুষ জ্ঞানী থাকে।

আর যখনই তার ধারণা জন্মে যে সে জ্ঞানী হয়ে গেছে, তখনই মূর্খতা তাকে ঘিরে ধরে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না- জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গভেদে সমানভাবে গড়ে তোলার মাধ্যমে যে জাতিরাষ্ট্র গড়ে ওঠে, সেই রাষ্ট্রের ভিত্তি অনেক মজবুত হয়। অপরদিকে যে রাষ্ট্র এসব দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় বা এড়িয়ে যায়, সেই রাষ্ট্র মানবসম্পদ তৈরির চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা না করে নানা ধরনের বৈষম্য, বিভাজন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অন্যায়, অবিচার, ঘুষ-দুর্নীতি অনিয়মকে সমাজ রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সর্বত্র কর্তৃত্ব করার সুযোগ করে দেয়। বাস্তবতা বিবেচনায় আমরা সেদিকে ধাবিত কিনা, সেটি ভেবে দেখা দরকার।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন, সাধারণ জীবনযাপন, জনমতকে প্রভাবিত করার কৌশল, ন্যায়ের সঙ্গে নিবিড় সখ্য কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে সুদৃঢ় অবস্থান, সমাজ রাষ্ট্রের বাস্তবতায় কেন জানি মনে হচ্ছে সেটি আজ ক্রমেই নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে। বঙ্গবন্ধু রাজনীতিকে ত্যাগ ও জনসম্পৃক্তার দর্শনে প্রতিষ্ঠিত করলেও সময়ের স্রোতে তাঁর অনুসারী হিসেবে পরিচিত অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সমর্থকগণ জীবনাচরণে পার্থিব জগতের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। ফলে, জনসম্পৃক্ততা হ্রাসের সুবিধা নিচ্ছে অতি জাতীয়তা, উগ্র রাষ্ট্রিকতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ। অন্যদিকে আদর্শিক রাজনীতির অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের অভাবে ব্যক্তি পরিসরে মানুষ সমাজ থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। লোভ, স্বার্থপরতা, একাকিত্ব, আদর্শিক শূন্যতা নাগরিক জীবনকে নতুন নতুন সংকটের মুখে এনে দাঁড় করাচ্ছে। জীবনযাপনে বঙ্গবন্ধুকে অন্য দশজন সাধারণ বাঙালি থেকে আলাদা করা কঠিন ছিল। চলনে-বলনে, পোশাকে-পরিচ্ছদে, ভাবনায়-কল্পনায় তিনি ছিলেন একজন পুরোদস্তুর বাঙালি। অথচ তাঁর আদর্শিক রাজনীতির সেøাগান তুলে বর্তমানে সমাজ রাষ্ট্রের সর্বত্র একটি গোষ্ঠী ভোগবাদী ও কর্তৃত্বপরায়ন রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু করেছে এবং এ ধারাটি ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করছে। যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি ও ভবিষ্যৎ স্থিতিশীল বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত।
সমাজদর্শনের আলোকে বলাটা অত্যুক্তি হবে না যে, দলীয় আদর্শ, নীতি, কৌশল কিংবা স্বদেশ ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, সভ্যতার ক্রমবিকাশ, এমনকি সমকালীন ভূ-রাজনীতি যদি রাজনৈতিক নেতাকর্মীর আগ্রহের বিষয়বস্তু করা না যায়, সেটি কখনোই সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না। টানা ১৪ বছর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকার ক্ষমতায়। এ সময়ে অনেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করছেন, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, নিজের ভাগ্য নির্মাণে বিস্ময়কর সফলতা অর্জন করেছেন। কিন্তু ক’জন সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর নীতিদর্শন ও শেখ হাসিনার উন্নয়নের ত্যাগের রাজনীতি মনেপ্রাণে ধারণ করতে পেরেছেন, সেটি প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়। আজকাল ভূমিদুস্য, সুবিধাবাদী দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচারকারী, ব্যাংক লুটপাটকারী, সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারীদের মুখে সর্বত্র সমুচ্চরে বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি উচ্চারিত হচ্ছে। বাস্তবে বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণকামী ত্যাগের রাজনীতিতে কজনকে খুঁজে পাওয়া যাবে? বাহ্যিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীর সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেলেও মনেপ্রাণে বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ধারণ করেন, সেই সংখ্যা কি অনেক বেশি? ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে কিছু অনুপ্রবেশকারী।
মর্মান্তিক ’৭৫ পরবর্তী রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক ভিত্তি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত দলীয় পদ-পদবি পেতে বিশাল অঙ্কের লেনদেন সংঘটিত হয়েছে, যা আজ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। যার প্রেক্ষিতে রাজনীতি জনকল্যাণে নিবেদিত না হয়ে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে ব্যক্তিকল্যাণে। জনকল্যাণের রাজনীতির বাণিজ্যিক ভিত্তি গড়ে উঠেছে। এই চাঁদাবাজির বাণিজ্য শুধু দলীয় রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তা শ্রমজীবী, কর্মজীবী, পেশাজীবী সংগঠনসমূহের মধ্যে সুবিস্তৃত হচ্ছে। ছাত্র সংগঠনসমূহের কমিটি অনুমোদনের ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হচ্ছে চাঁদার পরিমাণ। অপরাজনীতির এই সর্বগ্রাসী রূপ আগামী প্রজন্মের জন্য দুর্নীতিগ্রস্ত, সন্ত্রাসী, জনস্বার্থবিরোধী রাজনীতিবিদ তৈরিতে সীমাহীন অবদান রাখছে। এই অপরাজনীতির ফলে তথাকথিত নেতারা উচ্চ পর্যায়ে চাঁদাবাজ বাণিজ্যিক নেতাদের ম্যানেজ করে কোনো কলেজ, ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩/৪ বছরের স্থলে ৮/১০ বছর ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এর ফলে ক্যাম্পাসে ছাত্রাবস্থাতেই গাড়ি, বাড়ির মালিকানাসহ উচ্চ ধনিক শ্রেণীতে পরিণত হচ্ছে। রাজনীতি, সংগঠন, দলীয় পদ-পদবি ব্যবহার করে এক শ্রেণির মুখোশধারী চেতনাধারীগণ গাড়ি, বাড়ি, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক, ইনস্টিটিউটের মালিক বনে যাচ্ছে। তাই রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা-বিশ্বাস হ্রাস পাচ্ছে। এতে একটি গণতান্ত্রিক জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের অগ্রগমন শুধু ব্যাহতই হচ্ছে না, বরং জনগণকে জনস্বার্থবিরোধী পথে ধাবিত করছে।
দৃশ্যত বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে তা নয়Ñ একথা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। তারা প্রশাসনের উচ্চমহলে খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, তাও ধারণা করা যায়। মূলত এদের অপকর্মের কাছেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাহাড়সম উন্নয়ন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। জনগণ ও জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কৃত্রিম দেয়াল তৈরি হচ্ছে। এই দুষ্টচক্রের বিকল্প ঠিকানা এখন কানাডা-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর-দুবাই। এই বর্ণচোরাদের মুখের বুলির সঙ্গে অন্তরের বিশ্বাসের কোনো মিল নেই। এরাই গণশত্রু। এরাই রাজনীতির জন্য ক্যান্সার। এদের পরিবার-পরিজন বাংলাদেশে থাকে না। কারণ, ভবিষ্যতে যে কোনো ঘটনার উদ্ভব হলে নিজেদের রক্ষায় তাদের ধনসম্পত্তি দেশের মধ্যে রাখা নিরাপদ মনে করে না। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য-শিক্ষা-ব্যাংক-বিমা-ভূমির মালিকানা তাদের কব্জায় আবদ্ধ। সরকারও এসব বর্ণচোরাদের চিনতে ব্যর্থ হচ্ছে কিনা, সেটি ভাবনার বিষয়। কারণ, এদের আচরণ, ভাষা অভিন্ন। এখানেই ভয়, এখানেই আতংক, এখানেই সংশয়।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি ২০২৩ সালের প্রথম সংসদ অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে বলেছেন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদক ও জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণরূপে নির্মূলের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিকে অধিকতর ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, স্বাধীন সার্বভৌম এদেশে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। তাই জনগণকে সবার ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক কৌশল ও প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক নীতিদর্শনের কাছে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র কখনোই ঔপনিবেশিক মানসজাত কর্তৃত্ব প্রদর্শনের সাহস দেখাতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু অকপটেই তাদের স্মরণ করে দিয়েছিলেন, সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, জনগণের প্রভু নন, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। বিগত বছরগুলোতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা/প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সর্বস্তরের কর্মচারীদের অধিকাংশই সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনায় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। কিন্তু বিশ্ব বেনিয়াচক্রের পরামর্শে কিছু স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি কোম্পানিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রেক্ষিতে নিয়োজিতদের অত্যন্ত অন্যায়, অযৌক্তিকভাবে সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের রেফারেন্সে ১০/১২ বছর রেখে দেওয়ার প্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে লক্ষ্য করা যায়, সেসব প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন ২/১ জন কর্তা ব্যক্তির ঊর্ধ্বতন ও সরকারি নিয়ম শৃঙ্খলার পরিপন্থি কার্যক্রমের প্রেক্ষিতে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতিসহ নানা জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ হচ্ছে। ফলে, একদিকে প্রতিষ্ঠানসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারকে সেসব অপকর্মের দায় নিতে হচ্ছে। বিদেশী বেনিয়াদের অপতৎপরতার বাইরে এসে সেসব সংস্থায় সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের মধ্য থেকেই সংস্থা প্রধান নিয়োগ করার বিষয়টি বিবেচনা করা যথার্থ হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু আজীবন জনমানুষের চাওয়া-পাওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়ে যে রাজনৈতিক দর্শন প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাঁর আদর্শিক কর্মী হিসেবে আগামীর স্মার্ট ও উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য আমাদের সেই রাজনীতির কাছে মাথা নত করতে হবে। সুশিক্ষা, সুশাসনের স্বার্থে রাষ্ট্রের অপরিহার্য প্রাতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। সরকার ও জনমানুষের মাঝে যে ক্ষমতার কৃত্রিম দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে, তা বঙ্গবন্ধুর সত্যিকার রাজনৈতিক চর্চা দিয়ে ভেঙে দিতে হবে। সুন্দর আগামীর জন্য জনগণের ক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে হবে। সুবিধাবাদী লুণ্ঠনচক্র থেকে রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রশাসনিক কর্মকা-কে মুক্ত করার কৌশল নিতে হবে। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিয়ে একটি রাষ্ট্র সমৃদ্ধির সোপানে এগিয়ে যেতে পারে না। সেটি অনুধাবনে নিয়ে নাগরিক মনন জগতে দেশপ্রেম, দায়বদ্ধতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, জবাবদিহির বিষয়টি গ্রোথিত করার কর্মকৌশল নিতে হবে।
ভোগবাদের দুষ্টচক্র যেভাবে সামাজিক মূল্যবোধ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে দিচ্ছে, সেটি সুন্দর আগামীর জন্য সুখকর বার্তা বয়ে আনবে না। আমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক আবরণে ভোগের নেশা থেকে প্রজন্মকে মুক্ত করতে হবে। রাষ্ট্রটি শুধু বিশেষ সুবিধাবাদী শ্রেণির নয়, এটা গণমানুষের রক্ত ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত পবিত্র ভূখ-। যে কাঠামো জনমানুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় সুশাসন নিশ্চিতে সাংবিধানিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সুবিধাবাদী রাজনীতির দুষ্টচক্র থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হবে। দায় এড়ানো নয়, সুশাসনসহ জবাবদিহি সুনিশ্চিতে রাষ্ট্রকেই পরিচ্ছন্ন অঙ্গীকার নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। যেখানে পেশিশক্তির প্রাধান্য বাদ হয়ে মেধাভিত্তিক কর্মশক্তি রাষ্ট্র সমাজের নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হবে। আশা করছি, বঙ্গবন্ধুর পাহাড়সম সততা, উজ্জ্বল ও দূরদর্শী রাজনৈতিক আদর্শ বলে বলীয়ান হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাজ ও রাষ্ট্রে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনে আরও কঠোর হবেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই প্রত্যাশা অনুধাবনে ব্যর্থ হলে গণতন্ত্র ও রাজনীতি বিপন্ন হতে পারে।

লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও সভাপতি, আইডিইবি

×