ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

কোন গণতান্ত্রিক দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের দিন পালিত হতে পারে না -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৩ নভেম্বর ২০১৬

কোন গণতান্ত্রিক দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের দিন পালিত হতে পারে না -স্বদেশ রায়

বাংলাদেশে দুটি সফল, দুটি আধাসফল ও বিশটির বেশি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের দিন আছে। আরেকটি সফল সামরিক অভ্যুত্থানের দিন আছে যা ধূম্রজাল দিয়ে ঘেরা। এই সামরিক অভ্যুত্থানের দিনটি সাতই নবেম্বর। এই সামরিক অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে এ দেশে যেমন সামরিক শাসন, রাজনীতিতে সামরিক কালচার পাকাপোক্ত হয় তেমনি এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর শ্রেণী রাজনীতিসহ সমাজের সবখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরে স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্রান্তে সৃষ্ট সামরিক অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য ছিল উল্লিখিত কাজগুলোই করা। কিন্তু গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ভেতর দিয়ে সৃষ্ট একটি দেশ, তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার উপস্থিতি এসব মিলে কাজটি কঠিন ছিল। যে কারণে বাংলাদেশে ১৯৭৫’র সামরিক অভ্যুত্থানটি তিন পর্যায়ে শেষ করে দেশী-বিদেশী গণতন্ত্রবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। এই তিনটি পর্যায়ের প্রথম ছিল ১৯৭৫’র ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাসহ শেখ ফজলুল হক মণিকে হত্যা। জাতীয় চার নেতাকে জেলে নেয়া। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা খুবই কঠিন কাজ ছিল। কারণ, এই হত্যার অর্থ একটি সংবিধান ও একটি রাষ্ট্রকে হত্যা। এ কারণেই কিন্তু এর জন্য তিনটি পর্যায় নেয়া হয়। ১৫ আগস্ট, ৩ নবেম্বর ও ৭ নবেম্বর। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা হত্যাকারী হিসেবেই চিহ্নিত হয়। এবং বিদেশী চক্র যে রাজনীতিককে সামনে আনে সেই খুনী মোশতাকও ব্যর্থ হয় আওয়ামী লীগের মাধ্যমে এই হত্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে। অর্থাৎ ওই হত্যাকে কোন রাজনীতিক রূপ দিতে পারে না খুনীচক্র। তখন তারা দ্বিতীয় পর্যায়ে যায় খালেদ মোশারফকে নিয়ে। খালেদ মোশারফের পরিবারের একাংশ আওয়ামী লীগার; এজন্য এখনও খালেদ মোশারফের ক্যু নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতর একটি ভুল ধারণা আছে। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগারসহ দেশের সকল গণতান্ত্রিক মানুষের বোঝার সময় এসেছে- ওটাও একটি সামরিক অভ্যুত্থান ছিল। এবং তা ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নবেম্বরের ধারাবাহিকতা। ওটা আওয়ামী লীগের বা গণতন্ত্রের কিছু নয়। ছোট ছোট কয়েকটি বিষয় একটু খোঁজ নিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। এক. খালেদ মোশারফ ক্যু করার পরে তার পদোন্নতির ব্যাজের পিন লাগিয়ে দেন বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী ও হলিডে সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান। এবং যে ছবি বাইরে আসে ওটা লুঙ্গির ওপরে পোশাক পরা। ওই ছবিও শাহাদাত চৌধুরী ও এনায়েতুল্লাহ খানের তোলা। পরবর্তীতে ৭ নবেম্বরের পরে জিয়ার প্রমোশন হলে ওই ছবিও একই ক্যামেরা দিয়ে এই দুই সাংবাদিকই তুলেছিলেন। এবং সারাক্ষণ তারা যেমন খালেদ মোশারফের সঙ্গে ছিলেন তেমনি জিয়ারও সঙ্গে ছিলেন। দুই. স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতের ক্যাম্পের ঘটনা (ঘটনাটি শেখ ফজলুল হক মণির সর্বক্ষণিক সঙ্গী শফিকুল আজিজ মুকুলের কাছ থেকে শোনা- তিনি প্রত্যক্ষদর্শী, আরেক সাংবাদিকও প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন অনিল ভট্টাচার্য- তিনি লেখা শুরু করেছিলেন কিন্তু শেষ না করেই মারা গেছেন)। ক্যাম্পে খালেদ মোশারফ তার রুমে বঙ্গবন্ধুর ছবি টানাননি। তিনি রেখেছিলেন ভাসানীর ছবি। এ নিয়ে শেখ ফজলুল হক মণির সঙ্গে খালেদের কথা কাটাকাটি হয় ও এক পর্যায়ে শেখ ফজলুল হক মণি তাকে থাপ্পড় মেরে বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙ্গাতে বাধ্য করেন। সর্বোপরি, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ফারুকরা যখন ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যায় তখন অধিকাংশ অফিসার ও সেপাই ওই খবর শুনে হত্যাকারীদের ওপর ক্ষিপ্ত হন। ভীতসন্ত্রস্ত কর্নেল ফারুক, রশীদ তখন খালেদ মোশারফের কাছে গিয়ে আশ্রয় চায়। কর্নেল শাফায়েত জামিল খালেদ মোশারফকে আশ্রয় দিতে না বললে, তিনি উত্তর দেন- আর যাই হোক আমি তো আমার অফিসারদের নেকড়ের মুখে ফেলে দিতে পারি না। এর থেকে বোঝা যায়, খালেদ মোশারফের ক্যুও ১৫ আগস্টের একটি ধারাবাহিকতা ছিল। হয়ত উদ্দেশ্য ছিল মোশতাক যেখানে আওয়ামী লীগের একাংশের সমর্থনে ব্যর্থ হয়েছে খালেদ একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করে সেটা পারবে। বা পরিকল্পনাকারীদের উদ্দেশ্য এটুকুই ছিল যে, খালেদ ও মোশতাকের মাধ্যমে তাজউদ্দীনকে তো অবশ্যই এবং অন্য জাতীয় নেতাদের হত্যার কাজটি শেষ করে নেয়া হোক, যাতে পরবর্তী সামরিক ক্যু যিনি করবেন তার হাতে যেন বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের রক্ত সরাসরি লাগানো না থাকে। সে কাজটি পরিকল্পনাকারীরা খুবই সূক্ষ্মভাবে করে। তাই তারা আরও গভীর ধূম্রজালের ভেতর দিয়ে জিয়াকে ৭ নবেম্বর সামনে নিয়ে আসে। কর্নেল তাহের ’৭২- থেকেই পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েন, সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের একদল সোনার ছেলে জাসদের নামে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। তাই ১৫ আগস্ট ও ২ নবেম্বর খালেদ মোশারফের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে কাজে লাগাতে না পেরে এবার সামরিক অভ্যুত্থানের দেশী ও বিদেশী চক্রান্তকারীরা কাজে লাগায় জাসদকে। জাসদের দুই নেতা জলিল ও তাহের সামরিক অফিসার, তাদের কোন রাজনৈতিক জ্ঞান ছিল না। অন্যদিকে বাদবাকিরা তরুণ, তাই সহজে তারা সামরিক অভ্যুত্থানকারীদের খপ্পরে পড়ে। তাহের যে অবৈধ কাজ বঙ্গবন্ধুর শাসন আমল থেকে শুরু করেছিলেন, একটি কনভেনশনাল সামরিক বাহিনীর ভেতর সংগঠন গড়ে তোলা, ওই সংগঠনকেও তারা কাজে লাগায়। অন্যদিকে স্বাধীনতার পরে কম পরিচিত সমস্ত রাজাকার, আলবদররা আশ্রয় নিয়েছিল জাসদের পতাকা তলে। তাই ৭ নবেম্বর তাদের মূল নেতারা তাদেরকে কাজে লাগাতে পারে। অর্থাৎ একটি সামরিক শাসনের সঙ্গে একশ্রেণীর সাধারণ মানুষকে যোগ দেয়ায় ও সামরিক ক্যু এর নেতার মতো একজন অপবিত্র ব্যক্তিকে দেশের সব থেকে পবিত্র স্থান শহীদ মিনারে নিয়ে আসে। এখানে অবশ্য প্রকৃত গবেষকরা সময় নিয়ে গবেষণা করলে একটি সত্য পেতে পারেন, জাসদে আশ্রয় নেয়া ওই রাজাকার, আলবদর বা স্বাধীনতাবিরোধীরা সেদিন জাসদ নেতাদের কথা শোনেনি। তাদের মূল নেতারা তাই দেশে বসে হোক আর বিদেশে বসে হোক তারা তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছিল- এই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যম অন্তত পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠা না হোক কনফেডারেশন হবে পাকিস্তানের সঙ্গে। তারা তাদের মূল নেতাদের কথা মতোই কাজ করেছিলেন। যে কারণে সেদিন ট্রাকে ট্রাকে বা ট্যাঙ্কের ওপর বসে ওই সব জাসদ কর্মী ‘নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর’ স্লোগান শুধু দেয়নি ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে দিতে তারা শহীদ মিনারে যায়। নিজের জানালায় দাঁড়িয়ে ওই স্লোগান শুনে ডায়েরিতে লেখেন সরদার ফজলুল করিম। অর্থাৎ ১৯৭৫’র ১৫ আগস্ট জয় বাংলার বদলে যে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয় সেটাকে ৭ নবেম্বর পাকিস্তান জিন্দাবাদ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সর্বোপরি শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়ানো দেশ তাই সম্ভব হয়নি পাকিস্তান জিন্দাবাদ টিকিয়ে রাখা। তবে ৭ নবেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী এবং এই ধারাবাহিক সামরিক অভ্যুত্থানের মূল নাটের গুরু জিয়াউর রহমানের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পাকিস্তানী আইএসআইয়ের এই দক্ষ অফিসার সহজে বুঝতে পারে- একলাফে পাকিস্তান জিন্দাবাদ পর্যন্ত যাওয়া যাবে না। কনফেডারেশনও এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। তাই তিনি রাজাকার ও আলবদরদের সমাজে, রাজনীতিতে ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করেন। যাতে ভবিষ্যতে সহজে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনে যাওয়া সম্ভব হয়। অর্থাৎ সাতই নবেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে কবর রচনা হয় বঙ্গবন্ধুর উন্নয়নের গণতন্ত্রের এবং পাকিস্তানী সামরিক শাসন ফিরে আসে। ফিরে আসে রাষ্ট্রে ও সমাজের সবখানে স্বাধীনতাবিরোধীরা। এ কারণে ৭ নবেম্বর একটি সামরিক অভ্যুত্থানের দিন শুধু নয়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চেতনা ও স্বাধীনতার চেতনা ধ্বংসের একটি দিন। এদিনকে এখনও যারা সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান দিবস বলতে চায় ওরা মূলত ওই রাতে ট্যাঙ্কের ওপর বসে বা ট্রাকে চড়ে যারা পাকিস্তান জিন্দাবাদ সেøাগান দিয়েছিল তাদের উত্তরসূরি। বাংলাদেশে এরা যতক্ষণ মাথা উঁচু করে থাকবে ততক্ষণ এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। এ কারণেই গণতন্ত্রের স্বার্থে আজ যিনি বা যারা- তাই সে যত বড়ই হোন না কেন, যদি ৭ নবেম্বর পালন করতে চায় গণতান্ত্রিক শক্তির উচিত হবে তাদেরকে প্রতিহত করা। এমনকি রাষ্ট্রের উচিত হবে এই সামরিক অভ্যুত্থানের সহযোগীদের বা উত্তরসূরিদের আইনের আওতায় আনা। এমনকি তারা যদি জাসদের কর্মীও হয়, যে জাসদ সরকারের সঙ্গে আছে তাদেরও কর্মী হয় তাহলেও তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সামরিক অভ্যুত্থানের দিন ঘটা করে কেন- কোনভাবেই পালন হতে পারে না। আর এই কঠোরতার, এই প্রতিহত করার বিরুদ্ধে যদি সুশীল সমাজের নামে কেউ কোন কথা বলে- অবশ্যই ধরে নিতে হবে তিনি পাকিস্তানী। কেউ পাকিস্তানী হলে তিনি যে অগণতান্ত্রিক, এ কথা আর বলার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, পাকিস্তানী আর অগণতান্ত্রিক ও জঙ্গী এখন সমার্থক শব্দ। [email protected]
×