ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনিশ্চয়তায় বানভাসি মানুষ

অনজন কুমার রায়

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ৪ জুলাই ২০২২

অনিশ্চয়তায় বানভাসি মানুষ

বানভাসি

পানি তো গেছেগি, আমরা ওখন কোয়াই যাই? ১০ দিন পানির তলে থাইক্কা বাসার সবতা নষ্ট ওই গিছেমঙ্গলবারে চালের বস্তা আনছি আর বৃহস্পতিবারে বাসায় কোমর পানিসব শেষইকানো (আশ্রয়কেন্দ্র) তো দু-এক বেলা খাবার পাচ্ছিবাসায় ফিরে তো তারও নিশ্চয়তা নাই’- গত ২৫ জুন দুপুরে এভাবেই আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার কথা বলেছিলেন হারাধন নম

১৬ জুন সিলেটনগরীর মাছুদীঘিরপাড় এলাকায় নিজের বাড়িটি বানের পানিতে তলিয়ে গেলে আশ্রয় নেন আশ্রয়কেন্দ্রেপানি নেমে যাওয়ায় অনেক পরিবার চলে গেলেও কিছু কিছু পরিবারের আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে যাওয়ার মতো ব্যবস্থা এখনও হয়নিতাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ভবিষ্যত অনিশ্চয়তাসাধারণ মানুষের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে খাবারের নিশ্চয়তা, বাড়িঘর এবং সড়ক পুনর্গঠনতাই বন্যাপরবর্তী শঙ্কায় অনেকেই দিন যাপন করছেন

সিলেট এবং সুনামগঞ্জে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছেতবে খাদ্য এবং বিশুদ্ধ পানির চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছেবন্যার্ত মানুষের হাহাকার এখনও থামেনিবানভাসি মানুষের আর্তনাদেই জানান দেয় বন্যার বিভীষিকার রূপযে আর্তনাদের পেছনে লুকিয়ে আছে হারানোর বেদনা, ঘরের ভেতরের শূন্যতা

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের উদ্বেগ-উকণ্ঠার মধ্যে শুরু করতে হচ্ছে নতুন জীবনযাদের সঞ্চিত টাকা আছে তাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হবেঅন্যদিকে সহায় সম্বলহীন মানুষগুলোর বাড়বে অসহায়ত্বএ মুহূর্তে তারা কাজও পাবে নাপরিবার চালানোর মতো কোন সংস্থানও হবে নাফলে, একবেলা খাবার জোটানোই দুষ্কর হয়ে পড়ছে

যারা বন্যার কবলে ঘর ফেলে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে এসেছিল, বাড়িতে গিয়ে দেখবে তাদের ঘরটি অক্ষত নেইবন্যায় সব ধসে গেছেঘরের প্রিয় জিনিসগুলো নষ্ট হয়ে আছেকিছু কিছু জিনিস মাটি এবং পানিতে মিশে একাকার হয়ে আছেছোটদের শিক্ষার উপকরণ ভেসে গেছে

চুলায় আগুন ধরানোর মতো পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা নেইচেনা জায়গা তাদের অসহায় করে তুলছেঅনেকে এক কাপড় পরে দিন পাড়ি দিচ্ছেবড়রা রান্না করা খাবারের পাশাপাশি শুকনো খাবার খেয়ে বেঁচে থাকলেও শিশুসন্তানদের নিয়ে পড়েছেন বিপাকেঘরের যে শিশুটির জন্য আলাদা খাবার কেনা হতো আজ তার জন্য পানি এবং চিড়াই যথেষ্ট! বয়স্কদের সঙ্গে তাকেও খাবারের জন্য হাহাকার করতে হয়

ত্রাণের জন্য পথ চেয়ে থাকতে হয়ক্ষুধার্ত শিশুটি খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলেও হাতে, দেয়ার মতো কিছু নেইক্ষুধার তীব্র জ্বালায় কোথায় যেন হারিয়ে গেছে হাসিএ মুহূর্তে পানিবাহিত রোগ, ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি, কাশি ছড়িয়ে পড়ছে

বন্যার্তদের সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসহ অনেকেই সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছেদেশের নানা প্রান্ত থেকে, নানা পেশার লোক যথাসাধ্য পাশে থাকার চেষ্টা করছেতাদের অনেকেই নৌকা নিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেকেউ কেউ ত্রাণের তহবিল থেকে টাকা তুলে দিচ্ছে

আবার কেউ কেউ পরনের জামা-কাপড় সংগ্রহ করে বন্যার্তদের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছেদেশের বাইরে থেকেও অনেকেই বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসছেযে যেভাবে পারে মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেবিশেষ করে তরুণরা সাবলীলভাবে বানভাসি মানুষদের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে

অভাবের তাড়নায় অনেকেই গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি সস্তায় বিক্রি করে দিচ্ছেকোনভাবে বেঁচে থাকাই এখন তাদের ভরসাকিছুদিন আগেও তাদের চোখে স্বপ্ন ছিল সুন্দরভাবে বেঁচে থাকারগত দুবছর কোভিডের থাবায় অর্থনীতির চাকা থমকে যায়কোভিডের নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বন্যার মতো দুর্যোগের হানা

কোভিডের হানা কাটিয়ে উঠতে পারলেও বন্যার ক্ষতিগ্রস্ত কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়সব মিলিয়ে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছে বন্যাদুর্গতরাএখনও তারা ত্রাণের নৌকার অপেক্ষায়!

কয়েকটি উপজেলা সদরের হাসপাতাল বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছেফলে, সেখানকার ওষুধ, চিকিসা সরঞ্জামসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছেচিকিসা সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে

অনেক ফার্মেসিতে প্রয়োজনীয় সব ওষুধ মিলছে নাতবে বন্যাপরবর্তী অসুখ মোকাবেলায় ১৪০টিরও বেশি মেডিক্যাল টিম সিলেটে কাজ করছে

প্রাথমিকভাবে বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারলেও এর বিরূপ প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারীবন্যায় যা ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়া সহজে সম্ভব নয়যে কৃষক বোরো ধান কেটে গোলা ভরে রেখেছিল, তা বন্যায় ভেসে গেছে নতুবা পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছেযার ফলে খাদ্য জোগানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে

চলতি মৌসুমে আউশ, আমন ও সবজি মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ৮৯ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়এর মধ্যে পানিতে ডুবেছে ৮৮ হাজার ৬২২ হেক্টর জমিভেসে যাওয়া ফসলের ক্ষেতে নতুন করে শুরু করতে হবে উপাদনযারা ঋণ নিয়ে কৃষি কাজ শুরু করেছিল, তাদের আরও কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবেসবাইকে শূন্য থেকে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে হবেসে কাজটুকু সহজ নয়তবে সবার সহযোগিতা পেলে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে

বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য এখন থেকেই এমন কিছু কাজ করতে হবে, যাতে সক্ষমতা হারানো লোকদের জন্য সহায়ক হবেসেজন্য ক্ষতিগ্রস্ত সবার জন্য কয়েক মাস নিরবচ্ছিন্ন খাদ্য সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রাখা যেতে পারেবন্যাপরবর্তী রোগ-বালাই প্রতিরোধে মোডিক্যাল টিম বহাল রাখতে হবেবন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা-ঘাট মেরামত করতে হবে

অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষা উপকরণ নষ্ট হয়ে গেছেতাদের শিক্ষা উপকরণ প্রদান করতে হবেসুনামগঞ্জ অঞ্চলে বোরো ধানের ক্ষতি বেশি হয়েছেসে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগাম প্রস্তুতি নিতে হবেধানের ব্যাপক ক্ষতি হবার কারণে ধান বীজের সমস্যা থেকেই যাবেধানের বীজ এবং বীজতলার সমস্যা যেন না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে

বীজতলায় চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও হাল চাষের সমস্যা নিরসনে কাজ করতে হবেপ্রান্তিক মানুষদের স্বাবলম্বী করে তুলতে সহজ উপায়ে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারেযেমনটি করেছে হবিগঞ্জ উন্নয়ন সংস্থাবন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের মানুষদের অর্থনৈতিক কর্মকা- পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ২০০ নারীকে সহজ শর্তে ৫০ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে হবিগঞ্জ উন্নয়ন সংস্থা

সরকারের পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউ-েশন (চকঝঋ)- এর মাধ্যমে এই ঋণের উপকার ভোগীরা ৪ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিয়ে তা পরিশোধের জন্য সময় পাবেন আড়াই বছরহবিগঞ্জের ৯টি উপজেলায় বানের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়ন সংস্থার ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের সদস্যরা এ ঋণ পাবেনসরকার বর্তমান সমস্যা মোকাবেলায় যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে

সরকারের পাশাপাশি এনজিও, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সমাজের প্রতিটি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবেবন্যার পানি সরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে পুনর্বাসনের কাজ শুরু করতে হবেতবেই বন্যার ক্ষতিগ্রস্ত থেকে রেহাই পাবার সম্ভাবনা থাকবেসর্বোপরি নদীর পৃথকসত্তাকে মেনে নিয়ে আমাদের উন্নয়ন পরিকাঠামোসহ সব কাজ করতে হবে পরিকল্পিতভাবে

লেখক :  ব্যাংক কর্মকর্তা

[email protected]

×