ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতির পাতায় সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২

স্মৃতির পাতায় সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯৬৭ সালে। সে সময়কার সিভিল সার্ভিসের সদস্য হিসেবে নওগাঁ মহকুমার প্রশাসক পদে নিযুক্তি পেয়ে আমি চাঁদপুর থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে মনকাড়া জাহাজ কিউইএ উঠেছিলাম। তার স্বামী গোলাম আকবর চৌধুরীকে আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকাকালীন সময় থেকে চিনতাম। তিনি তখন রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের তরুণ ও প্রতিশ্রুতিবান উঠতি নেতা।
জাহাজে কেবিন থেকে বের হয়ে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে গোলাম আকবর চৌধুরী বললেন, চলুন আমার বেগম সাহেবের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেই। তার পেছনে পেছনে গিয়ে ডেকে শীতল পাটির ওপর চাদর বিছানো একটি সুবিন্যস্ত জায়গায় পরিচয় হলো সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে। ১৯৫৬ সাল থেকে তিনি ও তার স্বামী গোলাম আকবর চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ধারক ও বাহক আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী এবং নেতা। পরিচয়ের পর সাজেদা সহাস্যে বললেন, আপনার প্রভুরা আপনাকে আমাদের সঙ্গে বসতে ও কথা বলতে দেখলে শুধু বিরক্ত নয় রাগও হবেন। আমি হেসে বললাম, ব্যক্তি স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে তো আমি এই চাকরিতে ঢুকিনি।

আপনাদের রাজনীতির পরিধির বাইরে জনগণের সেবাও তো করা প্রয়োজন। তিনি আওয়াজ করে স্নেহময়ীর হাসি হাসলেন, আমাকে ডাবের পানি সহযোগে ফরিদপুরের (তার শ্বশুরবাড়ি) গুড় মাখানো মোয়া খেতে দিলেন। ছোট ছোট কথায় তুলে ধরলেন সমাজের অবস্থার উপলব্ধি, সাধারণ মানুষের বঞ্চনা ও হতাশার কয়েকটি ঘটনা, আর দেশের সকলকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা। আমি অনেকটা আত্ম সাফাইয়ের স্বরে বললাম, আমরা যে যেখানে যে কর্মবৃত্তে থাকি সেখানেও সব সময় সকলকে নিয়ে দেশের মানুষের ভাল করা, মঙ্গল সাধন আমাদের সকলের কর্তব্য। বিদায়ের সময়ে সেই তখনকার পুরুষ-নারীর বিচ্ছিন্ন অবস্থানের দিনেও নির্দ্বিধায় হাত ধরলেন সাজেদা, বললেন, এগিয়ে যান, দেখা হবে এই কর্মবৃত্তের পরিক্রমায়।
সাজেদা চৌধুরীর জন্ম মাগুরাতে ১৯৩৫ সালে ৮ মেতে। ১৯৫৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ১৯৭০ সালে নির্বাচনে সে সময়কার পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে তিনি তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ পর্যন্ত তিনি এই পদে থেকে দেশের মহিলাদের পর্দার বেড়ি ও নারী-পুরুষের অসমতার বিচ্ছিন্নতা থেকে বাইরে টেনে এনে মানবসম্মত মুক্তি ও সমতার পথে এগিয়ে নিতে সংগ্রাম করেছিলেন।
১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও অন্যান্য পুরুষ নেতৃবৃন্দ যখন একের পর এক কারাবদ্ধ হয়েছিলেন তখন সাজেদা চৌধুরী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনবার তার সঙ্গে আমার দেখা ও কথা বলার বিরল সুযোগ হয়েছিল। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আমরা যে যেখানে থাকি বা কাজ করি না কেন আমাদের সকলের লক্ষ্য হওয়া ছাড়া বিকল্প কিছু নেই বলে বারবার বলেছিলেন এবং এই লক্ষ্যে আমাদের সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে বলে আহ্বান জানিয়েছেন। তার ছোট ছোট অথচ তেজোদীপ্ত কথাগুলো আমার এখনও মনে আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাজেদা চৌধুরী বাস্তুত্যাগী মহিলাদের মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে উজ্জীবিত করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার সন্নিকটে গোবরায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি সেবা সদন স্থাপন ও পরিচালনা করেন।

স্বাধীনতার যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পরে তার সঙ্গে আমার আবার দেখা হওয়ার সময়ে তিনি তৃপ্তির হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে বলেছিলেন, এবার শুরু হলো আমাদের আপনাদের সকল কর্মবৃত্তে সকল বাঙালীর দেশ গড়ার সংগ্রাম। আমাদের সঙ্গে, জনগণের পাশে একই লক্ষ্যে ও পর্বে আপনাদের সরকারী কর্মচারীদের পথযাত্রা। ১৯৭৭ সালে বৃহত্তর যশোরের জেলা প্রশাসক হিসেবে আমি সেই জেলার অন্তর্ভুক্ত মাগুরা মহকুমায় সাজেদা চৌধুরীর জন্মস্থান দেখতে পেরেছিলাম। পরে তার সঙ্গে দেখা হতে আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম আপনারা মহিলারা আপনাদের সচেতন জীবন শুরু হওয়ার পথে বাবা-মার এলাকা আলো করেন এবং পরে স্বামীর এলাকাও অনবদ্যভাবে জয় করতে পারেন-  আমরা পুরুষরা তা পারি না। সাজেদা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, সে জন্যই আপনাদের জন্য আমাদের-মহিলাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করা সঙ্গত।

১৯৭২ সালের শেষের দিকে সাজেদা চৌধুরী সকাল ১১টার দিকে একদিন অর্থ মন্ত্রণালয়ে আমার ছোট অফিস ঘরে এসে গম্ভীর মুখে বসে পড়লেন। আমি তখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রী, আমাকে বেশ স্নেহ ও প্রশ্নাতীতভাবে বিশ্বাস করেন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য পরিচিতির নিগড়ে আমি ১৯৫৬ সাল- যখন ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম- তখন থেকে বাঁধা। সাজেদা বললেন, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন ভাইয়ের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির কিসব কথা শুনছি- অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম নিয়ে তো না? বললাম, না মন্ত্রণালয়ের কাজের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ও অর্থমন্ত্রীর আমার জানামতে কোন বিরোধ বা ভুল বোঝাবুঝি নেই, কোন মতবিরোধ দেখিনি। বললেন- আমরা বাইরে থেকে ভিন্নতর কথা শুনছি-আপনারা দু’জনার সঙ্গে ফাঁকে ফাঁকে কথা বলেন না কেন? এই ভুল বোঝাবুঝি আমাদের জন্য ক্ষতি, মহাক্ষতির-  কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বললাম, রাজনৈতিক পর্যায়ে আপনারা কথা বলুন- ওই পর্যায়ে আমাদের কথা বেমানান-কঠিন। তোফায়েল ও শেখ মণিকে সঙ্গে রাখুন। বঙ্গবন্ধুর প্রখর ব্যক্তিত্বের সামনে কথাটি আমার পর্যায়ে তার সামনে তোলা কোনদিনই সম্ভব হয়নি। তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দু’বার কথাটি তুলেছিলাম। তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন, কোন মন্তব্য করেননি। তার পরের ঘটনা তো সবারই জানা। বঙ্গবন্ধুর অনুশাসন অনুযায়ী তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেন। ঘটনায় অনেকটা হতভম্ব হয়ে আমাদের ক’জনার সামনে সাজেদা আচল টেনে চোখ মুছেছিলেন।
স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত সাজেদা চৌধুরী মহিলা পুনর্বাসন বোর্ডের পরিচালক এবং গার্লস গাইডস এ্যাসোসিয়েশনের জাতীয় কমিশনারের ভূমিকায় অনবদ্য গঠনমূলক ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৪ সালে তিনি গ্রামীণ উন্নয়ন ও শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য প্রখ্যাত ইউনেস্কো ফেলোশিপ পান। গার্লস গাইডস এ্যাসোসিয়েশনের কমিশনার হিসেবে বিশেষ ভূমিকার জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত সিলভার এলিফ্যান্ট পুরস্কার পান। ২০০০ সালে তিনি আমেরিকান ‘জীবনী ইনস্টিটিউট’ কর্র্তৃক সেই বছরের সেরা নারী নির্বাচিত হন। ২০১০ সালে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মান-স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। অভিনন্দন জানাতে গিয়ে তার মুখেই শুনলাম- আমি সাধারণ, আটপৌরে মহিলা- আমি কি এই সম্মানের যোগ্য? বললাম, এই বিচারত জাতির- জনগণের।

এগিয়ে যান সেই পথ ধরে যা ১৯৫৬ সাল থেকে ধরে আছেন। কোন কাজে লাগলে বলবেন- আমি আপনার সঙ্গে আছি। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পর ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত সেই কঠিন সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ভূমিকায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে ভূমিকা রাখেন। এই সময়ে তার নেতৃত্ব সর্বাত্মক দৃঢ়তা ও সাহসিকতার- নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আপোসবিহীন অবয়বে দেখেছি, আর শ্রদ্ধায় মুগ্ধ হয়েছি। ১৯৯২ সালে তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সদস্য নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এই পদে থাকেন।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তিনি জননেত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময়ের প্রথম দিকে আমি প্রধানমন্ত্রীর সচিব ও শেষ দিকে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ছিলাম। দায়িত্ব নিয়েই তিনি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে আমার অফিস ঘরে এসেছিলেন। স্বভাবসুলভ হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন- এই যে ঝানু আমলা- বলেন তো মন্ত্রী হিসেবে কি কি না করা ভাল হবে? বলেছিলাম- কারও কথায় সচিব কিংবা অধীনস্থ কোন অফিসারকে বদলি করবেন না আর অননুমোদিত কোন উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ ছাড় করবেন না। মন্ত্রীর ভূমিকায় তার কার্যকালে এ দুটি কথা তিনি মনে রেখে কাজ করেছেন বলে জেনেছি।
১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গণচীন সফরে মন্ত্রী সাজেদা চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রীর সচিব হিসেবে আমি তার সফর সঙ্গী হয়েছিলাম। চীনাদের ঐতিহ্যে মোড়া প্রায় শেষ না হওয়া রাষ্ট্রীয় ভোজের পর তার পাশে বসে থাকা আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম- কাঁচা মাছ যে খেয়েছেন টের পেয়েছেন? হকচকিয়ে চেয়ার ছেড়ে প্রায় উঠে পড়ে সাজেদা বলেছিলেন- আরে আগে বলবেন তো! হেসে উত্তর দিয়েছিলাম- আমি কি জানি তারা কাঁচা মাছ খাওয়াবে? রাগ করবেন না- অভিজ্ঞতা তো হলো। কাঁটা চামচ বাঁ হাতে ধরে উঁচু করে সাজেদা বললেন- তিনি দেখে নেবেন আমাকে। কাঁটা চামচের আঘাতে আমাকে দেখে নেয়ার কথা পরে কখনও তার মনে থাকেনি। সেই রাতেই প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে সরকার প্রধানের নিরাপত্তা ও সম্ভ্রমের নিগূঢ় বেড়াজালের কামড়ায় রেখে আমরা ক’জন হোটেলের নিচে বিদেশী অতিথিদের জন্য পরিচালিত চীনা হাত শিল্পের বিপণিতে নেমে গিয়েছিলাম।

বেশ ঘুরেফিরে গোটা তিনেক চুড়ি কিনলেন সাজেদা। বললেন, বউমাদের জন্য, যোগ করলেন ওদের একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। আমাকে চুপচাপ দেখে বললেন- এই যে আপনি কিছু নিলেন না? গম্ভীর হয়ে বললাম- আমার স্ত্রী আমাদের এই বয়সে আমি তার জন্য যা কিনি তা পছন্দ করেন না। সাজেদা হেসে বললেন- ভালবাসার এ রকম দ্রোহ তো ভাল লক্ষ্মণ নয়। অদূরে কৃষিমন্ত্রী মতিয়াকে দেখলাম, স্বামী সাংবাদিক বজলুর রহমানের দৃষ্টি একটি শালের দিকে আকর্ষণ করতে নিষ্ফল চেষ্টা করছেন। সাজেদা দেখলেন, মুচকি হাসলেন- না বলা কথাগুলো মুখম-লে ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে ইশারা করলেন। অবিচ্ছিন্ন আন্দোলন, শেষ না হওয়া কাজের ফাঁকে সাজেদা চৌধুরী প্রকৃতই এক সাধারণ মহিলার প্রতিচ্ছবি নিয়ে আমাদের সকলকে মোহিত করে গেছেন।
সাজেদা চৌধুরী পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য গঠিত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। এই শান্তি চুক্তি প্রণয়নে আমি প্রধানমন্ত্রীর সচিব হিসেবে সাংসদ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর সহযোগী ছিলাম। চুক্তির বিশেষ দিকগুলো অনুধাবন এবং এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় পার্বত্য জনগোষ্ঠীর দেশের সব নাগরিকের সমান মানবিক ও জানতিক অধিকার রক্ষা করণে সরকারের ভূমিকা সকলের কাছে তুলে ধরার প্রক্রিয়ায় তিনি প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। চুক্তি অনুমোদনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সপ্রশংস দৃষ্টিতে তা প্রশংসা ও স্বীকার করেন। তার স্বামী গোলাম আকবর চৌধুরী ২০১৫ সালে পরলোকগমন করলে সাজেদা চৌধুরী কিছুটা ম্রিয়মাণ ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তবুও সকলের মানবিক অধিকার রক্ষাকরণ ও বাস্তবায়নে তিনি তার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর দূরে সরিয়ে দেননি।
সাজেদা চৌধুরী দৃঢ়চেতা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ উজ্জীবিত সংসদ সদস্য ছিলেন। সংবিধানের ১৫ সংশোধনী- যা দিয়ে নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনর্স্থাপনের পর অপ্রয়োজনীয় ও জাতির মর্যাদা হানিকর বলে প্রতিভাত হয়েছিল তা সাংবিধানিকভাবে বাতিল করার জন্য সংসদের বিশেষ কমিটির সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

এ দায়িত্ব পালনক্রমে সুস্পষ্টভাবে তিনি বলেছিলেন, স্বৈরতন্ত্রের গ্লানি মোছার জন্য যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবহারের প্রয়োজন ছিল, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারের কালে তার প্রয়োজন নেই এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যাতে আর কোন দিন বিঘিœত বা অবরুদ্ধ বা আহত না হয় তার জন্য জাতিকে সবসময় সচেতনভাবে এগিয়ে যেতে হবে। আমাকে বলেছিলেন, আপনি, আপনারা যারা জনতার মঞ্চে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, কি ভুল বুঝবেন?
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের নেতা শেখ হাসিনা সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোকাপ্লুত হয়ে বলেছেন, তিনি দেশের সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে বিশাল অবদান রেখে গেছেন। তিনি আরও বলেছেন, সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে তিনি একজন সত্যিকারের অভিভাবক হারিয়েছেন। সাজেদা কোনদিন তার সামনে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা সমন্ধে কাউকে বিরূপ মন্তব্য বা অসন্তোষ প্রকাশ করার সুযোগ কিংবা সময় দেননি। ২০০৮ এর নির্বাচনে তিনি ফরিদপুরের নগরকান্দা নির্বাচনী এলাকা থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন।

জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাব অনুযায়ী তাকে সংসদের উপনেতা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ২০১৪ ও ২০১৮ এর নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি তেমনি আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের উপনেতা নির্বাচিত হন। তিনি আমাদের সমর্থন ও শ্রদ্ধা নিয়ে আজীবন সংসদের এই পদে থেকেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সংসদীয় ভূমিকার দীর্ঘকালে তাকে তার আসনের ডান দিকের লাগোয়া আসন তার জন্য বরাদ্দ করেছিলেন। তার রোগাক্রান্ত সময়ে প্রধানমন্ত্রীর পাশের এই আসন শূন্য রেখেছিলে- অন্য কাউকে দিয়ে তা পূরণ করেননি।
তার মৃত্যু হয়েছিল ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে- এই বছরের ১১ সেপ্টেম্বরে। কোভিড আক্রান্ত হয়ে বুড়ো বয়সের জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। তার প্রথম জানাজা হয় তার নির্বাচনী এলাকা নগরকান্দায়- লাখো মানুষের সমাবেশে। পরদিন ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তেমনি হাজার হাজার ভক্ত ও অনুসারী আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীরা তাকে শ্রদ্ধা জানান। পরে বিকেলে বনানী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে চির শায়িত করা হয়। আমার ও সিতারার অকালে প্রয়াত বড় ছেলে ড. জালালের বনানীর কবরের পাশে গিয়ে চোখের পানি না মুছে ১৫ আগস্ট ১৯৯৫ সালের  স্বৈরতন্ত্রের ঘৃণিত আততায়ীদের গুলিতে প্রাণ দেয়া বঙ্গবন্ধুর পরিবার পরিজনদের কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে সাজেদা চৌধুরীর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি আমরা। সময় ও ক্ষণ ভুলে যাই। সাজেদা, জয় হোক আপনার, চির অম্লান থাকুক আপনার পুণ্য স্মৃতি।      
    
লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী

×