ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রদ্ধাঞ্জলি- আপন ব্রতে নিবেদিত ডা. এস এ মালেক

অজিত কুমার সরকার

প্রকাশিত: ২১:৩২, ৯ ডিসেম্বর ২০২২

শ্রদ্ধাঞ্জলি- আপন ব্রতে নিবেদিত ডা. এস এ মালেক

.

মানুষের দেহ নশ্বর, কিন্তু কীর্তি অবিনশ^র। মানব কল্যাণ বা মহৎ কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষ তাদের কর্মের দ্বারাই দেশ, সমাজ ও পরিবারের কাছে বরণীয় হয়ে থাকেন। শুধু জীবৎকালেই নয়, মৃত্যুর পরও কীর্তির মহিমায় তারা মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরকাল বেঁচে থাকেন। এমন ব্যক্তিরাই সমাজে সিদ্ধ এবং প্রবাদ পুরুষ বলে বিবেচিত। দেশ, সমাজ, রাজনীতি এবং রাষ্ট্র- এই চার ক্ষেত্রে অবদান রাখা এমনি একজন সিদ্ধ ও প্রবাদ পুরুষ প্রখ্যাত রাজনীতিক, মুক্তিযোদ্ধা এবং লেখক ডা. এস এ মালেক। ৬ ডিসেম্বর ২০২২ রাত ১১টায় তিনি প্রয়াত হন। তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা এবং কথা হয় ১২ নভেম্বর অর্থাৎ মৃত্যুর ১৮ দিন আগে। তিনবার করোনায় আক্রান্ত ডা. মালেক বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন।

আমি চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ৯ দিনের জন্য দিল্লিতে ছিলাম। দেশে ফিরেই আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। বিছানায় শুয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে তিনি যা বললেন তা শুনে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। কারণ তার কথার মধ্যে ছিল মৃত্যুর পূর্বাভাস। ‘আমার দিন শেষ হয়ে আসছে। দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু পরিষদকে আরও তৎপর হতে হবে।’ একথাগুলোর সঙ্গে তিনি আরও বললেন, ‘আমার দুঃখী মেয়ে নাদিরাকে তোমরা দেখো।’ আমি তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ডা. শেখ আবদুল্লাহ আল মামুন, যিনি পিতার প্রতি অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ তাকে টেলিফোনে বললাম, মালেক ভাইকে বাসায় না রেখে দ্রুত কোনো একটি হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করান। তিনি কালবিলম্ব না করে মালেক ভাইকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করান। এর আগে এই হাসপাতালে তার করোনার চিকিৎসাও করা হয়। মালেক ভাইয়ের মৃত্যুর পর ঘুরেফিরে তার সঙ্গে শেষ দেখার কথাগুলো ছাড়াও অতীতের নানা কথা বার বার মনে পড়ছে। তার সঙ্গে আমার সম্পর্র্ক ৩২ বছরের। প্রথম পরিচয় নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই তার সঙ্গে কাজের সম্পর্ক।
তিনি একজন সুলেখক। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই তিনি লিখেছেন হাজারো নিবন্ধ। গভীর অর্থবোধক এবং অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন বিশ্লেষণে পরিপূর্ণ কিছু নিবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত তিন খ-ের ইংরেজি গ্রন্থ ‘স্ট্রিম অব থটস’ এবং বাংলা গ্রন্থ ‘অবরুদ্ধ গণতন্ত্রের দু’দশক’, ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্র সমাজ রাজনীতি’ এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ইংরেজি পত্রিকা ‘নিউজ অ্যান্ড ভিউজ’ প্রকাশের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। পরিচয় এবং কাজের সুবাদে তাকে আমার কাছে থেকে জানার সুযোগ হয়। বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী এমন একজন বরেণ্য ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই মূলত এ নিবন্ধের অবতারণা।
৮৮ বছর বয়সী ডা. এস এ মালেক ছিলেন আপন ব্রতে নিবেদিত প্রাণ। দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করাই ছিল তাঁর একমাত্র ব্রত। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের জ্যেষ্ঠ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি, রাজনীতিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এস এ মালেক রাজনৈতিক কর্মী, সমর্থক ও বুদ্ধিজীবী সকলের কাছে ‘মালেক ভাই’ হিসেবে সুপরিচিত। একজন সাধারণ কর্মী যখন তাকে মালেক ভাই বলে ডাকেন তখন বোঝাই যায় তিনি কতটা গণমুখী একজন মানুষ ছিলেন। তিনি শুধু অবিভক্ত ভারতবর্ষ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ এই তিন কালের রাজনীতির সাক্ষী বা ইতিহাসের একজন পর্যবেক্ষকই নন, মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার ছিল দৃপ্ত পদচারণা। ডা. এস এ মালেক প্রায়শই বলতেন ‘আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ হলো ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ।’ জীবন বাজি রেখে দেশ মাতৃকার জন্য যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সংসদ সদস্য হিসেবে জাতীয় সংসদেও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা তিনি মেনে নিতে পারেননি।

শুধু প্রতিবাদ নয়, এর বিরুদ্ধে একটা সময় পর্যন্ত তিনি প্রতিরোধও গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তীতে কৌশলগত কারণে সামরিক স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করায় বঙ্গবন্ধু পরিষদের তৎপরতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরই উদ্যোগে জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার একুশ বছরের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে ইতিহাস বিকৃতির বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধ ও জনতার অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টি হয়।
‘কর্মেই মানুষের পরিচয়’। বাক্যটির যথার্থতা খুঁজে পেলাম ১৯৯০ সালের জানুয়ারির কোনো এক দিন মালেক ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিনে। এদিন আমি আবিষ্কার করলাম একজন মানবিক মালেক ভাইকে। সন্ধ্যার পরে কলাবাগান বশিরউদ্দিন রোডে মসজিদের ঠিক উল্টো দিকের একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় মালেক ভাইয়ের চেম্বারে যাই। দুটি কামরার একটিতে তিনি বসেন। অন্য রুমে সোফা এবং চেয়ারে রোগীতে ঠাসা। শুধু রোগী নয়, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাও এসেছেন তার সাথে দেখা করতে। রাজপথে থাকা এসব নেতা-কর্মীকে মালেক ভাই অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন। অনেকক্ষণ বসার পর রোগী দেখার মধ্যেই শেষ দিকে রাজনৈতিক নেতা, কর্মীদেরও এক একজন করে ডাকছেন। এক পর্যায়ে আমারও ডাক পড়ল। আমি আদাব দিয়ে আমার প্রয়াত পিতা মুকুন্দলাল সরকারের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, গোপালগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং মুকসুদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির পরিচয় তুলে ধরতেই তিনি বললেন নাম শুনেছি। কারণ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কাশিয়ানির ওড়াকান্দিতে মুক্তিযোদ্ধাদের যে ক্যাম্পটি ছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন মালেক ভাই। তার ছদ্ম নাম ছিল ক্যাপ্টেন হালিম। মালেক ভাইয়ের চেম্বারে ক্ষণিক সময় বসে থাকার মধ্যেই যে ঘটনাটি আমাকে বিস্মিত করেছে তাহলো কথার ফাকে কম্পাউন্ডারকে বললেন গরিব রোগী কতজন আছে? উত্তরে সে জানাল প্রায় ২০ জন। মালেক ভাই বললেন, তাদের এক একজন করে পাঠাও। গরিব রোগীদের কারও কাছ থেকে কোনো ফি নিলেন না।
শুধু তাই নয়, তাদের বিনামূল্যে ওষুধও সরবরাহ করলেন। সামর্থ্যহীন অসহায় দরিদ্র মানুষের প্রতি মানবিক বোধ ও দরদ দেখে মুগ্ধ হলাম।

মালেক ভাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করলেও পরবর্তীতে হোমিওপ্যাথিতে প্র্যাকটিস করেন। চিকিৎসায় সুনাম ছিল। যে কারণে প্রচুর রোগী তার কাছে আসতেন।
রাজনীতিতে ডা. এস এ মালেক ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। নীতি-আদর্শের প্রতি সব সময়ই অবিচল। কোনো প্রলোভন তাকে তাঁর অবস্থান থেকে এক বিন্দু টলাতে পারেনি। ১৯৪৮ সালে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ২৪ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ষাটের দশকে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। থাকতেন কলাবাগানে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে মেডিক্যালে পঞ্চম বর্ষের পরীক্ষা দিতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু তাকে ইডেন কলেজের পরিচালনা পরিষদের সদস্য হতে বলেন। ১৯৬৪ সালের আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসির ইলেকশনে তাকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আগেই বলেছি ডা. এস এ মালেকের জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্মটি হলো বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো দেশের অভ্যন্তরে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা। কৌশলগত কারণেও তা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ডা. মালেক মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে দেশের অভ্যন্তরেই সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দেশের অভ্যন্তরে সে সময় দুটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হয়। তার একটি কুষ্টিয়া, অন্যটি গোয়ালন্দ। এরপর ডা. এস এ মালেক ভারতে চলে যান। অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং ফরিদপুরে মুক্তাঞ্চলের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে তিনি সাব-সেক্টর কমান্ডার নূর মোহাম্মদসহ অন্যদের নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি এসে ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। মে মাসের শেষ সপ্তাহে তারা তুমুল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আলফাডাঙ্গা, বোয়ালমারি, কাশিয়ানি, মুকসুদপুরসহ পাঁচটি থানা মুক্ত করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আট দিন আগে ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ গোপালগঞ্জকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করেন এবং জেলা প্রশাসক অফিসে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
আমি এ লেখার শেষ করতে চাই কার্ল মার্কসকে উদ্ধৃত করে। তিনি বলেছিলেন, “... শুধু নিজের জন্য যে বাঁচে সে হয়ত ব্যক্তিগত খ্যাতি অর্জন করতে পারে। একজন পন্ডিত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। হতে পারে একজন কবি। কিন্তু কখনোই সে একজন মহৎ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। সাধারণের কল্যাণে যিনি নিবেদিতপ্রাণ তিনিই মহাত্মা। তিনিই সবচেয়ে সুখী, যিনি সবচেয়ে বেশি মানুষকে সুখী করতে পেরেছেন। ধর্ম আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, মানব জাতির জন্য যার ত্যাগ বেশি তিনিই আদর্শ, অনুসরণযোগ্য।’ মালেক ভাইকে আমি চিনেছি সাধারণ মানুষের কল্যাণে একজন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ হিসেবে। যার রাজনীতির কেন্দ্রে ছিল মানুষ। অর্থাৎ মানুষের কল্যাণ।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

 

 

 

×