ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৭ জুলাই ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

নবী রসূলগণের মাধ্যমে যেসব অবাক করা ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে সেগুলোকে মু’জিযা বলে। মু’জিযা মূলত আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর কুদরতেরই বিশেষ নিদর্শন যা শুধুমাত্র নবী রসূলগণের জন্য তিনি খাস করে দিয়েছিলেন। খাতামুন্ নাবীয়ীন সরদারে দো আলম নূরে মুজাস্সম হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে যেমন ইসলামের পরিপূর্ণতা আসে তেমনি মু’জিযারও সমাপ্তি ঘটে। হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের পূর্বে যুগে যুগে যত নবী বা রসূল পৃথিবীতে তসরিফ এনেছেন তাঁদের প্রত্যেকেই কোন না কোন বিশেষ মু’জিযার অধিকারী ছিলেন। মানুষকে সৎপথে আনার অনন্য উপায় হিসেবে মু’জিযার প্রয়োজন হয়েছিল আবার অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সঙ্কট উত্তরণে মু’জিযা বিশেষ অবদান রাখত। সাধারণ চোখে মু’জিযাকে বিস্ময়কর ঘটনা বলে মনে হলেও আসলে তা কিন্তু নবী-রসূলদের জন্য আল্লাহ্ প্রদত্ত অনন্য ক্ষমতা ও শক্তি। হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের মু’জিযার সংখ্যা অসংখ্য। প্রকৃত পক্ষে মু’জিযা প্রকাশ করা বা অলৌকিক কিছু দেখানো সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর ওপর নির্ভরশীল। কুরআন মজীদে পূর্ববর্তী নবী-রসূলগণের মু’জিযার বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। এসব মু’জিযা যে আল্লাহ্ই ঘটিয়েছেন বা প্রকাশ করেছেন তা অনায়াসে বোঝা যায় সংশ্লিষ্ট আয়াতে কারিমার দিকে গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে। যেমন, হযরত ‘ঈসা’ আলায়হিস্ সালাম বনী ইসরাঈলকে মু’জিযা দেখানোর উল্লেখ করে বলেছিলেন : আন্নী আখ্লুকু লাকুম মিনাত্তীনি কাহায়আতিত্ায়রি ফা আন্ফুখু ফীহি ফাইয়াকুনু, তায়রাম বিইযনিল্লাহ- আমি তোমাদের জন্য কাদা দিয়ে একটি পাখির মতো আকৃতি গড়ব, তারপর তাতে ফুঁ দেব, ফলে তা জীবন্ত পাখি হয়ে যাবে (সূরা আল ইমরান : আয়াত ৪৯)। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর হুকুমে বা আদেশক্রমেই যে মু’জিযা প্রকাশিত হয় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই আয়াতে কারিমার ‘বিইযনিল্লাহ্’ আল্লাহ্র আদেশক্রমে এই পবিত্র বাণীতে। সরওয়ারে কায়েনাত সাইয়েদুল মুরসালিন নূরে মুজাস্সম হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম থেকে অসংখ্য মু’জিযা আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু বিভাসিত ও প্রকাশিত করেছেন, যার সংখ্যা অধিকাংশের মতে তিন হাজার। এত মু’জিযার অধিকারী অন্য কোন নবী-রসূল ছিলেন না। হযরত মূসা আলায়হিস সালাম বনী ইসরাঈলের বিরাট একটি দলসহ লোহিত সাগর পাড়ি দেয়াটাও মু’জিযা ছিল। হযরত সুলায়মান ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের বহু ভাষা জানা, পশু-পাখিদের ভাষা বোঝা, তখ্তে আরোহণ করে মুহূর্তের মধ্যে দূরবর্তী দেশে যাওয়া, হযরত ইউনূস আলায়হিস্ সালামের মাছের পেট থেকে উদ্ধার পাওয়াÑ এ সবই মু’জিযা। কুরআন মজীদে ও হাদিস শরীফে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের বিভিন্ন মু’জিযার বিবরণ রয়েছে। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু বুদ্ধিগ্রাহ্য এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উভয় প্রকারের মু’জিযাই দান করে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বকে সমুন্নত করেছিলেন, যা অন্য কোন নবী-রসুল একত্রে লাভ করেননি। কুরআন মজীদে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন, ওয়া রাফা নালাকা যিক্রাক- আর আমি আপনার খ্যাতিকে সমুন্নত করেছি : (সূরা ইনশিরাহ্ : আয়াত ৪)। কুরআন মজীদ সর্বশ্রেষ্ঠ মু’জিযা। ২৩ বছর ধরে নাযিল হওয়া এই কিতাব সমস্ত জ্ঞানের ভান্ডার। একে যতবার তিলাওয়াত করা যায় ততবারই নতুন মনে হয়। ইরশাদ হয়েছে আল্লাহ্ অতি উত্তম কথা সংবলিত কিতাব নাযিল করেছেন যার আয়াতসমূহ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও বারংবার পাঠ করা হয়। যারা আল্লাহ্কে ভয় করে তাদের গাত্র রোমাঞ্চিত হয়। অতঃপর তাদের দেহমন প্রশান্ত হয়ে আল্লাহ্ যিক্রের দিকে আকৃষ্ট হয়ে যায়। হযরত আলী রাদি আল্লাহু তা’আলা আন্হু থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ওপর ওয়া আনযির ‘আশীরাতাকাল আক্রাবীন- আপনি আপনার পরিবার পরিজন ও নিকটজনদের সতর্ক করুন। এই আয়াতে কারিমা নাযিল হলে তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন : হে আলী ছাগলের একটা আস্ত রান এবং তিন সের মতো আটা দিয়ে খানা রান্নার ব্যবস্থা কর এবং একটা বড় পেয়ালা ভর্তি দুধের যোগাড় কর। সেই সঙ্গে বনী আবদুল মুত্তালিবের সবাইকে দাওয়াত দিয়ে জমায়েত কর। হযরত আলী রাদি আল্লাহু তা’আলা আন্হু বলেন, আমি তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী সব কিছু প্রস্তুত করলাম, বনী আবদুল মুত্তালিবের সবাইকে দাওয়াত দিলাম। সবাই এলো- যাদের সংখ্যা আবু তালিব, হামযা, আব্বাস এবং আবু লাহাবসহ ৪০ জনের মতো ছিল। আমি খানার পাত্রটি তাদের সামনে রাখলাম। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম গোস্তের পাত্র থেকে একটা বড় টুকরা উঠিয়ে দাঁত দিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে পাত্রের চার পাশে রাখলেন। তারপর বললেন বিস্মিল্লাহ্, আপনারা খেতে শুরু করুন। সবাই আসুদা করে খেল। খাবার যা ছিল তা কিন্তু চল্লিশ জনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাদের মধ্যে এমন লোকও ছিল যার একার জন্য ওই খাদ্য অপ্রতুল ছিল। অথচ সবাই পেট পুরে তৃপ্তি সহকারে খেল। খাওয়া শেষ হলে হুজুর (সা) বললেন : আলী, এদের পান করার জন্য দুধ পরিবেশন কর। হযরত আলী (রা) বলেন, আমি দুধের পেয়ালাটি তাদের সামনে রাখলাম। সবাই পেয়ালা থেকে দুধ পান করল এবং তৃপ্তি সহকারেই পান করল। আল্লাহর কসম! পেয়ালায় যে দুধ ছিল তা একজনের জন্যই যথেষ্ট ছিল, খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে গেল। হযরত রাসুলুল্লাহ্ (সা) তাদের কিছু বলতে চাইলে তারা কথা না শুনেই চলে গেল। আবু লাহাব এই প্রস্থানে উস্কানি দিয়েছিল। পরের দিনও একইভাবে এক-দু’জনের খাবার দিয়ে তিনি ৪০ জনের আপ্যায়ন করালেন (বায়হাকি)। প্রিয়নবী (সা) শাহাদাত অঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করে চাঁদকে দ্বিখ-িত করেছিলেন। গত শতাব্দীতে চাঁদে অবতরণ করে দ্বিখ-িত হবার ফলে চাঁদে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল সেই ফাটলের মৃত্তিকা নিয়ে এসে পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন যে, এই ফাটল সৃষ্টির কাল হযরত মুহম্মদ (সা)-এর সেই সময়। এটা নিশ্চিত হয়ে চাঁদে অবতরণকারী আর্মস্ট্রং তো ইসলামই গ্রহণ করেন। চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার এই মু’জিযা সম্পর্কে কয়েকখানি হাদিস রয়েছে। কুরআন মজীদেও শাক্কুল কামার বা চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার উল্লেখ রয়েছে। যেমন : ওয়ান শাক্কাল কামার- চাঁদ দু টুকরো হয়েছে। হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আরবের বিখ্যাত পাহলোয়ান রুকানা ইবনে আবদি রাবীদকে ইসলামে দাখিল হওয়ার জন্য আহ্বান জানালে সে বলল : আপনি যা বলেন সত্য এটা যদি আমাকে বিশ্বাস করাতে পারেন তাহলে আমি ইসলাম গ্রহণ করব। রুকানা খুবই সুঠামদেহী ও প্রচণ্ড শক্তিধর ছিল। হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন : আমি যদি তোমাকে মাটিতে কুপোকাত করে ফেলে দিয়ে আর উঠতে না দেই তাহলে কি তুমি আমি যা বলছি তা সত্য হিসেবে গ্রহণ করবে? রুকানা বলল : অবশ্যই। তখন হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম দাঁড়ালেন এবং রুকানাকে কুস্তির প্রথম প্যাঁচেই নিমিষে ধরাশায়ী করলেন। রুকানা বলতে লাগল এ তো দেখছি এক জাদুর কা- এমন জাদু আমি জীবনে দেখিনি। আমি মাটিতে পড়েই আমার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছিলাম (বায়হাকি)। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ রমাদান বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে মক্কার কুরাইশ মুশরিক সৈন্য সংখ্যা ছিল এক হাজার আর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে মুজাহিদ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন। এই যুদ্ধে ইসলামের বিজয় হয়। কুরআন মজীদে আছে প্রায় ছয় হাজার ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্ সালামের নেতৃত্বে এই যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। হযরত আবু হুরায়রা রাদি আল্লাল্লাহু তা’আলা আন্হু বলেন, একবার এক অভিযানকালে প্রচন্ড খাদ্য সঙ্কট দেখা গেল। হযরত রাসুলুল্লাহ (সা) কারও কাছে কোন খাবার আছে কিনা তা জানতে চাইলে আমি বললাম, আমার থলেতে কয়েকটি শুকনো খেজুর আছে। হযরত রাসুলুল্লাহ্ (সা) তা নিয়ে আসার নির্দেশ দিলে আমি তা নিয়ে এসে তাঁর পবিত্র হাতে তুলে দিলাম। তিনি থলেটির মুখ ধরে সবাইকে একে একে এসে থলের মুখ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে এক মুঠ করে খেজুর নিয়ে যেতে বললেন। একে একে সবাই মুঠ ভর্তি খেজুর নিয়ে তৃপ্তি সহকারে আহার করল। হুজুর (সা) আমার থলেটি ফেরত দিলেন। আমি থলের ভেতর তাকিয়ে দেখি তাতে যে কটি খেজুর ছিল সে ক’টি খেজুরই রয়ে গেছে। স্বশরীরে জাগ্রত অবস্থায় মিরাজে গমন এক অনন্য ঘটনা। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নূরের অবয়বে মানব সুরতে পৃথিবীতে তসরিফ আনেন। তিনি বিশ্ব জগতের জন্য রহমত- রহমাতুল্লিল আলামীন। তাঁর নূর মুবারকই আল্লাহ্ তা’আলার প্রথম সৃষ্টি যা নূরে মুহম্মদী নামে পরিচিত। পৃথিবীতে মানব সুরতে তাঁর আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে নবী আগমনের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ঘটেছে। তিনি হায়াতুন্নবী। তাঁর প্রতি সালাত ও সালাম পেশ করলে তিনি তাঁর জবাব দেন। এটা বাস্তব সত্য। মু’জিযা ঘটবার সময় বিস্ময়কর মনে হলেও ঘটবার সঙ্গে সঙ্গে সেটা তো বাস্তব সত্যই হয়ে যায়। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরিফ, উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ
×