বানভাসি
‘পানি তো গেছেগি, আমরা ওখন কোয়াই যাই? ১০ দিন পানির তলে থাইক্কা বাসার সবতা নষ্ট ওই গিছে। মঙ্গলবারে চালের বস্তা আনছি আর বৃহস্পতিবারে বাসায় কোমর পানি। সব শেষ। ইকানো (আশ্রয়কেন্দ্র) তো দু-এক বেলা খাবার পাচ্ছি। বাসায় ফিরে তো তারও নিশ্চয়তা নাই।’- গত ২৫ জুন দুপুরে এভাবেই আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার কথা বলেছিলেন হারাধন নম।
১৬ জুন সিলেটনগরীর মাছুদীঘিরপাড় এলাকায় নিজের বাড়িটি বানের পানিতে তলিয়ে গেলে আশ্রয় নেন আশ্রয়কেন্দ্রে। পানি নেমে যাওয়ায় অনেক পরিবার চলে গেলেও কিছু কিছু পরিবারের আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে যাওয়ার মতো ব্যবস্থা এখনও হয়নি। তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ভবিষ্যত অনিশ্চয়তা। সাধারণ মানুষের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে খাবারের নিশ্চয়তা, বাড়িঘর এবং সড়ক পুনর্গঠন। তাই বন্যাপরবর্তী শঙ্কায় অনেকেই দিন যাপন করছেন।
সিলেট এবং সুনামগঞ্জে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে খাদ্য এবং বিশুদ্ধ পানির চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বন্যার্ত মানুষের হাহাকার এখনও থামেনি। বানভাসি মানুষের আর্তনাদেই জানান দেয় বন্যার বিভীষিকার রূপ। যে আর্তনাদের পেছনে লুকিয়ে আছে হারানোর বেদনা, ঘরের ভেতরের শূন্যতা।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে শুরু করতে হচ্ছে নতুন জীবন। যাদের সঞ্চিত টাকা আছে তাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে। অন্যদিকে সহায় সম্বলহীন মানুষগুলোর বাড়বে অসহায়ত্ব। এ মুহূর্তে তারা কাজও পাবে না। পরিবার চালানোর মতো কোন সংস্থানও হবে না। ফলে, একবেলা খাবার জোটানোই দুষ্কর হয়ে পড়ছে।
যারা বন্যার কবলে ঘর ফেলে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে এসেছিল, বাড়িতে গিয়ে দেখবে তাদের ঘরটি অক্ষত নেই। বন্যায় সব ধসে গেছে। ঘরের প্রিয় জিনিসগুলো নষ্ট হয়ে আছে। কিছু কিছু জিনিস মাটি এবং পানিতে মিশে একাকার হয়ে আছে। ছোটদের শিক্ষার উপকরণ ভেসে গেছে।
চুলায় আগুন ধরানোর মতো পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা নেই। চেনা জায়গা তাদের অসহায় করে তুলছে। অনেকে এক কাপড় পরে দিন পাড়ি দিচ্ছে। বড়রা রান্না করা খাবারের পাশাপাশি শুকনো খাবার খেয়ে বেঁচে থাকলেও শিশুসন্তানদের নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। ঘরের যে শিশুটির জন্য আলাদা খাবার কেনা হতো আজ তার জন্য পানি এবং চিড়াই যথেষ্ট! বয়স্কদের সঙ্গে তাকেও খাবারের জন্য হাহাকার করতে হয়।
ত্রাণের জন্য পথ চেয়ে থাকতে হয়। ক্ষুধার্ত শিশুটি খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলেও হাতে, দেয়ার মতো কিছু নেই। ক্ষুধার তীব্র জ্বালায় কোথায় যেন হারিয়ে গেছে হাসি। এ মুহূর্তে পানিবাহিত রোগ, ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি, কাশি ছড়িয়ে পড়ছে।
বন্যার্তদের সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসহ অনেকেই সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে, নানা পেশার লোক যথাসাধ্য পাশে থাকার চেষ্টা করছে। তাদের অনেকেই নৌকা নিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে। কেউ কেউ ত্রাণের তহবিল থেকে টাকা তুলে দিচ্ছে।
আবার কেউ কেউ পরনের জামা-কাপড় সংগ্রহ করে বন্যার্তদের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছে। দেশের বাইরে থেকেও অনেকেই বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে। যে যেভাবে পারে মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে তরুণরা সাবলীলভাবে বানভাসি মানুষদের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে।
অভাবের তাড়নায় অনেকেই গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি সস্তায় বিক্রি করে দিচ্ছে। কোনভাবে বেঁচে থাকাই এখন তাদের ভরসা। কিছুদিন আগেও তাদের চোখে স্বপ্ন ছিল সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার। গত দুবছর কোভিডের থাবায় অর্থনীতির চাকা থমকে যায়। কোভিডের নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বন্যার মতো দুর্যোগের হানা।
কোভিডের হানা কাটিয়ে উঠতে পারলেও বন্যার ক্ষতিগ্রস্ত কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়। সব মিলিয়ে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছে বন্যাদুর্গতরা। এখনও তারা ত্রাণের নৌকার অপেক্ষায়!
কয়েকটি উপজেলা সদরের হাসপাতাল বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ফলে, সেখানকার ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। চিকিৎসা সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে।
অনেক ফার্মেসিতে প্রয়োজনীয় সব ওষুধ মিলছে না। তবে বন্যাপরবর্তী অসুখ মোকাবেলায় ১৪০টিরও বেশি মেডিক্যাল টিম সিলেটে কাজ করছে।
প্রাথমিকভাবে বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারলেও এর বিরূপ প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। বন্যায় যা ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়া সহজে সম্ভব নয়। যে কৃষক বোরো ধান কেটে গোলা ভরে রেখেছিল, তা বন্যায় ভেসে গেছে নতুবা পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। যার ফলে খাদ্য জোগানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
চলতি মৌসুমে আউশ, আমন ও সবজি মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ৮৯ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়। এর মধ্যে পানিতে ডুবেছে ৮৮ হাজার ৬২২ হেক্টর জমি। ভেসে যাওয়া ফসলের ক্ষেতে নতুন করে শুরু করতে হবে উৎপাদন। যারা ঋণ নিয়ে কৃষি কাজ শুরু করেছিল, তাদের আরও কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। সবাইকে শূন্য থেকে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে হবে। সে কাজটুকু সহজ নয়। তবে সবার সহযোগিতা পেলে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে।
বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য এখন থেকেই এমন কিছু কাজ করতে হবে, যাতে সক্ষমতা হারানো লোকদের জন্য সহায়ক হবে। সেজন্য ক্ষতিগ্রস্ত সবার জন্য কয়েক মাস নিরবচ্ছিন্ন খাদ্য সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রাখা যেতে পারে। বন্যাপরবর্তী রোগ-বালাই প্রতিরোধে মোডিক্যাল টিম বহাল রাখতে হবে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা-ঘাট মেরামত করতে হবে।
অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষা উপকরণ নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের শিক্ষা উপকরণ প্রদান করতে হবে। সুনামগঞ্জ অঞ্চলে বোরো ধানের ক্ষতি বেশি হয়েছে। সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। ধানের ব্যাপক ক্ষতি হবার কারণে ধান বীজের সমস্যা থেকেই যাবে। ধানের বীজ এবং বীজতলার সমস্যা যেন না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে।
বীজতলায় চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও হাল চাষের সমস্যা নিরসনে কাজ করতে হবে। প্রান্তিক মানুষদের স্বাবলম্বী করে তুলতে সহজ উপায়ে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমনটি করেছে হবিগঞ্জ উন্নয়ন সংস্থা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের মানুষদের অর্থনৈতিক কর্মকা- পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ২০০ নারীকে সহজ শর্তে ৫০ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে হবিগঞ্জ উন্নয়ন সংস্থা।
সরকারের পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউ-েশন (চকঝঋ)- এর মাধ্যমে এই ঋণের উপকার ভোগীরা ৪ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিয়ে তা পরিশোধের জন্য সময় পাবেন আড়াই বছর। হবিগঞ্জের ৯টি উপজেলায় বানের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়ন সংস্থার ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের সদস্যরা এ ঋণ পাবেন। সরকার বর্তমান সমস্যা মোকাবেলায় যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সরকারের পাশাপাশি এনজিও, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সমাজের প্রতিটি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। বন্যার পানি সরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে পুনর্বাসনের কাজ শুরু করতে হবে। তবেই বন্যার ক্ষতিগ্রস্ত থেকে রেহাই পাবার সম্ভাবনা থাকবে। সর্বোপরি নদীর পৃথকসত্তাকে মেনে নিয়ে আমাদের উন্নয়ন পরিকাঠামোসহ সব কাজ করতে হবে পরিকল্পিতভাবে।
লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা